আত্মজা
সুদেষ্ণা সিনহা
ধারাবাহিক উপন্যাস
অধ্যায় -৩
বহরমপুরের ভট্টাচার্য্য পাড়ায় স্বাধীনতাদের বাড়িটা সবচেয়ে প্রাচীন। তার বাবা শ্যামাকান্ত ভট্টাচার্য সে যুগে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট ছিলেন ।শ্যামাকান্তকে নিয়ে পিতা কৃষ্ণকান্তের অনেক স্বপ্ন ছিল।বাংলা অনার্স পড়ার জন্য ছেলেকে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি করান তিনি। গ্রাজুয়েট হবার পর শ্যামাকান্ত কালো গ্রাউন আর কালো টুপি পরে সার্টিফিকেট হাতে কলেজ চত্বরে দাঁড়িয়েই একটি ছবি তুলেছিলেন। সেই ছবি বাঁধিয়ে ঘরের দেওয়ালে টাঙিয়ে রেখেছিলেন পিতা। স্বাধীনতার বাবার সেই ছবি অবিকৃতভাবে এখনও টাঙানো আছে সেই একই জায়গাতে।
শ্যামাকান্ত কলকাতা থেকে ট্রেনে করে বহরমপুরে ফিরলে তাঁদের চন্ডীমন্ডপে বহরমপুর ও আশেপাশের গ্রামের লোকরা ভিড় করেছিল বহরমপুরের প্রথম গ্রাজুয়েটকে দেখতে।
শ্যামাকান্তের পিতা কৃষ্ণকান্ত মনেপ্রাণে সেই যুগের আর পাঁচজন বাঙালীর মতো ছিলেন না। সাধারণ লোকদের মতো হলে হয়তো শুধু বেঁচে থাকার চিন্তা আর পেটে দু’মুঠো ভাত, এতেই সন্তুষ্ট থাকতেন তিনি।কিন্তু সারা জীবন ধরে কৃষ্ণকান্ত বাঁচতে চেয়েছিলেন মাথা উঁচু করে, মানুষের মতো মানুষ হয়ে।
বহরমপুরের কাছেই গ্রামের দিকে কৃষ্ণকান্তদের প্রচুর জমিজমা ছিল। সে সময় যাদের জমিজমা থাকত তারা চাষবাস করেই দিনাতিপাত করত।আর যাদের জমি থাকত না ,তারা ছোটখাট ব্যবসা-বাণিজ্য করে পেটের ভাত জোগাড় করত।কৃষ্ণকান্তের বাবার যা জমিজমা ছিল,তাতে লোক দিয়ে চাষবাস করে দিব্যি জীবন কাটানো যেত। অন্য লোক হলে বোধহয় তাইই করত। কিন্তু কৃষ্ণকান্ত নিস্তরঙ্গ জীবন যাপন একদম পছন্দ করতেন না। তিনি স্বপ্ন দেখতেন বিত্তশালী মানুষ হয়ে সমাজে স্থান পেতে।
সুযোগ এসে গেল। স্ত্রী বিধুরাণীর বাবা জামাই বাবাজীবনের নামে ইষ্ট ইন্ডিয়া চা কোম্পানির কাছ থেকে বেশ কিছু শেয়ার কিনে দিয়েছিলেন। শেয়ার বেচাকেনার ব্যবসায় তখনকার বাঙালীদের তেমন উৎসাহ না থাকলেও কৃষ্ণকান্ত বেশ মন দিয়ে এই ব্যবসা করতেন । ফলে শেয়ার বেচাকেনার ব্যবসায় তিনি ক্রমশঃ পারদর্শী হয়ে উঠলেন। চা কোম্পানীর পরে তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কাছে বাটা কোম্পানীর শেয়ারও কিনে নিয়েছিলেন।শ্বশুরের উপস্থিত বুদ্ধির জোরে কৃষ্ণকান্ত বিত্তবান হয়ে উঠছিলেন ধীরে ধীরে। সমাজের বিত্তশালীদের সাথে তাঁর ওঠাবসা। ঠাকুর,চাকর রেখে উচ্চবিত্তদের মতো জীবনযাপন করতেন তাঁর পরিবার।
সেই সময় বিধুরাণী থাকতেন বহরমপুরের কাছে ভরতপুরে কৃষ্ণকান্তদের গ্রামের বাড়িতে।
তিনি স্বামীর কাছে আব্দার করেছিলেন,বহরমপুরে একটা বাড়ি করো না গো!কৃষ্ণকান্ত কোন উত্তর দেননি সে সময়।
কৃষ্ণকান্তের বাবা-মা গ্রামের মানুষ।পৈত্রিক ভিটা ছেড়ে তারা বহরমপুরে আসতে চাননি! বাবা-মায়ের জীবদ্দশায় তাই কৃষ্ণকান্তের বহরমপুরে বাড়ি করা সম্ভব হয়নি।তারা মারা গেলে গ্রামের সম্পত্তি বিক্রি করে কৃষ্ণকান্ত বহরমপুরে বিঘা দুই জমি কেনেন। বিধুরাণীর ইচ্ছাতে সেখানে তিনতলা বাসগৃহ তৈরি হয়। পাশেই চন্ডীমন্ডপ। হিন্দু দেবদেবীর সব পুজোয় সেখানে হতো। আশ্বিন মাসে সেখানে দেবী দুর্গার আরাধনা হতো। বিসর্জনের পর পুকুরে ডুবিয়ে রাখা হতো দুর্গার কাঠামো।সপ্তাহ দুই পরে চন্ডীমন্ডপে পুজো হতো লক্ষ্মীদেবীর।লক্ষ্মীর পরই কার্ত্তিক মাসের অমাবস্যায় মহাকালির আবাহন।
পাশেই পুকুর,পুকুরে মাছের চাষ। বর্ষার শুরুতে লোক দিয়ে মাছের চাষ করাতেন কৃষ্ণকান্ত ।বাকিটা জমিতে বাগান। সামনের দিকে ফুলের বাগান,বাহারি মরসুমি ফুলের চাষ হতো সেখানে।শীতকালে গাঁদা,চন্দ্রমল্লিকা,ডালিয়া,নানা রঙের সমাবেশ।বর্ষাকালে বেলি,রজনীগন্ধার মিস্টি গন্ধে চারিদিক মম করত।বাগানের পিছন দিকে আম,লিচু,কাঁঠাল,নারকেল,সবেদা– ফলের সাজানো বাগান।শেয়ারের ব্যবসার কাজে প্রায় প্রায়ই কলকাতা যেতে হতো কৃষ্ণকান্তকে ।ঠাকুর,চাকর এবং একমাত্র ছেলেকে নিয়ে বিধুরাণী থাকতেন বহরমপুরের বাড়িতে। মাঝে মাঝে স্বামীর সঙ্গে কলকাতা যেতেন তিনি।কয়েকদিন থেকে আবার ফিরে আসতেন বহরমপুরে।
ছোট থেকেই পুত্র শ্যামাকান্ত পড়াশোনাই মেধাবী। গ্রামের পাঠশালার মাস্টারমশাই কৃষ্ণকান্তকে ডেকে বলেছিলেন,দেখো, তোমার ছেলে জজ,ম্যাজিস্ট্রেট হবে। ওর পড়াশোনার দিকে লক্ষ্য রেখো ,কৃষ্ণ।
পুত্রের জন্য মনে মনে গর্ব অনুভব করতেন পিতা কৃষ্ণকান্ত।তিনি ছিলেন উচ্চাকাক্ষী। বহরমপুর থেকে স্কুল ফাইনাল ও এইচ .এস পাশ করলেও স্ত্রী বিধুরাণীর ইচ্ছাতে কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে ছেলেকে ভর্তি করে দেন কৃষ্ণকান্ত।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এদেশে এসেছিল ব্যবসা করতে।কিন্তু নবাবদের দুর্বলতার সুযোগে অতি সহজে রাজ্যপাট দখল করে নিল তারা।ইংরাজ সরকার সেইসময় অর্ধ শতবর্ষের সাম্রাজ্য সামলাতে জেরবার হয়ে পড়ছে। নতুন নতুন অফিস খুলছে চারিদিকে।সে সব নতুন অফিস চালানোর জন্য নতুন লোক চায়।কিন্তু এত লোক কোথায়!ইংল্যান্ড থেকে এতো লোক আনা কি সম্ভব! সুতরাং দেশের লোকের দিকেই দৃষ্টি। বাঙালী মেধার সন্ধান চাই! কোম্পানি চালানোর উপযোগী মেধা চাই! ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর চোখ সেই সুযোগ্য বাঙালী মেধার দিকে। খোঁজাখুঁজি চলছে ক্রমশঃ।
ঠিক এই সময় এক দুঁদে ইংরাজ অফিসারের চোখ পড়েছিল শ্যামাকান্তের উপর। তখন প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র সে।পড়াশোনায় তুখোড়,অনর্গল ইংরাজিতে কথা বলে!এইরকম চটপটে লোকই দরকার তাদের কোম্পানীর জন্য।
উইলিয়াম বার্কস ছিলেন ইনডেন কাস্টমস লাইন অফিসের সবচেয়ে সিনিয়র কর্তা। জাহাজে যে সব জিনিস ইংল্যান্ড বা অন্যান্য যে কোন জায়গা থেকে আমদানি হয় সেই সব জিনিসের উপর চিরুনী তল্লাশী চালাতে হয় । পুনঃপুন পরীক্ষার পর তবেই জাহাজগুলোকে নোংড় ফেলার অনুমতি দেওয়া হতো। বার্কসের হেফাজতে থাকা কাস্টমস অফিসগুলোতে এলাকাভিত্তিক একজন করে সুপারিন্টেনডেন্টের প্রয়োজন ছিল। এই সব কাস্টমস অফিসারদের হতে হবে সৎ,সাহসী ও দক্ষ। মূল কাজ করবে এই সুপারিন্টেনডেন্টরাই।বছরে তিনবার অতর্কিতভাবে ভিজিট করে বার্কস শুধু দেখে নেবেন জাহাজগুলোর উপর ঠিকঠাক নজরদারি হচ্ছে কিনা।
বার্কস একরকম ডেকে হেঁকেই শ্যামাকান্তকে ইনডেন কাস্টমস লাইন অফিসের সুপারিন্টেনডেন্টের চাকরি দিয়েছিলেন। ছেলেটিকে তার খুব পছন্দ। ছেলেটি এই কাজের উপযুক্ত এবং দক্ষ। ইংরাজিতে তার প্রগাঢ় জ্ঞান। নিখুঁত সাহেবী উচ্চারণে ইংরাজী বলতেও পারে গড়গড় করে। মোটা ভুরু,চওড়া গোঁফ আর মাইনাস পাওয়ারের মোটা চশমায় শ্যামাকান্ত দাপুটে অফিসার হলে,লোকে ভয়ও করবে তাকে।
কাজটা মোটেও সহজ নয়।প্রতিদিন ত্রিশ মাইলের মধ্যে একশ লোকের উপর নজরদারি রাখতে হবে।কোন ছুটিছাটা নেই। এই সব লোক পরিবারে বেশী আসক্ত হলে কাজেকামে অসুবিধা হবে।তাই ছেলে বাড়িও আসতে পারবে না ঘন ঘন। একমাত্র ছেলেকে কাছছাড়া করতে একটুও ইচ্ছা ছিল না বিধুরাণীর। ছেলের চাকরির ব্যাপারে তার আপত্তির কথা তিনি সরাসরি তার স্বামীকে জানিয়েছিলেন।
কৃষ্ণকান্ত রেগে গিয়ে বিধুরাণীকে চরম অপমান করেন, তুমি হলে বারো হাত কাপড়ে জড়ানো একটা গোবর গণেশ।মেয়েমানুষদের আর কবে বুদ্ধি হবে! তুমি মা হয়ে ছেলেকে আঁচলে বেঁধে রাখবে চিরদিন?ছেলের ভালোমন্দের কথা ভাববে না একবারও?মাথা খুঁড়লেও এই চাকরি লোকে পায় না,জান!ছেলের কত বেতন হবে জানো? মাসে পাঁচ টাকা।
বিধুরাণী জানেন এ মানুষ কোনদিন টাকাপয়সা,ধনদৌলত ছাড়া আর কিছু ভাববে না। এই মানুষের হাতে পড়ে তার সারাজীবনটা নষ্ট হয়ে গেল।
গোপনে চোখের জল মুছেন বিধুরাণী। তিনি জানেন কৃষ্ণকান্তের কথার নড়চড় হবে না কোনদিন।