রক্ত মাখা ইতিহাসের ডকুমেন্ট
দুলাল কাটারী
ইতিহাস যদি কোনো পরিস্থিতিকে ক্ষমা না করে থাকে তবে তার জন্য যে ভবিষ্যৎ ডকুমেন্ট তৈরি হবে তাতে রক্তের দাগ লেগে থাকার সম্ভবনাই অনেক বেশি। ভারতীয় উপমহাদেশের এমনই একটি ক্ষমাহীন ইতিহাস হলো দেশ ভাগ ও শরনার্থী সমস্যা। ভারত বা পৃথিবীর কোনো দেশই চাইলেও পারবে না উদবাস্তুদের কে ঝেড়ে ফেলে একটি পূন্যের গঙ্গা স্নান সেরে আসতে। কারণ এটা আন্তর্জাতিক আইন বিরোধী সিদ্ধান্ত।
তারও আগে জানতে হবে শরনার্থী কারা?এ প্রশ্নে উত্তর দিতে গেলে দেশ ভাগের সময় গান্ধী পন্থী, আলি জিন্না পন্থী, এবং আবুল কালাম আজাদ পন্থী ব্যক্তিদের কথা এসে যায়। কারণ আলি জিন্না যেমন দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগে অনড় থেকেছেন ঠিক তেমনই কালাম পন্থী মুসলিমরা কিন্তু দেশ ভাগ করার বিরুদ্ধে ছিলেন। তাই তারা কিন্তু ভারতেই থেকে যায়।
★তার চেয়ে ও বড়ো কথা হলো কোটি কোটি মানুষই ছিল তখন প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে দুরে।তার মধ্যে মুসলিমদেরও থাকার সম্ভবনা কেউই উড়িয়ে দিতে পারবে না।সুতরাং কালাম পন্থী মুসলিম বাদেও একটা বিশাল সংখ্যার মুসলিম এদেশে ছিলো,আছে এবং থাকবেও ভবিষ্যতে এবং তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারনের দায়িত্ব ভারত সরকারকে নিতেই হবে। তারা প্রকৃত ভারতীয় মুসলিম এবং ভারতীয় সংস্কৃতির সর্ব অংশে তারা মিলেমিশে আছে এটা মানতেই হবে। তাই এদেশ হিন্দুর দেশ বা এদেশ মুসলিম দেশ বলে যারা চিৎকার করছে তাদের ইতিহাস সম্পর্কে অবগত হওয়া দরকার। এদেশ হিন্দু মুসলিম উভয়ের দেশ এটাই জীবনের প্রথম থেকে শুনে আসছি। দেশ ভাগের ক্ষেত্রে আলি জিন্না কে একতরফা দোষারোপ করা ঠিক হবে না তার কারণে বলা যায় জাতীয় কংগ্রেসও সেদিন মুসলিম লিগকে যথেষ্ট আপন করে নেওয়ার মানসিকতা অনুভব করে নি। যাইহোক এবিষয়ে সকলেরই কমবেশি জানা আছে ধরে নিয়ে এগিয়ে চলা যাক না হলে আমার এই খুদে জীবনের প্রায় অর্ধেক সময় শেষ হয়ে যাবে শুধু মাত্র ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবকটি চরিত্র ও ঘটনা বিশ্লেষণ করতে গেলে। পাঠক নিশ্চয়ই এটুকু পড়েই বুঝতে পারছেন আমি যেদিকে যেতে চাইছি তা হলো NRC,CAA ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে আপনি যদি ভাবেন আপনার সকল প্রশ্নের সঠিকভাবে উত্তর দিতে পারবো তাহলে এখনি পড়া বন্ধ করে দিয়ে অন্য কোনো বিষয়ে মননিবেশ করুন। যে বিষয়টি একটি দেশের সকল রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্বের এবং সকল আমজনতার কাছে একটা প্রশ্নের বিষয় সেটা আমি এক কথায় সমাধান করে দেবো এরকম না ভাবাই ভালো। তবু একটু আসুন না দেখি আলোচন করে বিষয়টি কি?
আমাদের সকলেরই মনে রাখা উচিৎ যে, সকল ভালো সিদ্ধান্ত কিন্তু একটি আলোচনা সভা থেকেই উঠে আসে।
যাইহোক দেশ ভাগ হয়ে গেল। এটাকে দেশ ভাগ না বলে কয়েকটি রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্বের জায়গা ভাগ বলাটাই মনে হয় বেশি যুক্তিসম্মত। কারণ কোটি কোটি লোক ঠিক আজকের মতোই রাজনৈতিক চেতনা হীন ছিল। আজকে 4G,5G এর যুগেও মানুষ রাজনৈতিক চেতনা হীন আর সেদিন তো আরো অনেক জটিল ও কঠিন অবস্থা ছিল। জনগণ হয়তো এটা বুঝতে পেরেছিল যে তারা এক বৈদেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মগ্ন এবং এরা চলে গেলেই স্বাধীনতার একটা স্বাদ পাওয়া যাবে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় অন্য আরেক। ততক্ষণে হিন্দু -মুসলিম দের কে ইংরেজ সরকার দুটি পৃথক বারুদের স্তুপে পরিনত করতে সক্ষম হয়েছে। এবং মাঝে মধ্যে দুএকবার অগ্নি সংযোগ ও করেছে এই বারুদ স্তুপে। সমালোচকরা এক্ষুনি বলে বসবেন তাহলে কি এর আগে হিন্দু-মুসলিম বিবাদ ছিলো না? আমি বলবো ছিল তবে সেই বিবাদের কারন আজকের শরনার্থী সৃষ্টির জন্য দায়ী ছিল না।বা দেশ ভাগ করে নিয়ে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠা স্থাপনের মতো একগুঁয়েমি মনোভাব দেখা যায় নি তখন।
সুতরাং বিভাগের ফলে ভারত মূলত দুটি খন্ড হলো এবং কিছু দেশীয় রাজ্যও ছিল, সেগুলোকে বলা হয়ে ছিল তারা নিজেদের ইচ্ছে মতো যোগদান করতে পারে যেকোনো একটি ডোমিনিয়নে, এখান থেকেই কাশ্মীর সমস্যার সৃষ্টি হয়ে ছিল। কিন্তু আজকের আলোচনার বিষয় যেহেতু এটি নয় তাই আপাতত এবিষয়ে আলোচনা এখানেই সীমিত থাক। এরকম আরও অনেক সমস্যা নিয়েই এগিয়ে চলছে ভারতীয় সংবিধান ও শাসন ব্যবস্থা।
তবে সংবিধান রচনার কাজে কোনো দিনই কোনো সভ্য দেশ এরূপ দাবী করে যেন না বসে যে, জনগণের প্রত্যক্ষ অংশ গ্রহন আছে। কিন্তু সংবিধানের প্রস্তাবনার প্রথমেই লেখা "আমার ভারতের জনগণ..." অর্থাৎ ভারতের জনগণ যেন সংবিধান রচনা করেছে।
একটা কথা মনে রাখা উচিৎ গনতন্ত্র কিন্তু কোনো দিন দাবি করতে পারবে না যে, সে সকল জনগণের স্বার্থ রক্ষা করেছে। আবার গনতন্ত্র এটাও দাবি করতে পারবে না যে, সে সংখ্যা গরিষ্ঠের স্বার্থ রক্ষা করেছে।কারন আমাদের সংখ্যা গরিষ্ঠের ভোটে জেতা MLA বা MP গুলো ৫ বছর করে ক্ষমতায় থাকা কালেই আমাদের চাওয়া পাওয়ার হিসেব বদলে যেতে পারে।
আমরা যেখানে ছিলাম সেটা হলো শরনার্থী সৃষ্টি...
আগেই বলেছি যারা রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে পারেনি বা ভেবেও জমি, সম্পত্তির টানে বা মাতৃভূমির টানে নিজ নিজ বাসভূমিতেই থেকে গেল তারা পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতির বা অত্যাচারের কারনে দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়। বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের সময়ও এর সংখ্যা অনেকটা বেশি ছিলো। তবে তার আগে যারা এসেছেন তারা কি এই পর্যায়ে পরে? ভারতীয় রাজনৈতিকরা দুবার ঢোক গিলে না বা হ্যাঁ কিছু একটা উত্তর দেওয়ার হয়তো চেষ্টা করবে। কিন্তু মুক্তি যুদ্ধের পর যারা ভারতের এসেছে তাদের কি ভারত ফিরিয়ে দেওয়ায় কথা ভাবছে? একথা জিজ্ঞেস করলে আর উত্তর দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলবে বলেই মনে হয়।
কারণ মুক্তি যুদ্ধে ভারত ছিলো বাংলাদেশের অত্যাচারিত মানুষজনের অভয়ারণ্য স্বরূপ। এবং ততকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ক্রিয়াকলাপই এরজন্য বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। প্রকৃতপক্ষে, এ কথা মানি আর না মানি এই মানুষ গুলির ভারতীয় উপমহাদেশের কোনো না কোনো জায়গায় কিন্তু নিজস্ব ভূমি ছিল। সুতরাং এই মানুষ গুলির বাসস্থানের ভূমি নিশ্চিত করা তাদের একমাত্র লক্ষবস্তু হয়া উচিৎ ছিল যারা দেশটিকে নিজেদের স্বার্থে ভাগ করে নিয়ে ছিল।আর সে উদ্দেশ্যই নেহেরু- লিয়াকত চুক্তি( ১৯৫০) হয়েছিল, যাতে দুদেশের সংখ্যা লঘুদের স্বার্থ রক্ষার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু রাজার খেয়ালের চেয়ে বড়ো কিছু হতে পারে না এটা চিরকালই জেনে এসেছি। তাই কোনো দেশেই এদের স্হায়ী বসবাস নিশ্চিত করা গেলো না। চলল গনহত্যা, ধর্ষন এবং অত্যাচার।একটি দেশের উগ্রতা, রাজনৈতিক পাওয়ার, এবং ধর্মীয় সংখ্যা গরিষ্ঠতা ধর্ষনের ও অত্যাচারের ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিলো দুর্বলের শরীরে। ছিন্নমূল লোকজন যখন অন্য দেশে পালিয়ে গিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে তখন দুদেশের সীমান্তরক্ষীদের হাতে আবারও ধর্ষন হতে হয়। একদেশের সীমান্তরক্ষী বলে, ‘কি ব্যাপার কাকা এতো দিন থাকলেন কিছু দেবেন না?’ আবার অন্য দেশের সীমান্তরক্ষী বলে ‘কিছু না দিলে কি করে থাকতে দিই বলুন তো?’ সুতরাং বাবার বুক ফাটলেও মেয়েকে পশুর হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো।আবার যে দেশে পৌছালো সেদেশের রাজনৈতিক নেতারাও উত্তেজনার আগুনে যৌবন এবং দাঙ্গার আগুনে রুটি এই দুটিই সেঁকে নিলো।
এইরকমই একটি রক্তমাখা ইতিহাসের ডকুমেন্ট আমরা হয়তো দু’একটা বইয়ের পাতায় পেয়ে যেতে পারি বা ইউটিউব ও উইকিপিডিয়া তে ও আছে।
তা হলো মরিচ ঝাঁপির হত্যা কান্ড।
মরিচ ঝাঁপি
‘রামদা,কাজটা কি ভালো হলো?’ এরকম একটা প্রশ্ন ছুড়ে দিলো অমুক নামের মরিচ ঝাঁপির এক ক্ষুদ্র রাজনৈতিক নেতা তারই দলের শীর্ষ স্থানীয় নেতা রামদার দিকে। রামদা তখন সরকারি লঞ্চে করে মরিচ ঝাঁপির দ্বীপে পুলিশের অবরুদ্ধ অবস্থায় থাকা জনগনকে দেখতে এসেছেন।আসলে দেখতে এসছেন যে, এতো দিন অবরুদ্ধ থাকার পরও উদবাস্তুরা দ্বীপটিকে কেন খালি করে দিচ্ছে না?
কিন্তু তারা যে খালি করে দেবে, তাহলে তারা যাবে কোথায়? কারন এর আগেও তাদেরকে সীমারেখা পেরিয়ে এদেশে আসার পর আন্দামান, দণ্ডকারণ্যের জঙ্গলে, মানা ক্যাম্প ইত্যাদি জায়গায় একপ্রকার পশুর মতো ফেলে দিয়ে আসা হয়ে ছিল।অতঃপর এই রামদা ই তো তাদেরকে বলেছিল যে ‘তোমরা পশ্চিমবঙ্গে ফিরে চলো পশ্চিমবঙ্গে ৫ কোটি মানুষ তাদের ১০ কোটি হাত তুলে তোমাদেরকে আহ্বান জানাচ্ছে।’ সত্যি কথা বলতে কি, তখন ওই উদবাস্তুদের সামর্থ ছিল না এই আহ্বান উপেক্ষা করার।তাই তারা আবারও পশ্চিমবঙ্গে ফিরে এলো। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবসু বলেন উদবাস্তুরা চাইলে সুন্দরবনে কুমীর মারী দ্বীপের পাশের একটি দ্বীপ মরিচ ঝাঁপিতে বসবাস শুরু করতে পারে এবং তাঁর রাজ্য-পুলিশ কোনো রকম বাধা দেবে না।
বসতি গড়ে উঠতে বেশি সময় লাগলো না এবং ক্রমেই জঙ্গল, নদী ও নদীতে মাছ চাষকে ভিত্তি করে একটা স্থিতিশীলতার দিকে এগিয়ে চলছে জনজীবন।স্কুল হলো, জলের কলও বসিয়ে দিলো সুহৃদয় সম্পন্ন সরকার।ক্রমে ক্রমে এই দ্বীপে প্রায় ৩৬ হাজার জনজীবনের সমাবেশ গড়ে উঠল।
এদিকে রাজ্য রাজনীতিতে তখন দল পরিবর্তন না হলেও মানসিকতার অনেক পরিবর্তনই যথেষ্ট লক্ষনীয় হয়ে পড়েছে। রাজ্য সরকারের বিভিন্ন নেতৃত্বের যাতায়াত চলছে এবং ভোট ব্যাঙক বিচারে মনোনিবেশ করা প্রয়োজনীয় বলে মনে করে বসলো তখনকার সদ্য ক্ষমতা চ্যুত রাজ্য কংগ্রেস নেতৃত্ব। তারা বারবার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আবেদন করতে থাকে যে বামফ্রন্টের সরকার গঠনের এবং কংগ্রেসের সরকার ভেঙে যাওয়ার একটি অন্যতম কারন হলো উদবাস্তু ভোট ব্যাঙক।এদিকে বামফ্রন্টের নেতারাও যায় মরিচ ঝাঁপি এলাকায়। নেতারা তাদের কে দলে যোগ দিতে বলে এবং তাদের দলের ঝান্ডাধারী সমর্থক হতে আবেদন ও করে। কিন্তু মরিচ ঝাঁপি দ্বীপের উদবাস্তুরা জানায় তারা প্রকাশ্য রাজনীতিতে আসতে চায় না তার কারন হলো উদবাস্তু সমস্যা যেমন রাজ্যের সরকারের সমস্যা তেমনি কেন্দ্রীয় সরকারেরও সমস্যা আবার আন্তর্জাতিক সমস্যাও বটে। তাই যখন রাজ্য সরকারের পতন হবে তখন তাদেরকে কে রক্ষা করবে?তবে উদবাস্তুরা একটা ভরসা দেয় যে তাদের ভোট ক্ষমতায় থাকা সরকারই পাবে।তবে সেদিন যদি ওই এলাকার উদবাস্তুরা রাজ্য সরকারের ঝান্ডাধারী হয়ে পড়তো তাহলে মরিচ ঝাঁপির দ্বীপে কোন রাজনৈতিক সমীকরণ দাঁড়াতো তা মনে হয় শুধু মাত্র অনুমানের ভিত্তিতে বলে দেওয়া ঠিক হবে না।
কেন্দ্রীয় সরকারের তখন জনতা দল ক্ষমতায়। ১৯৭৯ সাল।এই বছরই মোরারজি দেশাই ইস্তফা দেন এবং তার স্থলাভিষিক্ত হন চরণ সিং। সুতরাং কেন্দ্রীয় সরকারও যে খুব একটা স্থিতিশীল মানসিকতা নিয়ে সরকার চালাচ্ছে এটা বলা যায় না।বরং কংগ্রেসের ক্ষমতায় চলে আসার সম্ভবনা জনতা সরকারের কাঁধে শ্বাস ফেলছিলো বারবার।এবং ১৯৮০ তেই ইন্দিরা গান্ধি ক্ষমতা দখল করে। এইসব কথা বাদদিয়ে একটি কথা যদি মেনে নিই যে তখন কেন্দ্রীয় সরকার থেকে কিছু একটা কারনে নির্দেশ আসে যে উদবাস্তু দের কে এতো পাত্তা দেওয়া যাবে না তার কারন তারা সংরক্ষিত বনাঞ্চলে ঢুকে পড়ছে এবং উদবাস্তুদের সংখ্যা এলাকায় যথেষ্ট পরিমাণে বেড়ে চলছে আর তারা নাকি উগ্রপন্থী কাজে মেতেছে তাহলে মনে হয় উদবাস্তু নিধনযজ্ঞের একটা যথাযথ কারনে উপনীত হওয়া গেছে।কিন্তু এই যুক্তিটিও ভুল ছিল কারন সার্ভে ওফ ইন্ডিয়া যে সরকারি ম্যাপ দিয়েছিল তাতে এরূপ কোনো দাবি নেই। এবং উগ্রপন্থার কথা যদি বলি তাহলে কিন্তু কাশ্মীরের সমস্যা অনেক জটিল এবং আমরা তা অনেক দশক ধরেই বিভিন্ন সাংবিধানিক পথে সমাধান করে আসছি।কিন্তু উদবাস্তুদের সংখ্যা বৃদ্ধির হার যে উর্ধবমূখী হচ্ছিল সেটা কেউও ই অস্বীকার করতে পারবে না।তবে সে দিন রাজ্য সরকারের উপরে কিরূপ চাপ আসছিলো তার কোনো লিখিত প্রতিলিপি আছে কিনা সেটা আমার জানা নেই। এবং রাজ্য সরকারও সেদিন এটা আন্তর্জাতিক আইন বিরুদ্ধ বলে রুখে দাঁড়াতে কতটা চেষ্টা করেছিলো সেটাও প্রশ্নে বিষয়। কিন্তু রামকৃষ্ণমিনশ, বা অন্যান্য সমাজকল্যাণ মূলক সংস্থা কে সেদিন প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। এমন কি মমতাময়ী মা মাদার টেরেসাও সেদিন রাজনৈতিক চাপেই মরিচ ঝাঁপি দ্বীপে প্রবেশ করতে পারে নি।সুতরাং গনহত্যা অনিবার্য এটা ভেবেই তখন বেঙ্গলের সভ্যসমাজ ভগবানের কাছে প্রার্থনা করাও অর্থ হীন মনে করে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো।
৩১ জুলাই। অবরুদ্ধ মরিচ ঝাঁপির দ্বীপে বেশ কিছু দিন অবরোধের পর আগুন জ্বালিয়ে দিলো রাজ্য পুলিশ আধা সেনা, র্যাফ ইত্যাদি।সেই চিৎকারের শব্দ যেন সুন্দরবন ভেদ করে বঙ্গপোসাগরে মিলিয়ে গেল রাত্রি শেষ হওয়ার আগেই। পরের দিন সকালে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীরা যা দেখেছিলো তার বর্ণনা দিতে গিয়ে না কেঁদে থাকতে পারেনি কেউই, তবে বিশেষ কিছু দেখতে পায়নি তারা কারন বেশির ভাগ আধপোড়া লাশ গুলি তখন সুন্দরবনের টাইগার প্রজেক্টে বাঘের খাবার হিসেবে বয়ে নিয়ে চলে যাওয়া হয়েছে। কয়েকটি শিশুর আধ পোড়া শরীর চিকেন রোষ্টের মতো হয়ে পড়ে আছে, সম্ভবত শিশু দেহ গুলি ছোটো বলে যারা লাশ বইছিল তাদের নজরে পড়েনি । কুমীর মারী দ্বীপ বা পাশাপাশি এলাকায় কিছু লোককে সরকারি ভারা করা গুন্ডা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিলো। তাদের কাজ ছিল লাশ বয়ে নিয়ে যাওয়া এবং মরিচ ঝাঁপি দ্বীপের উদবাস্তু দের নৌকা গুলো ভেঙে দেওয়া।
এই ঘটনাটি মনে করাতে চাইছি এই কারনে যে, যেন এরূপ কোনো ঘটনার সমমুখী না হতে হয় আমাদেরকে। পরিস্থিতি হাতের বাইরে যাওয়ার আগেই উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ।
সীমান্তবর্তী রাজ্য গুলোর তাই একটু বেশি দায়িত্বশীল হওয়া দরকার বলে মনে হচ্ছে। এখানে দায়িত্বশীল বলতে NRC বা CAAআইনটিকে আটকে দেওয়ার কথা বলতে চাইছি তা কিন্তু নয়।আইনের যে বিষয়গুলিতে কিছুটা সহনশীলতা অবলম্বন করলে জাতিধর্মনির্বিশেষে সকলের জন্য একটি মঙ্গলময় সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় সেগুলি কে স্পষ্ট করার কথা ভাবলে ভালো হবে।তাছাড়া এই আইনের মাধ্যমে কাউকে না কাউকে তো অধিকার দেওয়া হচ্ছে, যারা পাচ্ছে না অধিকার তাদেরকে কিভাবে অধিকার দেওয়া যায় সে বিষয়টিকে আলোচনার আওতায় আনা যেতে পারে। আইনের প্রতিলিপি হাতে নিয়ে জনগণের কাছে গিয়ে পড়ে পড়ে শুনিয়ে জনগণের মতামত সম্পর্কে অবগত হওয়া দরকার। কাঁসর, ঘন্টা বা কোনো উশৃংখল চিৎকার জনগণের বোঝার মতো ভাষা হতে পারে না।এক্ষেত্রে কিন্তু রাজ্য শাসকদলের রাজনৈতিক পথের কোনো নিশ্চিত পদক্ষেপ মানুষকে আস্বস্থ করতে পারলো না। পথে নামার উদ্দেশ্য এক আর রাজনৈতিক পদক্ষেপ গুলি ঠিক তার বিপরীত হলে মানুষের কি করনীয় সেটা স্পষ্ট হওয়া সম্ভব নয়।এই সুযোগে সবাই যেন ২০২১ ভোটের প্রচার কাজটি সেরে নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের জনজীবনে একটা সুদীর্ঘ ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে যদি উদবাস্তুদের কে স্থায়ী নাগরিকত্ব দিয়ে দেওয়া যায়। কারন রাজনৈতিক দলগুলোর ওই উদবাস্তুদের কে সুবিধা দেওয়ার নামে ভোট ব্যাঙক হিসেবে ব্যবহার করে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার সম্ভবনা কমে যাবে।এবং দুর্নীতির চরম সীমা অতিক্রম করার আগেই রাজনৈতিক দলগুলিও নিজদের শাসন ব্যাবস্থা সম্পর্কে সচেতন হতে বাধ্য হবে।
নাগরিকত্ব দেওয়া হবে।আচ্ছা বেশ ভালো কথা।কিন্তু যদি নাগরিকত্ব দেওয়া’ই মূল উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহলে উচ্ছেদ করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা কেন বলছে নেতারা বারবার। আর সবচেয়ে বড়ো প্রবলেম তো এটাতে যে যদি ডিটেনশন ক্যাম্প করা হয়। কেন, কি দরকার ডিটেনশন ক্যাম্পের? সরকার যদি ঠিক করে থাকে যে নাগরিকত্ব দেওয়ায় হবে তাহলে উদবাস্তুদের কে নিজের বাসভূমিতেই রেখে নাগরিকত্ব দেওয়া হলে কি আঞ্চলিক নেতাদের একটু বেশি লাভ থেকে বঞ্চিত হওয়ার সম্ভবনা থেকে যাচ্ছে? তাছাড়া দেশের এই অর্থনৈতিক অবস্থা। GDP 5%। এই অবস্থায় NRC, CAA এগুলোতে কতটা পরিমাণে টাকা ব্যয় করতে হবে সেটা কি সরকারের হিসাবরক্ষকরা হিসাব করে বলে দিয়েছে যে সরকার তা বহন করতে সক্ষম। শুধু মাত্র আসামে NRC করতে ১৬ শো কোটি খরচ হয়েছে।যদি সারা দেশে এই প্রক্রিয়া করতে হয় তাহলে এতো লক্ষ-কোটি টাকা লাগবে সেই সংখ্যা টির অঙ্ক গুলিকে কাউন্ট করতেই ভয় লেগে যাবে। তখন কি সেই অর্থ ঘাটতি মেটানোর জন্য জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে বা কর বাড়িয়ে জনগণের থেকে টাকা তোলা হবে? নাকি আর্থিক মন্দা কাটাতে ‘গোরুর দুধ থেকে সোনা’ সংগ্রহে মন দেবে সরকার? (আরো একটি সমস্যা sc,st বা obc সম্প্রদায়কে সম্প্রদায়ের ভিত্তি তে সংরক্ষণ না দিয়ে আর্থিক দুর্বলকে অর্থ সাহায্য করা উচিৎ এবং একমাত্র যোগ্যতা কে সরকারি চাকরির মাপকাঠি করা উচিৎ। সংরক্ষণের এই রূপ প্রদ্ধতি অবলম্বন করলেও অনেক অর্থ অপচয় হয়। অনেক আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ব্যাক্তিও এর ফায়দা পেয়ে যায়।)
যদি ভোট ব্যাঙক ই রাজনীতির প্রধান উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহলে তো সরকার আমার হাতটা কেটে রাখলেই পারে আর ইলেকশন এলেই ওইটাকে নিজের ইচ্ছে মতো ব্যবহার করতে পারে।
মানবিকতার দিকটি ও সরকারের বিচার করা অবশ্যই কর্তব্য।না হলে এই ছিন্নমূল মানুষদেরকে আর কতবার ছিন্নমূল করবে?
মনে রাখতে হবে সরকার আমাদেরকে যাকিছু দেয় তার থেকে ও অনেক বেশি আমরা সরকারকে দিই।জনগণ সে দেশের উৎপাদনে অংশ নেয়, সৃজনশীলতায় অংশ নেয় আবার এই জনগণই যখন কোনো বস্তু কিনে তখন তাকে কর দিতে হয়।সুতরাং সরকার যে সবসময় লসে রান করছে একথা বলা ভুল হবে।যারা বলছেন উদবাস্তু বিতাড়িত করলে আর্থিক উন্নতি হবে আমি তাদেরকে বলি রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে দুর্নীতি এবং পুঁজিবাদী পোষণ বন্ধ করলে তার থেকে হাজার গুণ বেশি লাভ হবে। এখনই কেউ বলবে ভাবছেন যে যারা ২০১৪ সালের ১ লা জুলাই এর পর এসেছে তাদের কে ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখা হবে। কেন তাদেরকেই বা কেন রাখা হবে? তারা এদেশে এসে কোনো একটা জায়গায় বসতি গড়ে তুলছে ইতিমধ্যেই এবং সে জায়গায় নিজেকে সামাজিক ভাবে মানিয়ে নিয়েছে। তাকে এখন ছিন্নমূল করে অন্য একটা জায়গায় নিয়ে গিয়ে অন্য কতক গুলো অচেনা মানুষের মধ্যে রাখলে সে তো আরও বিপদে পড়বে। কতক গুলো অপরিচিত লোক একে অন্যের বেশি ক্ষতি করবে।তখন আবার এলাকার রাজনৈতিক লোকজন ভুঁড়ি ফুলিয়ে সমস্যা সমাধানের নামে নিজে একটু উষ্ণ হয়ে নেবেন।
তাছাড়া ২০১৪ সালের ২ রা জুলাই থেকে যারা এদেশে এসেছে তাদের ও একটা নির্দিষ্ট সময়ের পরে পাঁচ বছর এদেশে থাকা হয়ে যাবে এবং তাদেরকে আন্তর্জাতিক নিয়মে ভারত সরকার নাগরিকত্ব দিতে বাধ্য হবে।
এখন ধরা যাক মুসলিম জনজাতির কথা এবং শ্রীলংকা থেকে অত্যাচারিত হয়ে আসা তামীল জনজাতির কথা। এই অংশটিতে বোঝার চেষ্টা করবো যে যারা ভারতের আদি মুসলিম এবং যারা ভারতের অনুপ্রবেশ করেছে সেই মুসলমানদের কথা।
★★★★ প্রথমত ধরে নিলাম দেশ ভাগের সময় মুসলিম অনুপ্রবেশ ঘটেনি কারন তখন তাদের কে আলাদা দেশ দেওয়ার হয়েছে তাই তারা সেখানেই ভালো থাকবে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু আগেই বলেছি যে মুক্তি যুদ্ধের সময় ভারত ছিল বাংলাদেশের অত্যাচারিত মানুষদের অভয়ারণ্য স্বরূপ সুতরাং দলে দলে হিন্দু মুসলিম সহ সকল জাতি ধর্মের মানুষ আবারও ভারতে আসে এটা স্বীকার করতে কারো আপত্তি আছে কি? যদি আপত্তি থাকে তাহলে এখনি চ্যাপটার ক্লোসড করে দেওয়া যেতে পারে। যদি ধরে নেওয়া হয় যে অনুপ্রবেশ ঘটেছে তাহলে বলি, যে মানুষ গুলি এখানে বসতি গড়ে তুললো সে হিন্দু, মুসলিম বা যে কোনো সম্প্রদায়েরই হোক না কেন তারা বাংলাদেশ মুক্তি যুদ্ধে জয়যুক্ত হওয়ার পরও সেদেশে ফিরে গিয়ে নতুন করে বসতি স্থাপনের আগে অবশ্যই একবার হলেও ভাবতে বাধ্য হয়েছিল যে, তারা যে আবারও ওই দেশে ফিরে যাবে, তাদের জীবন কতটা নিশ্চিত হবে সেখানে? বা যেখানে আছি সেখানেই ভালো আছি আর কোনো জীবনে ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না। আর এই ভাবনা থেকেই এখানে থেকে যাওয়ার সম্ভবনা।
*★★★★★এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা একান্তই প্রয়োজন যে মুক্তি যুদ্ধে বাংলাদেশে (ততকালীন পূর্ব পাকিস্তানে) হিন্দু মুসলিম সহ সকল সম্প্রদায়ের মানুষই পশ্চিম পাকিস্তানের( এখনকার পাকিস্তানের) শাসক ও সেনা দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল কারন এটি ছিলো বাংলা ভাষা ও উর্দু ভাষা এই দুটি ভাষায় প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার লড়াই।হিন্দু – মুসলিমের লড়াই নয়। সুতরাং তখন যে পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলিম সেনা পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানদেরকে আক্রমন করে নি এটা কেউ অস্বীকার করতে পারে না কারন আগেই বলেছি এটি ছিলো এক ভাষায় মানুষের অন্য ভাষায় মানুষের উপরে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার এক চরম নির্লজ্জ ঐতিহাসিক অধ্যায়।
তাহলে অবশ্যই বোঝা যাচ্ছে যে মুসলিম কিছু জনজীবনও একটা সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা ধার্মিক যেকোনো কারনেই হোক না কেন এখানে থেকে যাওয়ার সম্ভবনা আছে। তাই দেশ ভাগের সময়ে এদেশে থেকে যাওয়া মুসলমানদেরও একটি বড়ো অংশের দাবি যে অন্য দেশের মুসলিমরা যদি এদেশে এসে নাগরিক হয় এবং তারা প্রথম থেকে এদেশে থাকা মুসলমানদের জন্য যে সংরক্ষণের ব্যবস্থা (সংখ্যালঘুদের জন্য সরকারি সংরক্ষণ) আছে তাতে ভাগ বসায় তাহলে তাদের জন্য প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রটি জটিল হবে।
এবার আসছি বিল প্রসঙ্গে। বিলটি তে মুসলিম বাদে আর বাকি ৬টি সম্প্রদায়ের কথা বলা আছে। তাহলেই প্রথম প্রশ্ন এসে যাচ্ছে যে মিশে থাকা একটা জনজীবন থেকে ছাঁকনি দিয়ে সকলকেই তুলে নেওয়া হলো, মুসলিমরা বাদ কেন?এ প্রশ্নের উত্তরে অবশ্য কেন্দ্রীয় সরকারের যুক্তি হলো যে, যেহেতু দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হয়েছে এবং মুসলিমদের কে আলাদা দেশ দিয়ে দেওয়া হয়েছে সুতরাং তারা সেখানে ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক অত্যাচারের কোনো প্রশ্ন উঠে না।সুতরাং তারা যদি সেখানে মিলে মিশে না থাকতে পারে তার দায় নেওয়ার দায়িত্ব ভারতের নয়। একদম সঠিক কথা বলেই মনে হচ্ছে এবং এই যুক্তি নিয়েই বিলটি লোকসভা ও রাজসভা দুটি কক্ষতেই পাশ হয়ে গেছে।সুতরাং গনতান্ত্রিক প্রদ্ধতির তো কোনো অবমাননা করা হয়নি। কিন্তু আগেই বলেছি যে গনতন্ত্র কিন্তু সংখ্যা গরিষ্ঠের স্বার্থ রক্ষা করলেও প্রতিটি মতামতের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। তাই বিল হাজারো ত্রুটি নিয়ে হলেও আইনে পরিনত হয়েছে উদবাস্তু মুসলমানদের কে একপ্রকার উপেক্ষা করেই বলতে বাধ্য হচ্ছি এই কারনে যে—ধরি দুজন বসে আছে একজায়গায়, আমারই বন্ধু তারা। তাদের নাম A এবং B। আমি B কে বললাম ‘B তোর আজ আমার বাড়িতে নেমন্তন্ন রে, সময় মতো চলে আসিস।’ তাহলে বুঝতেই পারছেন যে A কে কিন্তু নেমন্তন্ন করি নি এবং সে আসবেও না।
★ বেশ, এগুলো যুক্তি তর্কের খাতিরে মানতে বাধ্য হচ্ছি। কিন্তু ভারত ও বাংলাদেশের কুটনৈতিকই বলি আর রাজনৈতিকই বলি সব সম্পর্কই ভালো তবে সে দেশের সরকারের সাথে কেন আগে কথা বলা হচ্ছে না, যে মুক্তি যুদ্ধে এদেশে আসা মুসলিমদের কে সে দেশে ফিরিয়ে নেওয়া হোক এবং তাদের আবাসনের ব্যবস্থা করা হোক কারণ দেশ ভাগের সময় দ্বিজাতিতত্ত্বটাই মেন কারন ছিল। এবং আগেই বলেছি যে এই মানুষ গুলির সকলেরই এই ভারতীয় উপমহাদেশের কোনো না কোনো জায়গায় বসত ভূমি ছিল সেটা নামে বা বেনামে যাই হোক না কেন।তাই এখনো এই দেশ গুলোর উচিৎ এই উদবাস্তুদের কোনো একটা জায়গায় স্থায়ী বসবাস নিশ্চিত করা। এখন কেউ যদি ‘আমাদের কি’ এটা বলে মুখ ফিরিয়ে থাকে তাহলে হয়তো ভারতীয়দেরকে একবার হলেও অনুতপ্ত হতে হবে এই ভেবে যে ১৯৭১সালে পাকিস্তানের দুটি খন্ডের যুদ্ধে ভারতের নাক গলানো উচিৎ হয়নি। আবার কেউ যদি বলে তখন পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানিরা গনহত্যা করছিল তাই ভারত সাহায্য করতে বাধ্য হয়ছিল অথবা কেউ বলবে সঠিক সময়ে সঠিক নীতি তারই নাম রাজনীতি; যে যাই বলুক না কেন আমার মনে হয় ভারতের একটুখানি হলেও ভাবা উচিত এই উদবাস্তু মুসলিমদের কথা। যদিও কোনো উগ্র রাজনৈতিক নেতৃত্ব ব্যতীত কোনো আইনেই এখনো স্পষ্ট করে বলা হচ্ছে না যে এই উদবাস্তু মুসলমানদেরকে বাংলাদেশে পাঠানো হবে, তবু একটা কথা বলে রাখতে বাধ্যই হচ্ছি যে, যদি কোনো দিন এই রকম চরম সিদ্ধান্ত নিতেই হয় তাহলে যেন দুদেশের রাজনৈতিক স্তরে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ওই দেশে পাঠানোর চিন্তা ভাবনা করা হয় তাহলে, এই ছিন্নমূল মানুষ গুলির বর্ডার পারাপারের সময়ে অত্যাচারের স্বীকার হতে হবে না। এবং একজায়গায় সংঘবদ্ধভাবে থাকার ফলে এই মানুষ গুলির রাজনৈতিক স্বার্থও চরিতার্থ হবে।ঠিক যেমনটা বাংলাদেশে থাকা রহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে হচ্ছে। একটা জায়গায় সংঘবদ্ধ ভাবে আছে বলে তাদের প্রতি দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক নজর রাখা সম্ভব হচ্ছে। এবং সুযোগ সুবিধাও দেওয়া সম্ভব হচ্ছে,অনুদান পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। যাইহোক এ-সব অনেক পরের কথা। তবুও বলে রাখা ভালো তাই বললাম। কোনো রূপ প্রান হানি বা জন বিপর্যয় কাম্য নয়।
রাজনৈতিক ভাবেই সবকিছু সম্ভব। আমি বা আপনি যেই হয় না কেন রাজনীতি কে যতই গালি দিই দিনের শেষ অঙ্কটার উত্তর কিন্তু রাজনীতিই বের করবে। সুতরাং রাজনীতি কে ঘৃণা করে বা রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্বের প্রতি গালাগালি করে সমস্যার সমাধান হবে না।একজন সুন্দর নীতি গ্রহনে সক্ষম রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব ঈশ্বরের সমান হয়ে থাকে জনজাতির কাছে।একটি, একশোটি বা একহাজারটি যুদ্ধ যেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ প্রমানিত হয় সেখানে একটি রাজনৈতিক ব্যাক্তির একটি সঠিক সিদ্ধান্ত একরাশ শান্তি নিয়ে আসতে পারে। রাজনীতি যদি কাউকে রক্ষা না করে তাহলে কে তাদেরকে রক্ষা করবে? সবকিছু গনহত্যা, খুন, ধর্ষন হয়ে যাওয়ার পর বুদ্ধিজীবীরা তখন দুটো কবিতা লেখার, গান লেখার, কেউবা ছবি আঁকার, সিনেমা বানানোর একটুখানি রসদ পাবে—এতো দিন ভালো রোজকার চলছিল না বা সভ্য মানুষ খাচ্ছিল না—বিষয়বস্তু গুলো বড়ো একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছিল —তখন সভ্য সমাজ একটু বিকেল বিশ্রামের রসদও পেয়ে যাবে।আমিও হয়তো ফেসবুকে একটা পোস্ট করার কথা ভাববো।আর আপনারা কয়েকশো লাইক,কমেন্টের ব্যবস্থা করে দেবেন।কেউ কেউ আবার ডিস লাইক অপশন টা না রাখবার জন্য ফেসবুক কে দোষারোপ করতে করতে স্ক্রল করে এগিয়ে যাবেন।
অনেকে এই উদবাস্তু সমস্যা কে আর্থিক অবনতির কারন দেখাচ্ছে। প্রথমত দেশ ভাগের পরও এত দিন যে মানুষ গুলি কোনো একটি জায়গাকে কামড়ে ধরে বেঁচে আছে তারা সেই জয়গায় সরকারের টাকায় বসে খাচ্ছে এটা মেনে নেওয়া যার না। তারা দেশের উৎপাদনে অংশ নিচ্ছে, কোনো জিনিস কিনতে গেলে সরকারকে ট্যাক্স দিচ্ছে। তার চেয়ে মনে হয় সরকারি নেতা মন্ত্রী বা আমলারা যে পরিমাণ দুর্নীতি করে বা ঘুষ খায় এবং কালোবাজারি রা যে পরিমান কালো টাকা লুকিয়ে রাখে বা ব্যাঙক জালিয়াতি তে যে পরিমাণ টাকা গেছে তাতে শুধু ভারত কেন সারা পৃথিবীর শরনার্থী সমস্যা দুর করা যাবে।
★★★★★★ সত্যি কথা বলতে এই বিলটি তে মনে হচ্ছে কোথাও যেন ওই তিনটি দেশের মধ্যে থাকা সংখ্যা লঘুদের প্রতি অত্যাচারকে তরান্বিত করা হলো। আপনার শেষ প্রশ্ন টা যদি এবার করে বসেন যে তাহলে কি নাগরিকত্ব আইন করার দরকার নেই? আমি বলবো অবশ্যই দরকার এবং আরো আগে হলে বরং ভালো হতো। আমার বাড়িতে কতজনের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে হবে তার কোনো হিসেব থাকবে না, এটা হয় নাকি? তবে মনে রাখতে হবে এটি ভারতীয় রাজনীতির আভ্যন্তরীণ বিষয় গুলির মধ্যে সবচেয়ে জটিলতম বিষয় তাই সংবিধান রচনাকালে ও সংবিধান রচনাকারীরা কারা ভারতের নাগরিক হবে সেটা স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করতে পারেননি তাই বলা আছে ‘we, the people of India… ‘ তখন বলতে পারেননি ‘we, the citizen of India ‘
এই রকম এটি জটিলতম সমস্যাকে সঠিকভাবে বিচার বিশ্লষণ না করে কয়েকটি স্টেপ জাম্প করে সমাধান করে দিতে চাইলে আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের ভাবমূর্তি কতটা গরিমা অর্জন করবে সেটা অবশ্যই সরকার ভাববে, এই আশা রাখি।
‘এদেশ থেকে সকল অনুপ্রবেশকারীদের তাড়িয়ে ছাড়বো’–এরূপ মন্তব্য করে যারা উগ্র ভাষায় মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভাষন দিচ্ছেন তাদের উদ্দেশ্য বলি আপনাদের মতো মূর্খ রাজনৈতিক আর একটিও যেন এই ভারতীয় উপমহাদেশে না জন্মায়। কারন সারা ভারতে কয়েক কোটি মানসিক বিকলাঙ্গ ভবঘুরে আছে যারা যেখানে সেখানে শুয়ে, বসে, ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয় এবং ভিক্ষা করে খায় তাদের কোনো তথ্য প্রমান নেই তাদের কি হবে? আর এটা ভারতীয় সংবিধান বিরোধী তো বটেই এটি আন্তর্জাতিক আইনেরও বিরুদ্ধে। আর তার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যারা হাততালি দিয়ে দিয়ে উল্লাস করে উঠছে –একদল জানোয়ারের মতো — মধ্যযুগীয় রাজনীতিতে এই এরকম হতো এক দলকে বন্দী করে এনে হত্যা করছে অন্য দলের নেতৃস্থানীয়রা আর বাকী সমর্থকরা উল্লাস করছে। এই ভাবে উসকানি মূলক মন্তব্য ও তাতে হাত-তালি ও বাহবা পাওয়ার ফলে আজ নেতাদের বক্তৃতা দেওয়ার ভাষা লাগামহীন হয়ে পড়েছে। এপ্রসঙ্গে একটি কথা উল্লেখ করলেই হয় ‘আমি চন্দন নগরের মাল…’ আশা করি আর বুঝিয়ে বলার দরকার নেই এখানে কার কথা বলা হচ্ছে। একজন নামজাদা কলাকার তার মুখে একটু খানিও সহনশীলতার ভাষা নেই আর আমজনতা কার থেকে সহনশীলতা শিখবে? আবার তাতে উল্লাসও হচ্ছে পাশ থেকে এবং হাততালিও পাচ্ছে। আমার পিছনে যদি ধুলো লেগে থাকে সেটা আমার পক্ষে দেখা সম্ভব নয় কিন্তু যারা পিছনে আছে তারা তো দেখতে পায়। কিন্তু তারাও সাবধান করা প্রয়োজনীয় বলে মনে করে নি।
গনতান্ত্রিক সরকার এবং জনসাধারণ, উভয়ের চরম সহনশীলতার ফসল হল একটি সুন্দর সমাজ ব্যাবস্থা।
সরকার যেমন যোগ্যতা অনুযায়ী তার নাগরিকদের সরকারি পদে নিয়োগ করে বা বিভিন্ন সুযোগসুবিধা দিয়ে থাকে ঠিক তেমনই জনগণও সরকারকে ইলেকশনের মাধ্যমে নিয়োগ করে। তাই জনগণেরও সরকারের প্রতি দায়বদ্ধতা আছে এবং সরকারের জনগনের প্রতি দায়বদ্ধতা আছে।কিন্তু সরকারে থাকা ব্যাক্তিগনের আচরণ বেশ কিছুটা উগ্র হয়, যেন তারা নিজের ব্যাক্তিগত সম্পত্তির ভাগ দিচ্ছে বরং তাদের এটা ভাবা উচিৎ যে তারা যা অর্থ, সম্পদ বা সুযোগ সুবিধা বা পারিশ্রমিক পায় তার সবটুকুই আসে জনগণের দেওয়া কর এবং দেশীয় সম্পদের থেকে।
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের এবং রাজ্য সরকার গুলির যা প্রতিরক্ষা বাহিনী আছে তা দিয়ে গোটা দেশ কে প্রতিরক্ষার আওতায় মুড়ে ফেলা যাবে তাহলে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করার কি দরকার?আমার মনে হয় আজ সভ্য সমাজের জানা খুবই দরকার যে, সরকার দেশ এবং রাজ্য শাসনের নামে আর কী কী করছে। একটি গনতান্ত্রিক দেশে বিশ বা ত্রিশ পারসেন্ট সেটা বড়ো কথা নয় যদি পাঁচ পারসেন্টও লোক কোনো বিলের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামে তাহলে অবশ্যই সেটা বিচার বিশ্লষণের আওতায় রাখা উচিৎ। তাই সুপ্রিমকোর্ট এখনই কোনো শুনানি তে অনুমতি দিচ্ছে না।
সুপ্রিমকোর্ট কিন্তু এই আন্দোলন গুলিকে লঘু ভাবে নিচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য বিনীত ধান্ডে নামে এক আইনজীবী সুপ্রিমকোর্টে একটি মামলা করে সিএএ কে সাংবিধানিক বলে ঘোষণা করতে আর্জি জানালে প্রধান বিচারপতি শরদ অরবিন্দ বোবড়ে বলেন আদালতের কাজ কোনো আইনের বৈধতা বিচার করা, কোনো আইনকে সাংবিধানিক হিসেবে ঘোষণা করা আদালতের কাজ নয়।
আন্দোলনকারীদের অহিংস হওয়া একান্ত কাম্য কারন একটি অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত অধিকার জাতির মুখকে উজ্জ্বল করে।এবং তার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই অধিকারকে সম্মানের সঙ্গে গ্রহন করে আর পৃথিবীর বুকে শান্তির বার্তা বয়ে নিয়ে চলে। জাতিধর্মনির্বিশেষে সকল ক্ষেত্রের সকল মানুষেরই কমবেশি এই আনদোলনের অংশ গ্রহন করেছে। তাই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা একদমই কাম্য নয়।আমদের একটাই লক্ষ্য, তাহলো শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। যে যতই ধনী হোক বা দরিদ্র,সকলেই একটি বিষয়ের কাছে নতজানু হয়ে ভিক্ষা মাগতে বাধ্য হয় তা হল শান্তি।
তাছাড়াও ২০১৪ সালের ২ রা জুলাই থেকে আজ প্রর্যন্ত যত জনজীবন এদেশের এসেছে তাদের কাউকেই এখনো নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে না।সুতরাং শুধু মাত্র যে মুসলিমরাই নাগরিকত্ব পেতে বাকি থাকলো সেটা কিন্তু নয়।অবশিষ্ট যারা থেকে যাচ্ছে তাদের দাবী মেনে পরবর্তী ক্ষেত্রে নাগরিকত্ব দেওয়া হতেই পারে।তাছাড়া নাগরিকত্ব হলো একটা অধিকার আর সরকারের এই অধিকার দেওয়ার পরিকল্পনাটিও হয়তো ধাপে ধাপে কার্যকরী হবে। সুতরাং আজকে যারা এই অধিকার পাচ্ছে না তারা যে কাল পাবে না সেটা না ভেবে নেওয়াই ভালো। তবে আঞ্চলিক নেতাদের উসকানিমূলক কথায় বেশ কিছু অশান্তি ঘটে গেছে যা মোটেও কাম্য নয়।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করি একটি সাহিত্য সভা তে একজন কবি দিদিভাই বলেছিলেন যে আজ প্রর্যন্ত যত জন শরনার্থী আছে সবাই কে নিঃশর্ত নাগরিকত্ব দিতে হবে একসঙ্গে। এখানে একটি আপত্তিও উঠে আসে তা হলো যদি আজই ভারত সরকার ঘোষণা করে যে, সকল শরনার্থীদের নিঃসর্ত নাগরিকত্ব দেওয়া হবে, তাহলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার আগেই যদি অত্যধিক হারে অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে তখন শরনার্থীর ঢল সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না ভারতের পক্ষে। সর্বশেষে বলি আইনের বিধি তৈরির কাজ এখনো চলছে তাই এই বিধি গুলি মানুষের কতটা আশা পূরণ করে সেদিকে অবশ্যই আমাদের নজর থাকবে।আমরা আশা করবো সকল রাজ্য সরকার বা বিরোধী দলগুলোর বা কেন্দ্রীয় সরকার যদিও তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ আলাদা তবুও তারা যেন আপামরজনসাধারণের মানবিক চাহিদা গুলোর উপর জোর দিয়ে একত্রে গঠনমূলক কাজ করে। আজকের কোনো সিদ্ধান্তও একদিন ইতিহাস হবে আর সেই ঐতিহাসিক ডকুমেন্টে কোনো রক্তের দাগ লেগে থাকবে না এই প্রার্থনা রাখি মহামান্য গনতান্ত্রিক সংবিধানের কাছে।