মিরুজিন আলো (পর্ব পনেরো) বিজয়া দেব

মিরুজিন আলো (পর্ব পনেরো)
বিজয়া দেব

-এভাবে রিঅ্যাক্ট করছেন কেন? এটা কেন হতে পারে না?
ক্লান্ত স্বরে পারিজাত বলে – জানি না। কেন এইভাবে রিঅ্যাক্ট করলাম তা-ও জানি না। একটা বিষাদ সিন্ধু আমাকে ঘিরে নিয়েছে, আর ধীরে একটু একটু করে সে আমাকে একটা নির্জন দ্বীপে নিয়ে যাচ্ছে, বেশ ভালোই বুঝতে পারছি।
-আমার এই পরিচয় আপনাকে কষ্ট দিচ্ছে, কিন্তু কেন? আমি তো আপনার কেউ নই।
-কেউ – ই আমার কেউ নয়। এই যে পারুলের কথা বললাম সে – ই বা আমার কে? কখনও দেখেছি? পারুলের জীবনটা আমার শোনা এক গল্প। আপনি আমার কেউ নন। তবে আজ থেকে কেউ তো হলেন।
-মানে?
-তোমাকে আমি জানতে চাই অপরিচিতা।
-আমি খুশি হলাম ওগো পথভোলা পথিক। আমার নাম দীপশিখা।

পারিজাত হাসল। দীপশিখা মুগ্ধ হল।
সন্ধ্যা উৎরে রাত, পারিজাত উঠে দাঁড়াল। রাঙাপিসির ফোন, ফেরার পথে আমার ওষুধ নিয়ে আসিস।
-চলে যাচ্ছেন?
– হ্যাঁ। রাত নামল বলে, আপনি বাড়ি যান।
-এখন বাড়ি গেলে খাব কি? আপনি আমার কাস্টমার হবেন?
-বেশ সাহস তো আপনার?
-সাহস না থাকলে খাব কি পড়ব কি?
-আবার পড়েনও?
-আমি গবেষণা করছি। বিষয় – যৌনতা ও ভারতীয় সমাজ।
-ও। আপনার গবেষণা পত্রটি ভালই হবে মনে হচ্ছে। আপনি কি বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে গবেষণাপত্রটি তৈরি করবেন বলে এই পথে নেমেছেন?
দীপশিখা হেসে উঠল। সহজসুরে বলল – না না। কারণটা একেবারেই অর্থনৈতিক। বাড়িতে ঝগড়া করে এখানে এসেছি। জিজ্ঞেস করবেন কেন ঝগড়া করেছি? আগেভাগেই উত্তরটি দিয়ে দিই, গবেষণার বিষয় বাড়ির কারো পছন্দ নয়। তাঁদের যুক্তি – যৌনতা বিষয়ে লেখালেখি,  গবেষণা এসব বাড়াবাড়ি।  ও তো সহজ সরল একটা শরীরী চাহিদা। এসব নিয়ে কীই বা করার আছে? তাছাড়া বিয়েটা ওদের কাছে খুব ইম্পর্ট্যান্ট। আমার বিয়ে দেবার তোড়জোড় শুরু হয়েছিল। তাই চলে এসেছি কলকাতা। এখন আমাকে রোজগার করে থাকতে হবে, পড়তে হবে।বাবা বলে দিয়েছে নিজে রোজগার করে গবেষণা করি যেন। বাড়ি থেকে সাহায্য পাব না। আমার মা নেই। ছোটবেলায় মারা গেছে। বাবা আরেকটা বিয়ে করেছে। বাবার এই পত্নী খুব তাড়াতাড়ি আমাকে বিয়ে দিয়ে তাড়িয়ে দিতে চায়। ঐ রূপকথার সৎমাদের মত। তবে ভদ্র মিষ্টি তার কথাবার্তা। সুতরাং চলে এলাম। এখন কি রোজগার করব? কীভাবে রোজগার করব? কাগজে একটা অ্যাড দেখে এই পথে এলাম। অ্যাডটা এইরকম ছিল – নিঃসঙ্গের সঙ্গী চাই। দৈনিক দু’ঘন্টা। নারীপুরুষ নির্বিশেষে।
-মানে?
-মানে নারীপুরুষ নির্বিশেষে। কাজটা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হল। অ্যাডটা দিয়েছে একটা এজেন্সি। কাজটা এইরকম, অসুস্থ নিঃসঙ্গের নার্সিং এর দরকার হতে পারে। নিঃসঙ্গ মহিলা কিংবা নিঃসঙ্গ পুরুষের যৌনসুখের সঙ্গী হওয়ার দরকার হতে পারে। শুধু বেড়ানোর সঙ্গী হওয়ার দরকার হতে পারে। শুধু কথা বলার সঙ্গী হওয়ার দরকার হতে পারে। এক একটা কাজে এক একরকম চার্জ। সবচাইতে বেশি হচ্ছে শয্যায়। তবে ওটা আমি নিইনি। আমার একরকমের করে হয়ে যাচ্ছে, দরকার নেই তাই।
-দরকার হলে করতেন?
-দেখুন আমার পুরো পরিবার যদি আমার ওপর নির্ভর থাকত, ঠিকঠাক খাওয়া পরা জোটাতে অসমর্থ হতাম তাহলে করতাম। করতেই হত।
-আপনি কি কাজ নিয়েছেন জানতে পারি?
– শয্যাসাথীটা ছেড়ে দিয়ে। এক পঁচাশি বছরের বৃদ্ধার সাথে কথা বলার সঙ্গীও হয়েছি। এক গে-র সাথে দু ঘন্টা কাটিয়েছি। অ্যান্ড শি ইজ ভেরি বিউটিফুল। ইউ আর অলসো ভেরি ইন্টারেস্টিং।
ঘনায়মান অন্ধকারের ভেতর দীপশিখার চোখ দুটো তারার মত ঝিকমিক করে। পারিজাত চোখ সরাতে পারে না।
দীপশিখা হেসে বলে – বেশ তো, কাস্টমার নাই বা হলেন, বন্ধু হতে পারেন তো? আমাকে একটু একটু করে ভালবেসেও দেখতে পারেন।
-ভালবাসাবাসির কাস্টমার?
-ছি ছি এসব কি বলছেন? সত্যি বলছি আপনাকে আমার ভাল লাগে।  ভালবাসার গল্প শুনিয়েছেন সেই পঁচাশি বছরের বৃদ্ধা। একেবারে উদগ্রীব হয়ে শোনার মত সে গল্প। আমাকে উনি আবার কবে ডাকবেন সেই অপেক্ষায় আছি।
-কত পেলেন সেদিন?
-প্রশ্নটা খুব একটা ভদ্রোচিত হল না কিন্তু। কত পেলাম সেটা বলা যাবে না।

(ক্রমশ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *