সুখের কথায় দুঃখ দীর্ঘ হয়
—————————অমল বিশ্বাস ( বাংলাদেশ)
যার কথা বলছি
সে আমার বালকবেলার বন্ধু বর্ণালী,
নিঃসঙ্গ ঘরে সে আমার প্রিয় গ্রন্থের নীলক্ষেত
জোছনাধোয়া প্রচ্ছদজুড়ে
একটি বঙ্কিমরেখায় বোঝা যায় প্রণয়ের জলপ্রপাত
বোঝা যায় অকস্মাৎ কিশোরী থেকে
ধীরেধীরে মাটি ঘেঁষে চলে যাওয়া শাড়ির আঁচল
প্রচ্ছদ নির্মাতাকে ধন্যবাদ।
অনেক আগে
আগে বলতে, যখন মাকে ফাঁকি দেয়ার বয়স
তোমার মুখের শব্দ, বিশেষ ক’রে শৈল্পিকঠোঁট
আর বুক থেকে তুলে নেয়া আলতো চুম্বন
খোঁপার নিচে, ঐ যে যেখানে কোমল রোমের সোহাগ
সেখানে মধ্যরাতে চুপচাপ অন্ধকারে রেখে দিতাম,
ভাবতাম, এ’ আমার ভালোবাসার দেশ।
তোমাকে একটি প্রশ্ন করি?
বলো তো, চোখের সামনে দিয়ে কোনো প্রিয়মুখ
সত্যি কি দূরে চলে যায়, পুরোপুরি হারিয়ে যায়
নাকি অনুভবে থাকে!
কিংবা ধরো, বিষন্ন সুন্দর হাসিতে
তুমি যেমন আটকে রেখে হুট করে চলে গেলে
তখন কি ভাবতে ইচ্ছে হয়নি
এতোদিনকার চেনাজানা চোখ জীবন-মরণ হয়ে
একদিন তোমাকে ভাবাবে!
দিগভ্রান্ত নাবিক দেখেছো!
সে কি বিলুপ্ত হয়, নাকি ভেসেভেসে জীবন কাটায়
অল্প হলেও কিছুটা জলের ভালোবাসায়,
তুমি কি ভাবতে পারও অখণ্ড বিচ্ছেদের প্রেমে
নির্ঘাত আমি এখন কী ভাবছি!
থাক, ভাবতে হবেনা, সুতোকাটা ঘুড়িকে উড়তে দাও
কারও উঠোনে যখন পড়বে
অন্তত সে উপেক্ষা করবে না, যেমন তুমি নিঃসঙ্গ করেছো
একটি মগ্ন জীবনের ইচ্ছে।
তখন তুমি ছোট্ট ছিলে।
দু-হাত উপরে তুলে বলতে– জামাটি পরিয়ে দাও,
তোমাকে দেখতাম, খুব ক’রে দেখতাম
এলোমেলো হয়ে যেতো আমার সম্পর্কবোধ,
শ্যামলাশরীরে ঢলে পড়া হালকা রোদ দেখতে দেখতে
তোমার স্কুলের বেলা বয়ে যেতো,
তাতে কি! প্রত্যেকদিন তোমাকে কবিতা পড়ে শোনাতাম
সারাংশ বলতে গিয়ে, কী সব বলতাম মনে নেই!
মনে হতো এ’ একধরণের যুদ্ধ জয়।
সম্ভবত তখন তুমি
সূর্যোদয়ে প্রথম পাখির ডাক বুঝতে শিখে গেছো,
চোখ নামিয়ে নিজেকে একটু দেখে নিতে
মাঝেমধ্যে উঠে আসা কামিজের কাপড়ে হাঁটু ঢাকতে
আড়চোখে তাকিয়ে না-বলা কথা
জমিয়ে রাখতে ফুটি-ফুটি কুঁড়ির মতো বুকের ভেতর।
মধ্যবয়সে এসে
কাঁচা স্মৃতিগুলো শিশুর অস্পষ্ট উচ্চারণের মতো
যা আমার ভেতরে হুলুস্থুল সৃষ্টি করছে,
সীমাহীন দূরত্বে আমি একধরণের বৃষ্টির শব্দ শুনতে পাচ্ছি
যা আমাকে নির্লজ্জ ক’রে তুলছে,
সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে প্রথম বৃষ্টিতে ভেজার স্মৃতি।
আড়ষ্টতা কাটিয়ে বয়স তখন দ্বাদশীতে
হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকে উঠলে তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলে
কতক্ষণ ধরে ছিলে মনে নেই,
মনে আছে আমি আত্মসমর্পণ করেছিলাম
আমাকে বন্দী করেছিলে তোমার কচি-বুকের কবিতায়
যে কবিতার গভীরে একটি স্রোতস্বিনী নদী
ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছিলো সমুদ্র থেকে সমুদ্রের ভেতরে,
হয়তো সে সমুদ্রে এখন আর ঢেউ নেই!
একটু মনে করো
চাঁদের পরিবর্তে নদীতে শঙ্খচিলের যে ঠোঁটছোয়া জল
তা তোমার গায়ে ছিঁটিয়ে দিতে
তুমি বলেছিলে, এর চেয়ে গলে পড়া জোছনার আলো
ঢের ভালো ছিলো,
ঝিঁঝির ডাকের সাথে মিশে যেতো আমাদের কথা
সন্ধ্যাতারার আলোয় লেখা হতো
কোলে মাথা রেখে একটি আদুরে কবিতা,
একটু ঝুঁকে চোখে চোখ রেখে আঁকা যেতো স্বপ্নের নদী
তাও হলো না!
তারাভরা আকাশ কখন পাহাড়ের ঢালে অস্ত গিয়েছিলো
মনে নেই, মনে আছে শঙ্খচিলের প্রেম
মনে আছে, গায়ের ছেঁটানো জলে তোমার ভ্রুর ডানা
উড়েছিলো নিঃসীম আকাশে।
এখনও আকাশ দেখি
এখনও মুখস্ত করি বালকবেলার থেকে বর্তমান যুবকবয়স,
একটি যোগ্যশব্দে সেই তুমি এখন কেমন যুবতী
নাকি সন্তান-সন্ততি, স্বামী নিয়ে চমৎকার রমণী,
খুব জানতে ইচ্ছে করে।
তোমার অবিশ্বাস্য মনে হবে
ভাববে, সেই কবে স্বপ্ন-আঁকা দুটো-মানুষের বিশ্বাস
তা কি এখনও প্রার্থনায় মগ্ন!
এখনও কি চোখের ভাষায় হাত তুলে জামা পরাবার কথা
কিংবা কিছুক্ষণ ঝড়ের পরে অগোছালো শরীর গুছিয়ে
গভীর বিশ্বাসে একটি প্রাণবন্ত চুমু দেয়া, মনে আছে!
বোঝো না কেনো, সুখের কথায় দুঃখ দীর্ঘ হয়,
সব মনে থাকে।
জানো, আমি এখনও চুমু দিই একজন যাচিত মাধবীকে,
তখন কে যেন আস্তে ক’রে বলে–
যাই, তারাদের দেশে প্রদীপ জ্বালানোর সময় হয়েছে।
খুব খুশি হলাম। শুভকামনা রইলো।