নতুন কিছু করি

কলমে : সাহানা

কাচের ঘোরানো দরজাটা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে পলি। হাতে টুকিটাকি সামগ্রীর কয়েকটা কাপড়ের ব্যাগ। পুজোর মাত্র কটা দিন বাকি। এর মধ্যেই সবকিছু সেরে ফেলতে হবে। কাজ কি কম!
পরিবারের সব সদস্যদের মনের মত জিনিসপত্র কেনা, ফর্দ মিলিয়ে উপহার দিয়ে আসা, এক মহা ঝক্কি!!
তারপর তো শুরু হবে…
-বুঝলি পলি, এই শাড়িটা ভালো, কিন্তু জমিটা তেমন পোক্ত নয়…কত নিল রে?
-পলিমাসি, আমার জামাটা কিন্তু একেবারে ওল্ড ফ্যাশনড্। চলবে না, বলেই দিচ্ছি। না পড়লে, দোষ দিও না!
-আরে পলি, শুধু সেলের মার্কেট থেকে বাজার করলেই চলবে? একটু স্ট্যান্ডার্ড জায়গায় কেনাকাটা করো বাপু!!

বড়ো জা আবার নির্বিরোধী।
-আহা! ওকে কেন সবাই মিলে…

হাজারটা মতামত! কথা বলে বা প্রতিবাদ করে কোনো লাভ নেই।
সংসারের একটিই নিয়ম। ভালো থাকতে চাইলে মুখটি বন্ধ রাখো। নাহলে, পরিস্থিতি যাবে আয়ত্ত্বের বাইরে!!

একমাত্র বাবা এবং মা যতদিন জীবিত ছিলেন আগলেছেন প্রাণ দিয়ে। তারপর…
পলি চুপ করেই থাকে আজকাল।
প্রথম প্রথম মৃদু প্রতিবাদ করত। কখনও গ্রাহ্য হতো কখনও নয়। ধীরে ধীরে জীবনের চলার বাঁকগুলো আরও ভাঙাচোরা আরও তীব্র হতে থাকে…একসময় মনে হয়, পলি পড়েছে জীবন নদীখাতে…
কি দরকার! অহেতুক প্রতিবাদে? সেই তো জীবন বইবে নিজস্ব গতিতেই।
অতএব চুপ থাকাই ভালো!!
একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল।
হঠাৎ পেছন থেকে আঁচলে টান পড়ে!

-কে রে?
ফিরে তাকিয়েই অবাক!
দুটো ছোট্ট ছোট্ট মুখ, শীর্ণ দেহ, গায়ে প্রায় কিচ্ছু নেই, পরণে শুধু ঢিলে রঙচটা একটা বস্তু, প্যান্ট ছিল কোনো কালে হয়তো!
-এই, তোরা কে রে? কি চাই?
অকারণেই গলাটা গম্ভীর করে তোলে।
ফিকফিক করে হাসছে! দাঁতে ময়লা ছোপ।
-খেতে দাও। দুদিন খাইনি।

এ আবার কি!
বিরক্তি বোধ করে। কিন্তু জোর করে কিছু বলতে পারে না। কেমন যেন মায়ায় মাখানো চোখগুলো। খুদে অথচ জ্বলজ্বলে।
অস্বীকার করা যায় না!
-এই তোরা কে? কোথায় থাকিস?
নিজের প্রশ্নে নিজেই অবাক হয়। কি দরকার ছিল জানবার?
-খেতে দাও।
সেই একই সুর!
পার্স খুলে দুটো দশ টাকার নোট এগিয়ে ধরে।
-এই নে। কিনে নিবি কিছু।

রাস্তার ওপারে ক্লাব। প্যান্ডেল বাঁধার কাজ চলছে। পুজো আসতে আর মাত্র এক সপ্তাহ। সব কাজ শেষ করার জন্য প্রচুর ব্যস্ততা। বেশ ক’টা দোকানপাট ও খুলেছে ওদিকে।
পলি সেইদিকে আঙুল দিয়ে দেখায়।
-না গো মা, ওদের হাতে টাকা দিওনি। দোকানে গেলেই বলবে, চুরি করেছে।
একটা কর্কশ স্বর ভেসে আসে।
স্বরের অধিকারিণী মানুষটি একদম শীর্ণদেহী। ছেঁড়া খোঁড়া কাপড়চোপড়!
-তুমি কিনে দিও।
-না গো মা, আমাকে তো দেবেই না।
তুমি কিছু দিয়ে যাও গো।
প্যান্ডেলের পাশে এরকম বেশ ক’জন লাইন দিয়ে বসে। আসন্ন পুজো উপলক্ষে দুঃস্থ মানুষের জন্য খাবারের আয়োজন করেছে ক্লাব থেকে। ঘোষণা চলছে।
পলি এক মুহূর্ত ভাবে। দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ।
তারপর দৃঢ় পদক্ষেপে রাস্তা পেরিয়ে ক্লাবে হানা দেয়।
দুজন কর্তা স্থানীয় ব্যক্তি এগিয়ে আসে।
-কি ব্যাপার, ম্যাডাম?
-আপনারা কি দুঃস্থ মানুষের জন্য কোনো ব্যবস্থা করেছেন?
-হ্যাঁ। পুজোর দিন পনেরো আগে পরে এবং পুজোর ক’দিন পেটভরে খিচুড়ির আয়োজন করা হয়েছে ক্লাব থেকে।
গদগদ স্বরে এক সদস্যের জবাব। পাঞ্জাবীতে লাগানো দলীয় ব্যাজটির দিকে তাকিয়ে ভ্রু  কোঁচকায় পলি। তকমা!!
-আর জামাকাপড়?
এবার মাথা চুলকোনর পালা।
-না, মানে… ওটা ঠিক…

সময় নষ্ট না করে হাতের ব্যাগ থেকে বেছে দুটো ব্যাগ ধরিয়ে দেয় ওদের।
-এর মধ্যে কিছু শাড়ি আছে। পাড়ায় বিলি করুন। অনেক মহিলাই আব্রুহীন দিনযাপন করে।

সদ্য পিকো করানো তাঁতের শাড়ি আর উপহার দেওয়ার জন্য কেনা ক’টা প্যাকেট নামিয়ে রাখে।

তারপর ওদের হাঁ করা মুখগুলো পেছনে ফেলে গটগট করে বেরিয়ে আসে বাইরের রোদে।
আশ্বিনের শুকনো গুমোট হাওয়া। ঘুরে ঘুরে পাক খাচ্ছে রাস্তার জঞ্জাল।
পলি সানগ্লাস নামিয়ে এদিক ওদিক দেখে।
নাহ্! সেই কচি শুকনো মুখগুলো নেই তো!
একটু এগিয়ে সেই মহিলাকে পেয়ে যায়। চট্ করে পাশের দোকান থেকে কয়েকটা রুটি আর মিষ্টি  কিনে তার সামনে দাঁড়ায়।

এই নাও। বেঁচে থাকো দিদিমণি। ভগবান ভালো করবেন গো।
এই পল্টু – মিনি এদিকে আয়, দ্যাখ্ দিদিমণি কত্ত খাবার দিয়েছে।
পলি আর দাঁড়ায় না।
ফিরতে হবে।
রাস্তা পেরিয়ে ট্যাক্সিতে ওঠার সময় একপলক তাকায় চারপাশে। বেশ হালকা লাগে। উৎসব তো দোরগোড়ায়। প্রাচুর্যের মধ্যে বসবাস করা মানুষজন চারপাশে ভিড় করে! অথচ, আলোর জেল্লাটা সরালেই একদঙ্গল উলঙ্গের মিছিল!
যাক্! একবিন্দু হলেও কিছু তো করতে পেরেছে! অন্তত একবেলার জন্যও! সেই চিরাচরিত সমালোচনা ….আর নয়, এবার নতুন কিছু ভাববে সে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *