বিজ্ঞানমনস্কতা ✒️✒️✒️ রণজিৎ রায়
বিজ্ঞানমনস্কতা
রণজিৎ রায়
বিজ্ঞান পড়লেই কেউ বিজ্ঞানমনস্ক হয় না । এজন্যই সব বিজ্ঞানীও বিজ্ঞানমনস্ক নন । কবিতা লিখলেই যেমন সবাই কবি হয় না । আবার বিজ্ঞান না পড়েও কিছু মানুষ বিজ্ঞানমনস্ক । আমাদের সমাজে ধার্মিক মানুষেরা বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিবাদী মানুষদের নাস্তিক বলে অবজ্ঞা করেন । অপরদিকে যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্ক মানুষেরাও ধার্মিক মানুষদের ধর্মভীরু বলে অভিহিত করেন । ওদের মধ্যে বৈরিতা না থাকুক একটা বৈপরীত্য রয়েছে, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় । তবে যুক্তিবাদী মানুষদের বক্তব্য, “কেউ ধর্মের আচরণ ও কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখলে আমাদের আপত্তি নেই । কিন্তু সে মানুষটি ধর্মের দোহাই দিয়ে অন্যকে বিপথে নিয়ে তার কষ্টার্জিত অর্থ নানা আচার-অনুষ্ঠানে নষ্ট করতে যদি বাধ্য করেন, তাতে আমাদের ঘোরতর আপত্তি আছে ।শুধু আপত্তি নয়, আমরা তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই ।” পৃথিবীতে কোন অলৌককিতা নেই সবই লৌকিক, বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিবাদী মানুষেরা তা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন । শতাংশের হিসেবে বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিবাদী মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত । আজ আমি একজন মহান বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিবাদী মানুষের কথা তুলে ধরতে চাই, যা অনেকেরই অজানা।
শ্রী বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের নাম শোনেননি এমন বাঙালির সংখ্যা প্রায় হাতে গোনা। মহালয়াখ্যাত এমন মানুষটির স্মৃতি প্রতিবছর মহালয়ার বিশেষ দিনে তাঁর অসাধারণ কন্ঠের যাদুকরিতে আমরা আপ্লুত হয়ে পড়ি । সে মানুষটি অনেক কষ্ট করে সংসার প্রতিপালন করেছিলেন । নানা অনুষ্ঠান প্রচার করে সে সময়ে কলকাতা বেতারের প্রাণপুরুষ ছিলেন তিনি । পারিশ্রমিক ছিল নামমাত্র । এমনকী দেশ বিদেশের নানা জায়গায় গিয়ে তিনি অনুষ্ঠান করে অতি অল্প পারিশ্রমিক পেতেন । সে সময়ে এমনই ছিল । শেষ সময়ে কিছুদিন যখন গুরুত্ব বিচার করে পারিশ্রমিক বাড়তে থাকে তখন আর খুব বেশিদিন অনুষ্ঠান করতে পারেননি ।
এ মহান মানুষটি ছিলেন মনেপ্রাণে একজন নির্ভেজাল বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিবাদী মানুষ । ঈশ্বরের অস্তিত্বে তাঁর কোনো বিশ্বাস ছিল না । মন থেকে কখনও ঠাকুরের উদ্দেশ্যে পূজা ও প্রণাম করেননি । যা করেছেন সবই অভিনয়, তাঁর পেশা তথা উপার্জনের প্রয়োজনে । বোনেরা একদিন পারিবারিক আলোচনায় দাদাকে চেপে ধরে জিজ্ঞাসা করে, ” আচ্ছা দাদা, তুই বলছিস মনেপ্রাণে তুই একজন যুক্তিবাদী মানুষ । ঈশ্বরের অস্তিত্বকে বিশ্বাস করিস না । তাহলে এতসব ধার্মিক বয়স্ক মানুষেরা তোর পায়ে ধরে প্রণাম করেন । অনেকে আবার পায়ের ওপর পড়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করেন । তখন তো বাধা দিস না । একজন ধর্মপ্রাণ গুণী মানুষের মতো আচরণ করিস ।”
দাদা হাত তুলে বোনদের থামিয়ে বললেন, ” প্রথমদিকে খুব খারাপ লাগত । শিউরে ওঠে বাধা দিতাম । উদ্যোক্তরা খুশি হতেন না । ওরা যেমন আমাকে ঈশ্বরে অবিশ্বাসের কথা মানুষকে বলতে নিষেধ করতেন, তেমনি কেউ প্রণাম করলে যেন আপত্তি না করি ।নতুবা ধর্মপ্রাণ মানুষের মনে আঘাত লাগতে পারে । একবার আঘাত লাগলে কেউ আর অনুষ্ঠান দেখতে আসবেন না । ওদের ক্ষতির কথা ছেড়ে দিলেও আমার রুটিরোজগারে টান পড়তে বাধ্য । এসব বিবেচনা করে মেনে নিতে বাধ্য হলাম । মনে মনে ভাবি, ওঁদের ভক্তি, শ্রদ্ধা ও প্রণাম আমাকে নয়, আমার কর্মকে অর্থাৎ পাঠের কাজকে ।”
বোনেরা তথাপি এক ইঞ্চি ছাড়তে সম্মত নয় । আবার জিজ্ঞাসা করে,” কিন্তু দাদা, তুই যখন কালীমাতা কিংবা সারদা মায়ের বর্ণনা করিস ভাবে, আবেগে ও ভক্তিতে চোখের জলে তোর বুক ভেসে যায় । এটাও কি তবে অভিনয় ?”
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি উত্তর দিলেন, ” এ সময়ে মায়ের কথা খুব মনে পড়ত । জগতে মায়ের কোনো বিকল্প হয় না রে ! আমাদের মা আমাদের জন্যে কত কষ্ট করেছে । গভীরভাবে খুঁটিয়ে দেখলে সহজেই বুঝতে পারবি । তথাপি হাসিমুখে সব সয়ে গেছে । মাকে স্মরণ করেই পাঠ করতাম । অন্য মা কিংবা পাথরের মায়ের জন্যে নয়, আমার মায়ের জন্যেই আমার হৃদয় হাহাকার করে ওঠত । আমার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ত টের পেতাম না । অনুষ্ঠানের পর অন্যের মুখে, ছবি ও ভিডিও দেখে আমি নিজেও বিস্মিত হতাম ।”
কথা থেমে গেল ।দাদার দুচোখ থেকে অবিরাম জল গড়িয়ে পড়ছে । বোনেদের চোখেও অশ্রুর বন্যা বহে যেতে থাকে । সে এক অনির্বচনীয় ব্যতিক্রমী দৃশ্য ! বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের মতো এমন অসাধারণ গুণী মানুষ আর কয়জন আছেন !