লুকোচুরি / সুদেষ্ণা সিনহা
লুকোচুরি / সুদেষ্ণা সিনহা
এই শীতের দুপুরেও দর দর করে ঘামছে দীপ।উবেরে খুব হাল্কা করে এ সি চলছে।তবুও যেন শরীরটা ভাল লাগছে না তার। তার মনের মধ্যে তীব্র ঝড় চলছে। সেই ঝড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে সে ক্রমশ।তবুও বাইরে থেকে
সে যতটা সম্ভব নিরেপেক্ষ নির্বিকার।
উবেরটা ব্যারাকপুর বৃদ্ধাশ্রম পর্যন্ত যাবে। ব্যারাকপুর মেন রোডে স্বামী প্রণবানন্দের আশ্রম।সেই আশ্রমে বহু বছর ধরে বিভিন্ন সেবামূলক কাজ হয়। আশ্রমের প্রদীপ মহারাজজি ভীষণ কাজের মানুষ। তিনি আসার পর থেকে আশ্রমটার অনেক উন্নতি হয়েছে। দাতব্য চিকিৎসালয়,শিশুদের বিদ্যালয় ,বাচ্চাদের পার্ক — এগুলো তো ছিলই,এখন সংযোজন হয়েছে বৃদ্ধাশ্রম। আশ্রম সংলগ্ন জমিতে ছোট ছোট ঘর,বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য। এখানে তাদের দু বেলা খাবার ব্যবস্থা আছে। অবশ্যই নিরামিষ।প্রণবানন্দজীর আশ্রমে মাছ-মাংস-পেঁয়াজ-রসুন ঢোকে না। আশ্রমে বড় বড় দুধেলা গাই আছে। আশ্রমবাসীদের পুষ্টির অভাব হুয় না।প্রত্যেকজনের জন্য এক গ্লাস করে দুধ বরাদ্দ আছে। বৃদ্ধাশ্রমে যদি কেউ নিজে রান্না করে খেতে চায়,তা করতে পারে। বৃদ্ধাশ্রমের ঘরের একপাশটিতে উঁচু ঢালাই করা শ্ল্যাব,তার উপর ইচ্ছে করলে গ্যাস ওভেন রাখা যেতে পারে। এই আশ্রমে দাতব্য চিকিৎসালয়ও আছে।সেখানকার ডাক্তাররা বৃদ্ধাশ্রমের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের প্রতি সপ্তাহে রবিবারের দিন স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। বিকেলে শিশু পার্কে কচিকাচাদের ভিড়।পার্কে সিমেন্টের বেঞ্চ পাতা আছে।সেখানে বসলেই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সময় কেটে যাবে। সকাল,সন্ধ্যেতে মূল মন্দিরে প্রণবানন্দজীর ভোগ-রাগ-আরতি হয়। সব দিক দিয়েই এখানে বেশ সুন্দর ব্যবস্থা।
বাপ্পা,তার ছেলেবেলার বন্ধু।সেইই এই আশ্রমের খোঁজ দিয়েছিল প্রথমে।তার পরিচিত কেউ একজন এখানে থাকেন। তখন মায়ের জন্য হন্যে হয়ে দীপ বৃদ্ধাশ্রম খুঁজছে। নতুন ফ্ল্যাটে ঝুমা কিছুতেই মাকে রাখবে না। এই নিয়ে নিত্যদিন অশান্তি হচ্ছে দীপের সঙ্গে।তখনই হঠাৎ করে বাপ্পা ফোন করেছিল,”কেমন আছিস দীপ?”
দীপ মিথ্যে বলতে পারেনি।বলেছিল,”একরকম চলছে।”
“একরকম মানে কি রে?হয় বল ভালো আছি।নাহলে বল ভালো নেই।দুটোর মাঝে এরকম কথার মানে কি?”
“ভালো নেই রে।”
“কেন রে?”
“আর বলিস না।চিরদিন যা হয়ে আসছে।আমার বউ নতুন ফ্ল্যাটে মাকে নেবে না।”
“তাহলে মাসিমা কোথায় থাকবেন?”
:”এটাই তো ভাবছি।”
“কৌই বাত নেহি।ব্যারাকপুরে সুন্দর বৃদ্ধাশ্রম আছে।তুই একবার দেখে যা । তারপর পছন্দ হলে মাসীমাকে পৌঁছে দিস।”
ব্যারাকপুরে প্রণবানন্দজীর আশ্রমে দীপ এসেছিল একদিন।মহারাজজীর সাথে কথা বলে গেছে বৃদ্ধাশ্রমে মায়ের জন্য ঘরও ঠিক করে গেছে।
আজ সঙ্গে আছে তার মা মলিনাদেবী।মাকে বৃদ্ধাশ্রমেই রাখতেই যাচ্ছে দীপ।কিন্তু বলি বলি করেও কিছুতেই বৃদ্ধাশ্রমের কথাটা মাকে বলতে পারেনি সে।কথাটা মুখে আটকে যাচ্ছে।
বছর খানেক হল নাগেরবাজারে সপ্তর্ষি মলের
কাছেই একটা তিন কামরার ফ্ল্যাট কিনেছে সে।পুট্টি করে প্রমোটার ফ্ল্যাট হস্তান্তর করে দিয়েছে বেশ কুয়েক মাস আগে।দীপের বউ ঝুমার সুন্দর করে ফ্ল্যাট গোছানোর খুব শখ।ইন্টিরিয়র ডেকোরেটর দিয়ে ফ্ল্যাটটাকে নিজের মনের মত করে সাজিয়েছে সে ।মডিউলার কিচেনের কাজও প্রায় শেষের দিকে।এখন শুধু রঙ করে ফ্ল্যাটে ঢোকার অপেক্ষা। কোন ঘরে কি রঙ করবে তাও দুজনে মিলে ঠিক করে রেখেছে। এই মাসেই ভাড়াবাড়িটা ছাড়তে হবে।নতুন ঘরের মানানসই কিছু নতুন আসবাব কেনা হবে।কিছু জিনিস পালিশ করিয়ে নিলেই নতুনের মতো হয়ে যাবে।বাকি অব্যবহার্য জিনিসগুলো একে তাকে দিয়ে দেওয়া হবে।
ঘরের জিনিসপত্রের কথা উঠতেই দীপের মায়ের কথাও উঠেছিল।নতুনবাড়িতে শাশুড়িকে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে ঝুমার ভীষণ আপত্তি।দীপের খুব খারাপ লেগেছিল।সে তার মায়ের একমাত্র সন্তান।খুব অল্প বয়সে বাবাকে হারায় দীপ।বাবার মুখটাই মনে পড়ে না তার।বাবার ব্যাঙ্কের চাকরি ছিল।তার মায়ের চাকরির ব্যাপারে বাবার কলিগরা খুব সাহায্য করেছিলেন।ব্যাঙ্কে মায়ের চাকরিটা হয়ে গিয়েছিল।তারপর উদয়াস্ত পরিশ্রম করে তার মা তাকে বড় করে তুলেছিলেন।দীপের জীবনে মা-ই একমাত্র সম্বল।তাই নতুন ফ্ল্যাটে মায়ের জন্য একটা আলাদা ঘর রেখেছিল দীপ।কিন্তু একথা জানতে পেরে খুব রাগারাগি করেছে ঝুমা।
” রাবিশ তোমার চিন্তাধারা।তাহলে ওই ফ্ল্যাটে তুমি তোমার মাকে নিয়েই থাকো।ছেলেমেয়ে নিয়ে আমি বাপের বাড়ি চলে যাব।”
“তাই কি হয়!”
“আলবৎ হয়।হয় তোমার মা যাবে নাহলে আমি,যেকোন একজন থাকবে ওখানে।”
খুব খারাপ লাগলেও কোন প্রতিবাদ করেনি দীপ।
ঝুমা সাংসারিক সব ব্যাপারেই তার বাবার সাথে পরামর্শ করে। মায়ের বৃদ্ধাশ্রমে থাকার ব্যাপারে ঝুমার বাবাই প্রথম সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। বিভিন্ন জায়গায় বৃদ্ধাশ্রমের খোঁজ-খবর দিয়েছিলেন তিনি। দীপের তেমন পছন্দ হয়নি।
ব্যারাকপুরের স্বামী প্রণবানন্দজীর আশ্রমে বেশ খোলামেলা পরিবেশ।।মন্দিরে সকাল-সন্ধ্যা ধূপ-দীপ-আরতি। মায়ের একাকীত্ব লাগবে না।
“মা আ আ আ”,দীপ মাকে ডাকে।
বাতাসে শীতের রেশ।উবেরের দুলুনিতে বোধহয় ঝিমুনি এসেছিল মলিনাদেবীর। দীপের ডাকে চোখ খুলে বললেন,”কিছু বলবি? বল।”
“তোমার সঙ্গে কিছু কথা ছিল মা।জানই তো তোমাকে যে দুটো কথা বলব, বাড়িতে তো সে পরিবেশ নেই।”গলাটা বুঁজে এল দীপের।
” কেন? কিছু বলবি বাবা?”
“তুমি কোথায় যাচ্ছ জান?”
“হ্যাঁ,ব্যারাকপুর ভারত সেবাশ্রমে।”
“এখন থেকে তোমাকে ওখানে থাকতে হবে মা। আমি এমনই অপদার্থ ছেলে যে তোমাকে কাছে রাখতে পারব না,মা।”
দীপের কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল,” আমার একটুও ভাল লাগছে না।তুমি ছাড়া নতুন ফ্ল্যাটে আমার একটুকুও মন বসবে না মা।আমি পারব না মা তোমাকে ছাড়তে।”
“দূর বোকা ছেলে। এই কথা! এই নিয়ে কি কেউ মন খারাপ করে ? আমাকে বল তো,বাবা,মা কারো চিরকাল থাকে? ”
মলিনাদেবী নির্বিকার। ” তাছাড়া মেয়েটার কত কষ্ট হয় বল তো! তোদের আমিষ, আমার নিরামিষ । আজ ব্যস্ততার দিনে কে এত সাতসতের ঝামেলা পোহাবে,বল তো বাবা? তার থেকে তো এই ভাল,তুই মন খারাপ করিস না বাবা। আমার তো দিন হাতে গোনা।ঠাকুর দেবতা,ভজন,কীর্তন নিয়ে কেটে যাবে।তাছাড়া তুই মনখারাপ করলে চলে আসবি।”
ভারত সেবাশ্রমের গেটের কাছে উবের থামল। ভাড়া মিটিয়ে মাকে নিয়ে নেমে এল দীপ।গাড়ির ডিকি খুলে একটা সাবেকি ট্র্যাঙ্ক আর একটা ব্যাগ নামিয়ে দিল উবের ড্রাইভার।
ভারত সেবাশ্রমের গেট পেরিয়ে মাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল দীপ। কতদিন মাকে ভালভাবে দেখেনি সে! মায়ের মুখে শত রেখার আঁকিবুকি!মায়ের বয়সটা এক ধাপে যেন অনেকটা বেড়ে গেছে। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দীপের বুকের ভিতরটা হু হু করে উঠল। আজ ভীষণ পাপবোধ হচ্ছে তার । সত্যিই কি সে নির্দোষ!মাকে বৃদ্ধাশ্রমের নির্বাসনে পাঠাতে তার কি একটুকুও দায় নেই!নাকি নিজের সত্ত্বাটাকে লুকিয়ে রেখে সে মায়ের সাথে লুকোচুরি খেলছে আজ!
আশ্রমের দুটি ছোট ছোট ছেলের ডাকে সম্বিৎ ফিরল মা ছেলের।
” মহারাজজী ওঁনাকে ঘরে নিয়ে যেতে বললেন।”
দীপ সম্মতি দিলে একটি ছেলে মলিনাদেবীর ট্রাঙ্ক আর ব্যাগ দুহাতে তুলে নিল।আর একটি ছেলে মলিনাদেবীর হাত ধরে খুব যত্ন করে নিয়ে যাচ্ছে ঘরে।যেতে যেতে পিছনে ফিরলেন মা ।
ডাকলেন,”দীপু।” তারপর ছেলের দিকে শতজীর্ণ হাত বাড়িয়ে মলিনাদেবী বললেন,” আমার জন্য চিন্তা করিস না একদম। ভাল থাকিস বাবা।”
দীপ দেখল মায়ের ঘোলাটে চোখের কোণে জলের ধারা।