(মুক্ত গদ্য) নন্দিনী

(মুক্ত গদ্য)

নন্দিনী

ভার্গবী
একটা গ্রাম ছিল।
সে গ্রামে সবুজ ধানক্ষেত, বিশাল বটগাছ, কুল কুল করে বয়ে যাওয়া নদী, বাঁশি হাতে রাখাল বালক। কত পাখির কতরকম ডাক। সাথে কিছু মানুষ ছিল। যারা হাসতো, খেলতো, গল্প করতো, চিৎকার করে ঝগড়া করতো, আনন্দে উৎফুল্ল হতো। গ্রামের প্রান্তে রাজবাড়ী। গ্রামের গুঞ্জন পৌঁছত সে রাজবাড়ীর কানেও। রাজবাড়ী বড়ো নিয়মে বাঁধা। মাপা হাসি। কান্নাও মাপ মতো। রাজা তার মন্ত্রীকে বললো, “শোনো মন্ত্রী, বৈদ্যকে বলো ওষুধ দিয়ে গ্রামকে চুপ করাতে। ওরা বেনিয়মে চলে। এত কথা এত হাসি– আমার বাড়ি বড়ো করুন মনে হয়। সে হতে পারে না, ওদের চুপ করাও।” বৈদ্য বললো “আজ্ঞে মহারাজ।”
দুদিন ধরে নানা জরিবুটি জোগাড় করে বৈদ্য ওষুধ বানালো।
মন্ত্রী ছল করে রাজার বাড়ির থেকে রাজার পাঠানো মিষ্টি ঘরে ঘরে পৌঁছে দিল।
গ্রামের লোক মহা খুশি, তারা সে মিষ্টি খেল। শুধু সুবল মাঝির মেয়ে নন্দিনী খেল না। সে গিয়েছিল নদীতে কলসী ভরতে।
এদিকে গ্রামে সবার গলা বুজে এলো। হাজার কথার ভিড়। তারা শব্দ পাচ্ছে না।
একা নন্দিনী।
রাজা বেজায় খুশি, গ্রাম শান্ত।
শুধু শোনা যায় নদীর জলের কল কল আওয়াজ, পাখির কুজন আর রাখালের বাঁশি।
একসময় রাখালও বাঁশি বাজানো বন্ধ করলো। আর যে কেউ তাকে দূর পথে যেতে যেতে বলে যায় না চিৎকার করে “বড়ো মিঠা সুর বাজাইছিস বটে।”
যে গল্পে নন্দিনী থাকবে সে গল্পে বিশু পাগলকে থাকতেই হবে। এ গল্পেও ছিল। পাগল বিশু গান গাইতো। সে গানও এখন বন্ধ।
গ্রামটা যেন এক আস্ত প্রেতপুরী।
নন্দিনী বললো– বেশ, হবে যুদ্ধ রাজার সাথে। এ অবস্থা কি করে চলতে পারে। নন্দিনী থাকলে সে গল্পে কিশোরকেও থাকতেই হয়। স্বর হারালে কি করে বলবে তবে সদ্য কিশোর বালক উচ্চকিত কণ্ঠে “ভা.. লো.. বা.. সি..”
কেমন করে হবে রাগ- দুঃখ- ভালোবাসার প্রকাশ, অনুভবের প্রকাশ।
সুর, আর স্বর ফেরাতেই হবে। এ দাবী, ন্যায্য দাবী। ছুটলো নন্দিনী রাজার দরজায়। মুহুর্মুহু আঘাত। গোটা গ্রাম তার পেছনে। সাথে তাদের কাছে যা ছিল যাতে শব্দ হয় বাসন, যন্ত্র , ফাঁকা কলসি সে সব কিছু নিল তারা।
নন্দিনীর প্রশ্ন ছুটলো রাজার দিকে। সাথে গ্রামবাসীর জিনিসপত্র দিয়ে তৈরি বেতালা আওয়াজ। রাজা তখন বললো বৈদ্যকে ওদের শব্দ ফিরিয়ে দাও। এ আওয়াজ ভার বইতে পারিনা আমি।
নন্দিনী বললো, “রাজা দুঃখে কেউ যদি না বলে- আমি আছি.. কেউ যদি তাকালে- না বলে ভালোবাসি, কেউ যদি সুখে হা হা করে নাই হাসি, কেউ যদি কষ্টে নাই কাঁদি ডুকরে, কেউ যদি না বলে– অমন করে কাঁদে না…..তাহলে জীবন আর মৃত্যু আলাদা করবে কি উপায়ে? অভিমান শুধু নীরব হয়। বাকি অনুভূতির শব্দেই জয়।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *