আত্মজা *** সুদেষ্ণা সিনহা
আত্মজা
———-
ধারাবাহিক উপন্যাস
অধ্যায় -৪
সুদেষ্ণা সিনহা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে।জাপান একাধিক দেশের বিরুদ্ধে লড়ছে।কলকাতা শহরের ভিতরে তেমন করে কোন যুদ্ধের প্রভাব নেই।তবে মাঝে মাঝে আকাশপথে হামলা চালায় জাপানি যুদ্ধবিমান। কখনো কখনো কলকাতাতেও বোমা পড়ছে।
লোকেদের মুখে মুখে একটা গান বেশ শোনা যাচ্ছে :
সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি,
বোম ফেলেছে জাপানি।
বোমের ভিতর কেউটে সাপ,
সবাই বলে বাপ রে বাপ।
স্বদেশি আন্দোলন নিয়ে কংগ্রেস,ফ্রন্ট মোর্চা,বা মুসলিম লিগ কেউ থেমে নেই। হিন্দু-মুসলমান কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে স্বদেশী আন্দোলনের জোয়ারে গা ভাসাচ্ছে একসাথে। মুসলিম লিগ বা কংগ্রেস মিটিংগুলোতে বসে নিজস্ব দাবি-দাওয়া নিয়ে সরব হতেও ছাড়ছে না।
শ্যামাকান্ত ইংরেজ সাহেবদের অধীনে চাকরি করেন। এই সব রাজনৈতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লে তার সমূহ বিপদ। দেশের স্বাধীনতা নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। পরাধীনতা মুক্ত হয়ে দেশ স্বাধীন হোক।তবে স্বাধীনতা সংগ্রামের নামে ন্যক্কারজনক গুন্ডামি তিনি পছন্দ করেন না। নিজেকে এসব থেকে সাত হাত দূরেই রাখেন তিনি। অবসর সময়ে নিজের মতো সময় কাটান।
এসপ্ল্যানেডের অফিসের কাছাকাছি একটা ঘর ভাড়া নিয়েছেন শ্যামাকান্ত। কাস্টমস অফিস দশটা-পাঁচটার নিয়মে চলে না।সারাদিন ধরে তাদের কাজ।বাড়িতে রান্নার ব্যবস্থা নেই শ্যামাকান্তের।একা মানুষ। সে সব হাঙ্গামা তার ভালো লাগে না। এই অফিসগুলি পরিবারকে সঙ্গে থাকার অনুমতিও দেয় না। অফিসের গার্ড বিশ্বাসদা দুপুরে নিজের রান্নার সাথে দুটো মাছ-ভাত চাপিয়ে দেয় শ্যামাকান্তর জন্য। পাতার ছায়ায় দুপুর গড়িয়ে আসে। ঝিমধরা দুপুরে ঘন পাতার আড়ালে একটা দাঁড়কাক কর্কশভাবে ডেকে ওঠে।অজানা আশঙ্কায় মনটা উতলা হয় শ্যামাকান্তের। নীল বর্ডারের সাদা কলাইকরা থালায় ভাত সাজিয়ে বিশ্বাসদা খেতে ডাকে, সাহেব খেয়ে নেন ।
কত দিন মায়ের হাতে পদ্মার ইলিশ ভাপা খাননি শ্যামাকান্ত! লালগোলা থেকে তাদের ভট্টাচার্য্য পাড়ার বাজারে প্রায়ই ইলিশ উঠত।সাদা চকচকে রূপালি মাছ। মাছের গায়ে মশলা মাখিয়ে কলাপাতায় মুড়ে মা ভাতের হাঁড়িতে বসাতেন।সারা বাড়ি গন্ধে ম ম। সব মনে পড়ে তার।
আর একজনের কথা খুব মনে পড়ে!সরমা,তার বউ!বিয়ে করে লাজুক বধূটিকে রেখে আসতে হয়েছে বহরমপুরের বাড়িতেই। বহরমপুর ভট্টাচার্য্য পাড়া থেকে তার বউয়ের চিঠি আসে প্রায় প্রায়ই।কাঁচা হাতের লেখার হরফের পর হরফ সাজিয়ে ভালবাসার ইমারত গড়ে তোলে সে শুধু শ্যামাকান্তের জন্য।
—- কবে তুমি ফিরে আসবে গো? এসো তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। তোমাকে ছাড়া যে আমার কিছুই ভাল লাগে না। বোঝ না তুমি?
তাদের কাস্টমস অফিসে ছুটিছাটা কম। এখানে রবিবারেও ছুটি নেই। কতদিন বাড়ি যাওয়া হয় না শ্যামাকান্তের!
শ্যামলী প্রতিমা,আয়তঘন চোখে কাতর আকুতি স্ত্রী সরমার। স্বামীর জন্য তার নীরব প্রতীক্ষা বড়ই বিস্মিত করে শ্যামাকান্তকে।এই ভবসংসারে যাওয়া আসার নিত্য খেলার মাঝে এক মানবী তার ভালবাসার দ্বারটি খুলে রেখে অপেক্ষা করে আছে তারই জন্যে! তার হৃদয়পাটে এত মূল্য শ্যামাকান্তের!
শ্যামাকান্তের হাতে সময় কম। সকালে পাড়ার মোড়ে একটা গুমটি থেকে চা-বিস্কুট খেয়ে ডিউটিতে বেরিয়ে পড়েন শ্যামাকান্ত। এসপ্ল্যানেড থেকে খিদিরপুর ডক ইলেকট্রিক ট্রামে আধ ঘন্টা।সিটে বসে পড়েন শ্যামাকান্ত।টুংটাং শব্দ করে শহরের বুক চিরে এগিয়ে চলে ট্রাম।নির্জন রাস্তায় সাহেবের হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে সাদা গাউন পরা মেম। গাছের নীচে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে দু’একটি পথচারী।
শ্যামাকান্তের তাড়া থাকে। ইংল্যান্ড থেকে যে জাহাজগুলো আসে যতক্ষণ না সেগুলোর মালপত্তর সার্চ হচ্ছে ,ততক্ষণ সেগুলো জেটিতে ভিড়তে পারবে না।
ফুলশয্যার রাতে কাপড়ের পুঁটলি হয়ে বিছানার এককোণে জড়সড় হয়ে বসেছিল সরমা।মায়ের দেওয়া আংটি সরমার আঙুলে পরিয়ে তাকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন শ্যামাকান্ত।
—কি পছন্দ হয়েছে আংটি?
মাথা হেলিয়ে দিয়েছিল সরমা।
—-আর আমাকে?
সরমা লজ্জায় লাল।
—এত লজ্জা !আমার কাছে!কি বললে না তো আমাকে তোমার পছন্দ হয়েছে কি না ?
সরমা তবুও চুপচাপ।
কপট রাগ দেখান শ্যামাকান্ত।
—-বেশ তবে কালই কলকাতা চলে যাব।
একটা নরম হাত তার ঠোঁট চেপে ধরে।
— না যাবে না।
বিয়ের পর অফিসের কাজে ফেরার দিন বিরহী হৃদয়ের ভারে ভারাক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি।চোখের জলকে বুকের পাঁজরে লুকিয়ে স্বামীকে বিদায় দিয়েছিল সরমা চোখের জলে।ঘরের আয়নার প্রতিবিম্বে দেখা দিয়েছিল তার বেদনার ছবি। বারবার শ্যামাকান্তের মন বলেছিল, ফিরে গিয়ে দুটো কথা বলি।
ট্রেনের তাড়ায় তা আর হয়ে ওঠে নি। বিদায় বেলায় পড়ন্ত রোদ্দুরে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানিয়ে অস্ফুটে সে বলেছিল,কবে আসবে গো? তাড়াতাড়ি আসবে তো?তোমাকে ছেড়ে আমার খুব কষ্ট হবে!
ট্রেন ছেড়ে দিলে প্ল্যাটফর্মের সীমারেখায় হারিয়ে গেল সে। চলতে চলতে পৃথিবীময় তার বেদনার মুখের প্রতিচ্ছবি দেখেছিল শ্যামাকান্ত। এসপ্ল্যানেডের ভাড়া ঘরের শূণ্য বিছানায় শাঁখাপলা পরা নরমদুটি হাতকে খুঁজতেন তিনি রাতের অন্ধকারে। সঙ্গী হারানোর ব্যথায় ভরে যেত তার হৃদয়। শহর জুড়ে রাস্তার উপর লোহার বিমের গ্যাসবাতির পোস্ট।সকালে কর্পোরেশনের যে লোকটি গ্যাসের আলো নিভিয়ে দিতে আসে সে সুর করে গান গায় —
জয় শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য,প্রভু নিত্যানন্দ।
শ্রীঅদ্বৈত গদাধর শ্রীবাসাদি গৌর ভক্তবৃন্দ।।
তার গানের সুর ছড়িয়ে পড়ে নিস্তব্ধ রাস্তায়। শ্যামাকান্ত ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখতেন কলকাতার রাস্তা জল দিয়ে ধুয়ে দেওয়া হচ্ছে।রাস্তার মোড়ে বড় বটগাছটার শাখা-প্রশাখা বেয়ে সকালের হলুদ রোদ নেমে গেছে নীচের রাস্তায়। আর একটা দিনের শুরু।
বহরমপুরে ভট্টাচার্য্য পাড়ার বাড়িতে সরমা হয়তো নুপূর বাজিয়ে এঘর ওঘর করছে!
শ্যামাকান্ত সারাদিন ধরে লুকিয়ে লুকিয়ে কাকে যেন খুঁজে বেরান।
মোড়ের চায়ের দোকান খোলে সকাল ছ’টায়। উনুনের গনগনে আগুনে চায়ের জল ফুটছে। কেটলির গা বেয়ে চা উপচে পড়ে। ভাঁড়ে শ্যামাকান্তের চায়ে ধোঁয়া ওঠে। বিস্কুট দিয়ে চা’টুকু শেষ করে তিনি ভাড়াবাড়ির রাস্তা ধরেন। তার বুকপকেটে সরমার চিঠি। চিঠির ঘঁষা লাগে বুকের পাঁজরে।
কে যেন বলে, তুমি কি বোঝ না তোমাকে দেখতে না পেয়ে আমার কত কষ্ট হচ্ছে!
সারাদিন কাজের ভিড়ে শেষ হয়।দিনের আলোটুকু নিভে যাবার আগে ঘরের সামনের গ্যাস বাতিটা জ্বালিয়ে দিয়ে যায় কলকাতা কর্পোরেশনের একটি লোক।হাল্কা আবছা আলোয় শ্যামাকান্তের মনে হয় কলকাতা শহরের প্রাণ বুঝি নতুন করে জেগে উঠেছে।
স্কুলে পড়ার সময় থেকেই শ্যামাকান্তের নাটক খুব ভাল লাগত। পাড়ায় মাচা বেঁধে কত নাটক করেছে এক কালে। এখন কলকাতায় অনেকগুলো থিয়েটার হলে থিয়েটার চলে। কোন কোনদিন বাসে চেপে স্টার থিয়েটারে ছুটে যান তিনি।টিকিট কেটে থিয়েটার দেখেন। মন কিছুটা শান্ত হয়। কোনদিন বা মহাজাতি সদনে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শুনতে শুনতে বুঁদ হয়ে বসে থাকেন। সঙ্গীতের রেশ মনের মাঝে ঝর্ণাধারার মতো ঝরে পড়ে।
ভোরবেলায় কলকাতা পথে পথে সোনাঝরা রোদ্দুর।গাছ-গাছালির মাথায় মাথায় সোনালি রোদের ঝিকিমিকি।
শ্যামাকান্তের বুক পকেটে ঘোরে সরমার চিঠি।
চিঠির স্পর্শে কে যেন বলে ওঠে, তুমি কি বোঝ না,তোমাকে দেখতে না পেয়ে কান্নায় ভেসে যায় আমার সমস্ত হৃদয়। ”
মনে মনে শ্যামাকান্ত বলে ওঠেন, এতো মুল্য আমার তোমার কাছে, সরমা । তুমি আমায় এতো ভালবাস!
ঘোড়ার গাড়ি চেপে এক সাহেব যাচ্ছে। কোচোয়ান ‘হেই হেই’ শব্দে ঘোড়া হাঁকাচ্ছে। সূর্য কেঁদে উঠল বুঝি কোনো এক নীল পাহাড় চূড়ায়।ঝর্ণার জল খিল খিল করে হেসেই থেমে গেল হঠাৎই। পাহাড়চূড়ায় উপর দিয়ে সাদা বক ট্যা ট্যা ডাক দিয়ে উড়ে গেল আরেক দিকে।মাথার উপর দিয়ে খন্ড খন্ড কয়েকটা মেঘ উড়ে গেল অচিরেই।গায়ে মৃদু বাতাসে কাঁপন ধরিয়েছে বেশ।
সেদিন আর পথে চলতে পারলেন না শ্যামাকান্ত। শরীরটা অবসন্ন হয়ে ওঠে।মাথাটা ভার ভার।গা’টা বেশ গরম। জ্বর জ্বর লাগছে। কুলুঙ্গির পুঁটলি থেকে একটা ট্যাবলেট জল দিয়ে গিলে নেন শ্যামাকান্ত। আজ আর কাজে যেতে পারবেন না তিনি। এই রকম শরীর খারাপ করলে সরমার কথা খুব মনে পড়ে। সে থাকলে বেশ হতো। অসহ্য যন্ত্রনায় মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে শ্যামাকান্তের। বাটির জলে কাপড় ডুবিয়ে কপালে মেলে ধরলে বেশ আরাম লাগত। সারা রাত ধরে ছটফট করতে করতে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি।
স্বপ্ন দেখলেন সরমা কলকাতায় এসেছে। ভোরে কলকাতার রাস্তা ধুয়ে দেওয়া হয়েছে।সেই রাস্তায় আলতা রাঙা পা ফেলে হেঁটে আসছে সরমা।এলোচুল ভিজে কোমরের নিচে ঝুলে পড়েছে।
শ্যামাকান্ত ডাকলেন,এস।তোমার জন্য সারা রাত ধরে জেগে আছি।
তখনও শ্যামাকান্তের হাতের স্পর্শে সরমার চিঠি।
সরমার হাত ধরে ঘরে ফিরে আসেন তিনি।আলো ঝলমল সকালে মনটা খুশী খুশী।
—–কতদিন পর দেখা হল বল?আমি মনে মনে তোমার কথায় ভাবছিলাম।
—-আমাকে মনে পড়ে তোমার?
—— পড়বে না বউ আমার!
ঘুম ভেঙে যায়।শ্যামাকান্ত বোঝেন ভোররাতে আবোল তাবোল ভেবেছেন।তাই স্বপ্ন দেখছেন। বাড়ির জন্য খুব মন খারাপ করছে তার। সরমারও হয়তো খুব মন খারাপ।বেচারা!কাকেই বা সে মনের কথা বলবে!
তার কাঁচা হাতের লেখা চিঠিটাকে তিনি মেলে ধরেছেন চোখের সামনে।
——– তুমি কবে ফিরে আসবে গো ? এসো। ফিরে এসো তাড়াতাড়ি। তোমাকে ছাড়া আমার যে ভাল লাগে না। বোঝ না তুমি!