সীমান্ত # পর্ব – ২
কলমে – অরণ্যানী
ঝিনুক (মিনুর দিদি) – এই মিনু, জামাকাপড়গুলো ঘাট থেকে কেচে আনতে হবে।
– এতো রোদ – – – এখন আমি পারব না।
-– আর দু’দিন পর আমার বিয়ে হয়ে গেলে তখন ঘরের কাজ কে করে দেখব।
– চলেই তো যাবি। দেখবি কী করে?
– তুই কোনো কাজই করবি না? এতো বড় হয়েছিস, শুধু এদিক ওদিক ঘুরেই বেড়াবি?
ঝিনুক রাগ দেখিয়ে হনহন করে বালতি সহ গেট দিয়ে চলে গেল। মিনুর মা ঘর থেকে দাওয়ায় বেরিয়ে এলো।
মা — ঝিনুক, ভাত বাড়ছি। মিনুও তো এখানে আছিস, খাবি আয়।
ঝিনুক – দাঁড়াও, অনেক ছাড়া জামাকাপড় আছে। আগে কেচে আসি।
মা – বেলা যে অনেক হলো। তাহলে আমি তোর বাবাকে আর দাদাকে দিতে থাকি? তুই আয় ততক্ষণ। মিনু কী করবি?
ঝিনুক ঘাটের দিকে এগিয়ে গেল। মিনু কোনো উত্তর না দিয়ে দিদির পেছনে এলো। ঝিনুক নদীর ঘাটে নেমে, বালতিতে সাবান জল গুলে তাতে জামাকাপড় ভেজালো। তারপর একটা দুটো করে নিয়ে ঘাটের চাতালে পটু হাতে দ্রুত কাচতে লাগলো। দেখাদেখি মিনুও তার অপটু হাতে কাচতে লাগলো। তা দেখে ঝিনুক একটু ব্যঙ্গ করে হাসল।
ঝিনুক –- থাক্, তুই রাখ। আর কিছুদিন পর তোকেও তো বিয়ে করতে হবে। তখন কী করবি? কিছুই তো কাজ পারিস না।
মিনু – তো? কী করব? সেইজন্যই তো করছি।
কাচা সেরে দুই বোন নদীতে নামল স্নান করতে। বর্ষার শেষে নদী কুলে কুলে ভরা। বর্ষায় হয়তো কিছুটা কুল ছাপিয়েও ছিল। এখন জল সরে গেছে। তার চিহ্ন রেখে গেছে। ঘাটের চাতালে কোথাও কোথাও শেওলা ধরেছে। এই নদীর ওপারে ঘন জঙ্গল। আর সেখানেই দেশের সীমান্ত। সীমান্ত পার হলে আবার জঙ্গল। তারপর ভিন দেশের গ্রাম। কেমন তা কেউ জানে না। আগেকার মানুষরা জানে। তারা দেশ ভাগ হওয়ার আগে ওই দেশে যাওয়া আসা করত। এখন সব সময় সীমান্তে প্রহরীর সজাগ পাহারা।
নদীর এপারের জঙ্গল তেমন ঘন না হলেও ঝোপ জঙ্গল আছে। নারকেল, তাল, সুপারী, দেবদারু, জামরুল, পেয়ারা এসব নানান ফলের গাছ, কোথাও কোথাও বাঁশ ঝাড়। ফলে নদীর এপার ওপার দুপারই ছায়ায় ঢাকা। নদী খুব চওড়া না হলেও যথেষ্ট ভালো সাঁতার জানলে তবেই সাঁতরে পার হওয়া যায়। ওপারে ঘন জঙ্গল থাকায় সাধারণত কেউ সাঁতরে ওপার যায় না। তবে ডানপিটে ছেলেরা জলে নামলে মাঝে মাঝে নদী এপার ওপার করে। এ গ্রামে খেয়ার ঘাট নেই। পাশের গ্রামে আছে। পাশের গ্রামে ওপারে যাওয়ার সাঁকোও আছে।
নদীর এপারের জঙ্গলে শিয়াল, খটাস, ভাম, বেজি, বনবিড়াল, হায়না, বুনো শুয়োর, খরগোশ ইত্যাদি জন্তুর বাস। আর ওপারের জঙ্গলে এগুলো তো আছেই, তার সঙ্গে হাতির পাল, ভাল্লুক, হরিণ ইত্যাদিও দেখা যায়। আর দুপারের জঙ্গলেই আছে নানান রং বে রংয়ের পাখি। তাই ভোরে সূর্যের আলো ফোটার সাথে সাথে আর বিকেলে সূর্যের আলো পড়ে এলে শোনা যায় পাখির কলোরব।
লোকালয় নদীর থেকে একটু উঁচু জমিতে। তাই বন্যা সাধারণত হয় না। তবে কোনো বছর খুব বৃষ্টি হলে বন্যাও হয়। প্রত্যেক পাড়ায় পাড়ায় নদীর ঘাট আছে। কোন ঘাট সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো, কোনটা বা মাটির। কোনো কোনো বাঁধানো ঘাট অনেক পুরনো। ফলে ভেঙে চুরে গেছে। কোনটা এখন আর ব্যবহারই হয়তো হয় না। ঘাটের ধারে নানান গাছ থাকে। সেই গাছের নামে ঘাটের নামকরণ হয়। যেমন – বকুল তলার ঘাট, পলাশ তলার ঘাট, বট তলার ঘাট ইত্যাদি। যে ঘাটে মিনুরা স্নান করতে এসেছে, সেটি বটতলার ঘাট। ঘাটের চারপাশে কিছু বট গাছ আছে। নদীতে কিছু জলজ ফুল ফুটে আছে। আরও নানা জলজ উদ্ভিদ নদীতে ভাসছে। বুনো হাঁস সাঁতার দিচ্ছে। জলজ উদ্ভিদের উপর বসে আছে পানকৌড়ি, ডাক পাখি।
মিনু সাঁতার কাটতে কাটতে একটা ফুলের দিকে এগোল। ঝিনুকও একটু সাঁতার দিল।
ঝিনুক – মিনু চল্, বেলা অনেক হলো। খিদে পাচ্ছে। ঝিনুক ঘাটে উঠে এলো। মিনু সাঁতরে এগোতেই হাঁসগুলো দ্রুত দূরে সরে গেল। পানকৌড়ি, ডাক পাখি উড়ে গেল। মিনু সাঁতার কাটতে কাটতে তাকিয়ে দেখল। ফুলের কাছে গিয়ে মিনু ফুলের পাপড়ি স্পর্শ করলো। মুখ চোখ আনন্দিত হয়ে উঠল। হাতের আঁচলায় জল ভরে পাতায় ঢাললো। মুহূর্তে জল গড়িয়ে পড়ে গেল। পাতায় হাত বুলিয়ে তার মসৃণতা অনুভব করলো। তারপর সাঁতরে ঘাটে চলে এলো। ঝিনুক ততক্ষণে জামা কাপড়ের বালতি নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিয়েছে। ঝিনুকের বুকের আঁচল একটু সরে গেছে। মিনু একটু দৌড়ে এসে ঝিনুককে ধরে ফেললো। মিনুর চোখ পড়ল দিদির দিকে। মিনুর একটু লজ্জা করল।
— দিদি, তোর সামনের আঁচল ঠিক কর।
ঝিনুক হাত দিয়ে টেনে ঠিক করে নিল। মিনু ভিজে জামার উপর দিয়ে নিজের স্তনের দিকে তাকালো। চোখে মুখে অস্বস্তি ফুটে উঠল। ওরা দ্রুত বাড়ির দিকে চললো।
(ক্রমশ)