ধারাবাহিক গল্প / ছবি ব্যানার্জি ইচ্ছে পূরণ

পর্ব-২
প্রায় পাঁচ মাসের আসা যাওয়ায় অবনী কখনও তার মুগ্ধতার কথা,ভালোবাসার কথা একবারও মুখে উচ্চারণ করেনি। অথচ বিথী অবনীর চোখে বহুবার মুগ্ধতা লক্ষ্য করেছে।মেয়েদের চোখ পুরুষের চোখ চিনতে ভুল করে না। অনেকদিন অপেক্ষা করে একদিন অবনীকে জরুরি দরকার বলে তার ঘরে ডেকে আনল।অবনী বলল–কি ব্যাপার এত জরুরি তলব?এই সপ্তাহে আমি একবার বাড়ি যাব ঠিক করেছিলাম।তোমার জরুরি তলব শুনে যাওটা ক্যানসেল করলাম।বলো কি দরকার?

বিথী বলল–আমি কখন থেকে অপেক্ষা করছি।এতক্ষণে আসার সময় হল?অবনী বলল–হুট করে তোমার ঘরে আসা যায়?বিতান দা আর বিপ্লব বেরিয়ে যাওয়ার পর দিভাইকে বলে এলাম। কই বললে না তো কি দরকার?–কেন দরকার ছাড়া আসা যায় না? ভেবেছিলাম কথাটা তুমি আগে বলবে।সবার সামনে সুযোগ পাচ্ছিলে না বলে আমি জরুরি দরকার বলে ডেকেছি। তোমার মুখ থেকে কি শুনতে চাই তুমি জানো না?

অবনী বলল–বিথী আমি আমার কোয়ালিফিকশন বাড়ির অবস্থা সবটা তোমাকে বলেছি।ম্যাথামেটিক্স নিয়ে আমি বি এস সি পাশ করেছি।অনার্সে আশানুরূপ রেজাল্ট করতে পারিনি বলে এম এস সি পড়ার সুযোগ পাইনি।আমি যে কোম্পানিতে চাকরি করি সেটা একটা মাঝারি কোম্পানি।অভিজ্ঞতার জন্য আমি ওটাতেই জয়েন করেছি।স্যালারি চল্লিশ হাজার।ইচ্ছে আছে বেটার চান্স পেলে আরো নামি কোম্পানিতে জয়েন করব।তোমার প্রতি আমি দুর্বল হলেও নিজের লিমিটেশনটা আমি বুঝি।সত্যি বলতে তোমাকে ভালোবাসা জানানোর স্পর্ধা আমার নেই।এক কথায় আমি তোমার যোগ্য নই।ভবিষ্যতে যদি কখনও তোমার যোগ্য হতে পারি তখন আমার মনের ইচ্ছা তোমাকে জানাব ভেবেছিলাম। আমাদের দুজনেরই এখন কেরিয়ার নিয়ে চিন্তা করা উচিত। এই মুহূর্তে আমি শুধু তোমার বন্ধুত্ব চাই।

বিথী বলল– আমার যথেষ্ট বুদ্ধি আছে।আমি তোমার উপদেশ শুনব বলে তোমাকে ডাকিনি।শুধু বন্ধুত্ব হলে তুমি আমার প্রতি দুর্বল হতে না অবন।কলেজে আমার অনেক ছেলে বন্ধু আছে।কই কখনও তো তাদের কারোর প্রতি আমি দুর্বল হইনি। আমি তোমার সবটা জেনেই তোমাকে ভালোবেসেছি।আমি জানি তুমিও আমাকে ভালোবাসো।শুধু সাহস করে বলতে পারছ না।আর আমার কেরিয়ার নিয়ে ভাবছি না কে বলল।আমার কেরিয়ার নিয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল আমি।আমি স্বাবলম্বী হয়ে বিয়ের কথা ভাবব।ততদিনে তুমিও নিশ্চয়ই তোমার কেরিয়ার গুছিয়ে নিতে পারবে।যদিও তোমার গুছিয়ে নেওয়ার কিছু নেই।তুমি তো অল রেডি একটা জব করছ।আমারই বরং প্রতিষ্ঠিত হতে অনেক দেরি। আমি তোমার মধ্যেই আমার পছন্দের পুরুষকে খুঁজে পেয়েছি।আমি তোমাকে ভালোবাসি অবন।আর আমি শুধু তোমার জন্যই অপেক্ষা করব।আমি এটাও নিশ্চিত জানি আমার বাবা আমার পছন্দকে গুরুত্ব দেবে।

অবনী বলল–তুমি সব ভেবে বলছ?আমি কিন্তু চেষ্টা করলেও কোনো উঁচু পোস্টে সরকারি চাকরি পাব না।বি এড টাও করা নেই।তাই স্কুলের চাকরিও পাব না। আমার পারিবারিক অবস্থা তোমাদের মতো নয়।আমার বাবা একজন স্কুল শিক্ষক। বাবার চাকরিও আর বেশিদিন নেই।কয়েক বিঘে জমি আর শরিকি বাড়ি ছাড়া আমাদের কিছু নেই। সেই বাড়িটাও টুকরো টুকরো হয়ে নেহাত একটা মাথা গোঁজার ছোট্ট অংশ থাকবে। তাই বলছি এখন এসব কথা থাক ।ভবিষ্যতে আমি হয়তো বেটার কিছু নাও পেতে পারি।এখন থেকে কমিটমেন্ট করে কি লাভ?জীবনে চলার পথে অল্প বয়সে অনেক ভালোলাগা,ভালোবাসা মনকে ছুঁয়ে যায়।সেই লাগামছাড়া আবেগটা পরিণত বয়সে থাকে না।তাই সেই ভালোবাসা বেশিরভাগই বিয়ে পর্যন্ত পরিণতি পায় না। তখন বাস্তব নিয়েই সবাই ভাবে। ভবিষ্যতে আমার চেয়েও অনেক যোগ্য লাইফ পার্টনার তুমি পাবে।তুমি নিজে না পেলে তোমার বাবা মা তোমার উপযুক্ত জীবনসঙ্গী খুঁজে দেবেন।

বিথী বলল– তুমি আমাদের বাড়িটা দেখে আমাদের ধনী পরিবার ভেবো না।আমদের ও চাকুরিজীবি মধ্যবিত্ত পরিবার।আমাদের বিরাট বাড়িটা দাদুর করা।বাবা শুধু দোতলাটা করেছে।তাও একবারে নয়। প্রায় তিন বছর লেগেছিল দোতলা আর পুরো বাড়িটা রিপেয়ারিং করতে।তুমি কিন্তু এখনও আমার কথার উত্তর দিলে না।আমি কিন্তু বাচ্চা মেয়ে নই। আমাদের ভালোবাসার পরিণতি ভবিষ্যতে সারাজীবন তোমার সংগে একসংগে পথচলা।

অবনী বলল–আজ অনেক দেরি হয়ে গেছে বিথী।তাছাড়া আমি অনেকক্ষণ তোমার ঘরে এসেছি।তোমার মা কিছু মনে করতে পারেন।

বিথী বলল– তুমি আমার কথাটা এড়িয়ে যাচ্ছ কেন বলো তো? তাহলে কি বুঝব তুমি এতদিন আমার সংগে টাইম পাস করেছো?–তুমি এটা বলতে পারলে?আমি আজ তোমার ডাকে প্রথম তোমার ঘরে এসে শুধু দুজনে সময় কাটালাম।এতদিন তো আমি তোমাদের সবার সংগে একতলার ঘরে গল্প করতাম। টাইম পাস তো আমি সবার সংগে করেছি।আমি কক্ষনো তোমার সংগে সিনেমা দেখা বা পর্দাঘেরা রেস্টুরেন্টে যাওয়ার প্রস্তাব দিইনি।হাতে গোনা দু তিনবার রেস্টুরেন্টে গেলেও দিভাই আর বিতান দার সংগে তুমি আমি ছিলাম। আমি কলেজ লাইফে ছেলে বন্ধু মেয়ে বন্ধুদের সাথে গল্প করেছি আড্ডা মেরেছি।কিন্তু কোনো পার্টিকুলার মেয়ের সংগে টাইম পাশ করার কথা ভাবিনি।এটা তোমাদের কলকাতা কালচার।আমাদের মফঃস্বলে এটা খুব কম হয়।বিশেষ করে আমার মতো পরিবারের ছেলেদের তো নয়ই।আসলে ছোটোবেলা থেকে আমি মূল্যবোধে বিশ্বাসী।তোমার প্রতি আমার অনুভূতি নিজের মধ্যে রেখেছিলাম।এখনই প্রকাশ করতে তুমি জোর করবে ভাবিনি।আমি বুঝতে পারছি তুমি মনে হয় স্কুল লাইফ থেকে বহু ছেলের স্তুতি পেয়ে অভ্যস্ত।তাদের হয়তো তুমি নেগলেক্ট করেছো ইগনোর করেছো।কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তুমি নিজে মুখ ফুটে ভালোবাসার কথা বলার পর আশা করেছিলে আমি কৃতার্থ হয়ে হামলে পড়ব।তাই তুমি রেগে গিয়ে মিথ্যে আমার ওপর অভিযোগ করছ।আমি নিজের সম্পর্কে সৎ থাকতে চাই বলে বাস্তবটা শুধু বলেছিলাম।

বিথী বলল–সরি অবন।আমি এতসব মিন করে বলিনি।অবনী বলল– বিথী আমিও তোমাকে সরি বলছি।এতটা রেগে যাওয়া আমার উচিত হয় নি। আমি তোমার স্বাবলম্বী হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করব।নিজেও তোমার যোগ্য হওয়ার জন্য চেষ্টা করব।বিথী বলল–সামনের রবিবার আসছ তো?–না সামনের শনিবার বাড়ি যাব।আমি এবার উঠলাম।

নীচে নামতেই শ্রাবণী বলল–চা কফি কিছু খাবি?অবনী বলল–না দিভাই। আজ আমি আসছি।আমার এক বন্ধুর বাড়িতে নেমন্তন্ন আছে।আর সামনে শনিবার একবার বাড়ি যাব।–ঠিক আছে তাহলে আয়।

ফ্ল্যাটে ঢুকেই গ্রাম থেকে বাবার ফোন।ফোনটা রিসিভ করে অবনী বলল–বাবা আমি শুক্রবার রাতের ট্রেন ধরে শনিবার ভোরে বাড়ি যাব।হিমাংশু বাবু বললেন–অনেকদিন বাড়ি আসিস নি বলে তোর মা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।আমারও তোর সংগে কিছু কথা আছে টুবাই।অবনী বলল–কি কথা বাবা?কোনো দরকারী কথা?–তেমন দরকারি নয়।তুই এলে বলব।

অবনী আকাশ পাতাল ভাবতে বসল।বাবা কি তাহলে জুঁইয়ের সঙ্গে তার বিয়েটা ফাইনাল করতে চায়।জুঁই বাবার সহকর্মী বন্ধুর মেয়ে।তার এবার বাংলা অনার্সের ফাইনাল ইয়ার। একটাই মেয়ে।জুঁইকে অপছন্দ করার কোনো কারণই নেই। ফর্সা ছিপছিপে চেহারার জুঁইকে একনজরে যে কেউ পছন্দ করবে।এই বাড়িতে অনেকবার সে এসেছে।ছোট থেকেই তার সংগে তুই তরকারি করে কথা বলে সে অভ্যস্ত। তার সংগে বিয়ের কথা বা অন্য সম্পর্কের কথা কখনও তার মাথাতেই আসেনি। মামুলি গল্প ছাড়া তেমন কোনো কথাও হয় নি।তার বাবা ছেলের সংগে বাবার বন্ধু কন্যাটির বিয়ের আলোচনা দু একবার বাবা মার নিভৃতে আলোচনার সময় খুব সামান্য তার কানে এসেছে।অবশ্য বাবা কোনদিন সরাসরি তাকে এখনও তার ইচ্ছার কথা বলেনি।এখন চাকরি পাওয়ার পর বলতে পারে বলে তার ধারণা।হয়তো দুই পক্ষই রিটায়ার করার আগে বিয়েটা ফাইনাল করতে চায়।এছাড়া বাবার আর কি দরকার থাকতে পারে?

বাবা এই প্রস্তাব দিলে সে কি করবে?এখন বিয়ের কথা ভাবার তার ইচ্ছে
নেই।এটা বলেও কি সে এড়াতে পারবে?বাবা তো বলতেই পারে বিয়েটা ভবিষ্যতে করবে এটার প্রতিশ্রুতি পেলেই চলবে।কিন্তু এই প্রতিশ্রুতিও তো এই মুহুর্তে সে দিতে পারবে না।

বিথীর আকর্ষণ এড়ানো তার পক্ষে কঠিন।প্রথম দেখাতেই বিথীকে তার ভালো লেগেছিল।দিনে দিনে মুগ্ধতা বেড়েছিল।বিথীর দিক থেকে কোনো সারা না পেলে হয়তো সে নিজেকে গুটিয়ে নিত।কিন্তু বিথী নিজে তার ভালোবাসার কথা বলেছে।একসংগে বাকি জীবন থাকার অঙ্গীকার করেছে।তার জীবনের প্রথম ভালোবাসাকে সে কিছুতেই অস্বীকার করতে পারবে না।

ক্রমশ–

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *