মিরুজিন আলো (পর্ব সতেরো) ***** বিজয়া দেব

মিরুজিন আলো
(পর্ব সতেরো)

বিজয়া দেব

দেবাংশী ফোনটা রেখে জুহির ঘরের দিকে গেল। জুহিকে জানাতে হবে জগবন্ধু পারিজাতের বাড়ি গিয়ে উঠেছে। জুহির ঘরের দরজাটা ভেজানো। তবু নক করল দেবাংশী।মেয়ের ঘরে তার অবাধ প্রবেশাধিকার নেই। ঠিক কবে থেকে এভাবে চলছে মনে পরে না। বেশ কয়েকবার আলতো হাতে ঠক ঠক করার পর যখন দরজা খুলল না তখন দরজায় কান পাতল দেবাংশী। নাহ কোনও সাড়াশব্দ নেই। এবার দরজাটা খুলল দেবাংশী। ঘরে কেউ নেই। বেশ কয়েকবার ডেকেও সাড়া পাওয়া গেল না। জুহি না বলে চলে গেল! এখন শনি রবি দুদিন ছুটি। বিদেশিদের উইকেন্ড কনসেপ্ট এখানেও এসেছে। বাড়িতে নয় বাইরে গিয়ে খাওয়াদাওয়া, ঘোরাফেরা, ছুটির আমেজ কেড়ে নেওয়ার জন্যে হই হই করার অভ্যেসটা চালু হয়েছে খুব। তাদের সময়ে ছুটির দিনে বাড়িতে মাংস রান্না হত। টিভিতে সিনেমা দেখা বাড়ির সবাই বসে একসাথে খাওয়াদাওয়া গল্পগুজব এসবই হত। এখন পরিবার কি আর পরিবার আছে? কেমন যেন ছিন্নভিন্ন টুকরোটাকরা, পরিবারের সম্পর্কগুলো ছিন্ন সুতোর সাথে সংযোগে রয়ে গেছে কোনোক্রমে , যে কোনও মুহূর্তে পুরো ছিন্ন হয়ে যাবার মতোই ব্যাপার। ঘরটা আবার খুব গুছিয়ে রেখেছে জুহি। এইটা খুব ভাল যাই হোক। ওর ঘরে দেবাংশীর ঢোকাটা একদম পছন্দ করে না জুহি। ওর দেহের ভাষায় তা বুঝিয়ে দেয়। পড়ার টেবিল চমৎকার করে গুছিয়ে রেখেছে। টেবিলের ওপর দেয়ালে একটাই ছবি , একটি গাছ ও একলা এক কাক.. ধূসর নীলাভ ক্যানভাসে আঁকা। কার আঁকা? তার চোখে পড়েনি তো আগে!ছবিটা কি পারিজাতের আঁকা? কে জানে! পারিজাত আগে এ বাড়িতে আসতো এখন আর আসে না। জুহির সাথে সম্পর্কটা আর বেঁচে নেই। ওদের ভাষায় ব্রেক আপ।
ঘর থেকে বেরিয়ে আগের মতোই দরজাটা ভেজিয়ে দিল দেবাংশী। তারপর ভাবল ঘরে থেকে কীই বা করবে! আজ একা একাই উইকেন্ড উদযাপন করা যাক। ঘরদোর একটু গোছগাছ করে বেরিয়ে পরল সে।
আজ খুব ঘরোয়া রান্না খেতে ইচ্ছে করছে। তাদের বাড়িতে রবিবার দিন কত কি রান্না করতো মা। বাবা বাজার করে আনত। খেতে খেতে একটু দেরি। বিকেলে মা-র সঙ্গে একটু ঘুরে আসা। বাবার সেই চৌমাথার মোড়ে বড় ওষুধের দোকানের একপাশে বসে জমানো আড্ডা। ওষুধের দোকানটাতে আড্ডার জন্যে একটা পরিসর ছিল। বাবার ফিরতে ফিরতে দেরি হত। মা রাগারাগি করত। তাছাড়া অনেক রবিবার বিকেলে সাদাকালো টিভিতে সিনেমা। পাশের বাড়ির কাবেরীরা সিনেমা দেখতে আসত। ওদের তখনও টিভি কেনা হয়নি। এসব মনে হলে মনটা এমন ধূ ধূ করে।
-ম্যাম কি নেবেন?
চকিত হয়ে ওঠে দেবাংশী। সে তো রেস্তোরায় বসে। একটা টেবিল নিয়ে গালে হাত দিয়ে ভাবছে। অতীতটা কখন যেন দেহ থেকে খসে পড়ল।
মেনু কার্ডটা হাতে নিয়ে বসে দেবাংশী। কি খাবে এবার?
-মা?
চকিতে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে জগবন্ধু।
-তুমি এখানে?
জগবন্ধু হাত তুলে ইঙ্গিতে দেখায়। পাশের টেবিলে পারিজাত ও আরেকটি তরুণী।
-তুমি না বলে চলে এলে জগবন্ধু?
-বললে কি আর আসতে দিতেন মা? এখানেও থাকব না। এই মেয়েটি আমাকে এখানে ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। কী সব পড়াশোনা করবে। ঐ আমার মহল্লার খবর নিচ্ছে।
দেবাংশী দেখল বেশ ঝকঝকে তরুণীটি। পারিজাত উঠে আসছে এদিকেই।
-কেমন আছ মা?
কান জুড়িয়ে গেল দেবাংশীর। কতদিন কেউ মা বলে ডাকেনি। জুহি তো কোন সম্বোধন করে না।
-এই চালিয়ে যাচ্ছি বাবা। তুমি তো আজকাল আর আসো না।
-জুহি পছন্দ করে না তাই আসি না।
দেবাংশী দীর্ঘশ্বাস গোপন করল। বলল- তাহলে মা বলে ডেকেছিলে কেন? মাকে দেখার ইচ্ছে করে না?
পারিজাত ভাবে আত্মসম্মান বড় বালাই মা। ও গায়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে।
জগবন্ধুও তাকে মা ডেকেছিল। দেবাংশী ভাবে।
অচেনা মেয়েটি এদিকে আসছে। অপরিচিতা কিন্তু যেন বড্ড চেনা। কাছে এসে একটু হাসল। বলল- আমরা সবাই এক টেবিলে বসতে পারি?
সবাই এখন দেবাংশীর টেবিলে। অপরিচিতা বলল-আমি দীপশিখা। আমিও যদি আপনাকে মা বলি?
দেবাংশী মৃদু হেসে বলল- ডেকো। খুশি হবো।
দেবাংশী ভাবছে, এখানে এই টেবিলে যদি জুহি থাকত তাহলে সে-ই শুধু তাকে মা ডাকত না।
পারিজাত বলে – তুমি আজ একা? জুহি কোথায়?
দেবাংশী হেসে বলে – কখনও আমার সাথে তাকে দেখেছ পারিজাত? দুজনের পথ আলাদা যে! তোমার সাথেও তার পথচলা হল না।
দীপশিখা তাকে দেখছে। দেবাংশী বলল- খুব চেনা লাগছে। কোথাও দেখেছি কি তোমায় ?
(ক্রমশ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *