৬০ টাকায় বাংলাদেশ – আমার অন্য পথ ~ শান্তনু ঘোষ

৬০ টাকায় বাংলাদেশ – আমার অন্য পথ
~ শান্তনু ঘোষ
পর্ব-৭

আগে যা ঘটেছে:
দর্শনা হল্ট ষ্টেশন থেকে বেনাপোল এক্সপ্রেস উঠে পরেছি। যাব ঈশ্বরদী ষ্টেশন। আমার পাশের সীটে বসে কলেজের ছাত্রী ইয়াসমিন। ওর সাথে টুকটাক বিষয় নিয়ে কথা বলছি। ইয়াসমিনও ঈশ্বরদী যাবে। কামরায় সব সীটে যাত্রী ভর্তি। উটকো ভিড় নেই। পদ্মা নদীর উপড়ে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পার করে ট্রেন ঈশ্বরদী ষ্টেশনে এসে দাঁড়ালো । আমি নামালাম।

তারপর…
ঈশ্বরদী এক গুরুত্বপূর্ণ জংশন। চিলাহাটি – পার্বতীপুর – দর্শনা, আর সিরাজগঞ্জ লাইন এখানে এসে মিলেছে। ষ্টেশনটি অনেক পুরানো আমলের। সেই ব্রিটিশদের সময়ের। স্টেশনটি দেখলেই সেটা বেশ বোঝা যায়। পুরানো এই ষ্টেশনে একসময় অনেক গোলাগুলি চলেছিল। সে অন্য ইতিহাস। ষ্টেশনে নেমে পিঠে রুকস্যাক নিয়ে ওভার ব্রিজের দিকে হাঁটছি। এখন বেশী ভিড় নেই।

ব্রিজের অবস্থা একটু খারাপ। পুরানো ব্রিজ, অনেক দিন সংস্কার হয়নি। ধাপগুলি কোথাও কোথাও একটু নড়বড়ে হয়ে গেছে। সেই পুরানো দিনের স্টাইলে ষ্টীলের পাত আর রিভেট দিয়ে তৈরি ব্রিজ। কারণ তখন ওয়েলডিং টেকনোলজি আসেনি। এমন ব্রিজ পুরানো দিনের সাদা-কালো বাংলা সিনেমায় দেখেছি।

ব্রিজের উপরে উঠে ভাবছি এবার কোনদিকে যাব। ডান না বাম? নিজের মনের কথা শুনে ডান দিকে হাঁটা লাগালাম।

বেশ লাগছিল। খানিক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক দেখছি। ভাবতেই কেমন রোমাঞ্চ হচ্ছে যে আমি এখন বাংলাদেশে অনেকটা ঢুকে পড়েছি। কয়েক ঘণ্টা আগেই তো ভারতে ছিলাম। এখন প্রায় ৫টা বাজে। তবে ভালো আলো আছে।

আপাত দৃষ্টিতে তো তেমন কোন পার্থক্য চোখে পড়ছে না! মনে হচ্ছে যেন গুপ্তিপাড়া ষ্টেশনে নেমেছি।

মনে পড়ল, প্রিন্টিং টেকনোলজির ক্লাসে আমাদের স্যার একটা কথা বলতেন । ট্রেনে, বা গাড়িতে চড়ে কোন নতুন জায়গার উপর দিয়ে গেলে প্রথমেই মানুষের-তৈরি যে দুটি জিনিস আমাদের চোখে পড়ে, তা হল সেখানকার আর্কিটেকচার আর ছাপার হরফ। এই দুটি জিনিস নীরবে জানিয়ে দেয় যে আমরা ভিনদেশে এসে পড়েছি। তারপর আসে বাকি সব বিষয় যা পার্থক্য আরো স্পষ্ট করে ।

ঈশ্বরদী ষ্টেশনের ওভার ব্রিজে দাঁড়িয়ে আছি। দেখছি এখানকার আর্কিটেকচার আর হরফ। আর ভাবছি, ফারাক তো কিছুই চোখে পরে না। তাহলে বিভেদ টা কোথায়? আশেপাশে মানুষ সবাই প্রাণ খুলে বাংলা বলছে। আমিও তো তাই বলি। তাহলে কাঁচের দেওয়ালটা কোথায়?

দেওয়ালটা তো আসলে চিন্তার জগতে। ধর্ম-রাজনীতির জটিল মারপ্যাঁচে অনেকেই নিজেদের মানবিক বোধ হারিয়ে ফেলেছে। মানুষ দেখার আগে তারা তার ধর্ম দেখে। আর ধর্মের নামে চলে বিভাজন। আর এই ধর্মের পাঠশালা থেকেই কেউ কেউ বিভেদের পাঠ নিয়ে বেরিয়ে আসে রক্ত ঝরানোয় উন্মত্ত নেশায়। তাদের শেখানো হয়, যারা তোমার ধর্মের সামনে নতজানু নয়, কোতল কর তাদের। তবেই স্থান হবে বেহেশতে। আসলে সাধারণ মানুষ বোঝে না, যে ধর্মের নামে নেতারা মানুষকে কেমন করে বোকা বানায়, কেমন করে মগজ-ধোলাই করে। এই প্রথম ধর্মের নামে দেশভাগ হল ।

কিন্তু “ধর্ম” কাকে বলে। এ কথায় বেশীর ভাগই বলবে, কেন ওই যে মন্দির, মসজিদ, গির্জায় যা ঘটা করে করা হয়, সেগুলোই তো ধর্ম। কিন্তু তা যে ধর্ম নয়। সে কথা কে বলবে। আর বললেই বা শুনবে কজন?

আক্ষরিক অর্থে, ধী ধাতু আর গম প্রত্যয় – এই হল ধর্ম শব্দের ব্যুৎপত্তি। ধী- অর্থাৎ যা ধারণ করে, গম অর্থাৎ যা গতি আনে। মোদ্দা কথা, আমাকে যে ভাবনা-চিন্তা-ব্যবহার ধারণ করে আছে, আর তার দ্বারা আমি কি ভাবে পরিচালিত হই, তাই আমার ধর্ম। ধর্ম মানে অনুসন্ধান। মূর্তি ভাঙ্গা বা মানুষকে কচু কাটা করা নয়।

ধর্ম মানুষ সৃষ্টি করে না। মানুষ বড়জোর ধর্মমত বা রিলিজিয়ন সৃষ্টি করতে পারে। আর গোলমালটা সেখানেই। ধর্ম সৃষ্টি করে প্রকৃতি। এটা সনাতন। যা সৃষ্টির আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত একই থাকে।

আগুনের ধর্ম দহন করা। এটা মানুষ বলে দেয়নি আগুনকে। যেদিন সে আর দহন করবে না, সেদিন, আর যাই হোক, সে আগুন থাকবে না। তেমনি মানুষের ধর্ম মনুষ্যত্ব। যেদিন বা যার মধ্যে সেটা নাই, সেদিন বা তাকে আর যাই হোক মানুষ বলা যাবে না। যদিও সে মানুষের মত দেখতে একটা প্রাণী বটে।

আমি ভাবছিলাম, কাগজে আমি বিদেশে এলেও মগজে আমি নিজের দেশেই।
অনেকেই হয়ত বিরক্ত হবেন, যে ধান ভানতে শিবের গীত গাইছি কেন। আসলে এই প্রশ্ন আমার দীর্ঘ দিনের। আজও তার উত্তর খুঁজছি। বাংলাদেশে এই প্রশ্ন আমাকে আরো বেশী করে ভাবাবে, আমি জানি।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হঠাৎ কানে এল হিন্দি কথা। বেশ আশ্চর্য হলাম।
উৎস খুঁজতে চোখ ঘুরিয়ে দেখি, একজন বৃদ্ধা সিঁড়িতে বসে ভিক্ষা করছেন। নোংরা কাপড়। সামনে তোবড়ানো এলুমিনিয়ামের বাটি। চাদর মুড়ি দেওয়া। এক হাত সামনে প্রসারিত, অন্য হাতে মোবাইলে বিশুদ্ধ ছাপরার হিন্দিতে বেশ জোরে জোরে কথা বলছেন। ভাবতে পারিনি, বাংলাদেশে এসেই বিহারের বাসিন্দাকে এমন ভাবে আবিস্কার করব।

নীচে নেমে এসে দেখছি, একটু ফাঁকা জায়গা, সেখানে অনেক রিক্সা, অটো, ভ্যান গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আমি একজন অটো চালককে জিজ্ঞেস করি মন্ত্রী বাড়ির কাছে যাব। এটা কৌস্তভ আমাকে শিখিয়ে দিয়েছিল। কোন মন্ত্রী, কোন পাড়া, এসব কিছুই জানি না।

অটো চালক খুব ভাল। কি কি ভাবে গেলে কত কত ভাড়া লাগবে সব বলে দিলেন। তার মধ্যে যেটা নিলে আমার খরচ কম হবে সেটাও বলে দিলেন। নিজের অটোতে যেতে মানা করলেন। তাতে খরচ বেশী হবে। আমি তো অবাক !

ষ্টেশন চত্ত্বর থেকে বেরিয়েই সামনে দেখি পাশাপাশি দুটি মিষ্টির দোকান। একটাতে পাল রেস্টুরেন্ট লেখা। পাশেরটাও পাল সুইটস বা তেমন কিছু একটা লেখা।

আমি প্রথমটাতে ঢুকে দেখছি। খুব ছোট দোকান। সোকেসে অনেক মিষ্টি সাজানো। দেখে তেমন মন ভরল না। কলকাতার সাধারণ দোকানে এর থেকে অনেক বেশী ও নানা ধরনের মিষ্টি থাকে। অনেকে এসে কিলো কিলো দই নিয়ে যাচ্ছে। ভাবলাম এখানকার দই নিশ্চয় খুব ভালো হবে।
আমি বললাম, দাদা দই দেবেন।
মালিক জিজ্ঞেস করলেন, কয় কিলো?
আমি হেসে বলি, না না কিলো নয়। একশ গ্রামের ভাঁড় দিন।
উনি বললেন, তেমন কিছু নাই।
আমি বলি, তাহলে অল্প একটু পাওয়া যাবে না ? এখন খাওয়ার জন্য?
উনি বুঝে গেলেন, আমি ভিনদেশী। দোকানের ছেলেটিকে বললেন বড় হাঁড়ি থেকে একটু কেটে দিতে।

কথায় কথায় জানলাম, ওনাদের আত্মীয়রা পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় থাকেন। ওনাদের যাতায়াত আছে।
আমি সাহস করে জিজ্ঞেস করি, দাদা পালরা তো আমরা জানি সাধারণত মৃৎ-শিল্পী হয়। আর ঘোষেরা মিষ্টিতে। কিন্তু এখানে দেখছি আশেপাশে সব পালদের মিষ্টির দোকান ! এটা কিরকম করে হল?
উনি বললেন, হ্যাঁ, এখানে পালরাই মিষ্টি ব্যবসায় আছে অনেক পুরুষ ধরেই। যদিও দইটি তেমন বিশেষ কিছু সুস্বাদু মনে হল না।

দোকানের বাইরে দেখছি, জিলিপি ভাজা হচ্ছে। আমি কিছু না ভেবেই ৫০০ গ্রাম নিয়ে নিলাম। কৌস্তভের গেস্ট হাউসে বসে ভাগ করে খাওয়া যাবে।

এদিকে আলো কমে আসছে। এবার একটা রিক্সা নিয়ে চললাম আমার গন্তব্যের দিকে। গেস্ট হাউস।
যেতে যেতে রিক্সা চালকের সাথে টুকটাক গল্প করছি। উনি জানালেন, এই মন্ত্রীবাড়ির পাড়ায় সব ধনী লোকেরা থাকে।

গেস্ট হাউসে এসে কাউকে দেখি না। কৌস্তভ কে ফোন করি।
আমার এখন ইন্টারন্যাশনাল রোমিং চলছে। এক মিনিটে মনে হয় ২ টাকা বা তার বেশী লাগে। বেশী ব্যালান্স ভরা হয়নি। আসার পথে গেদে লোকালে বসে বসে ইন্টারন্যাশনাল রোমিং কনভারসনের কাজটা করেছিলাম। তাড়াহুড়োতে যে ফিক্সড প্যাকেজ অফারে ছিল সেটাই নিয়ে নিয়েছিলাম । তাই ভেবে ভেবে ফোন করতে হবে।

কৌস্তভের ফোন বেজেই যাচ্ছে। বাংলাদেশে পা দিয়ে এটাই আমার প্রথম কল। তাই ঠিক বুঝতেই পারছি না যে, ইন্টারন্যাশনাল রোমিং কাজ করছে কি না।

আমাকে এদিক সেদিক ঘুরতে দেখে একটি ১৭-১৮ বছরের ছেলে এসে জিজ্ঞাসা করে, আপনি কৌস্তভ স্যারের গেস্ট তো?

এই বলে বেশ খাতির করে ভিতরে নিয়ে গিয়ে আমাকে একটা ভালো ঘর দেখিয়ে দিয়ে চলে গেল। একটু পরেই ফিরে এসে বলে, স্যার ফোন করেছেন, কথা বলুন।
এই বলে ওর মোবাইলটা আমার দিকে এগিয়ে দিল। অপর প্রান্তে কৌস্তভ।

আমি হ্যালো বলতেই ওপার থেকে প্রথমেই তেড়ে একপ্রস্থ গালি দিল। একের পর এক অভিযোগ। বর্ডার পার করার পরেই কেন আমি ওকে ফোন করিনি, ট্রেনে উঠেই কেন জানাইনি, কেন ওর ফোন আমি তুলি নি…। এইসব আরো কথা। আমি ওকে একটা কথা বলে নিরস্ত করি, যে তুই অফিস থেকে ফিরে আয়, রাতে সব বলব।

আমি ওর দায়িত্ব বোধটা বুঝতে পারছি। ছোটবেলার স্কুলের বন্ধু ওর ভরসাতেই বাংলাদেশে এসেছে। এত ব্যাস্ততার মাঝেও ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে যে আমি ঠিকঠাক পৌঁছাতে পেরেছি কিনা।

স্কুলের বন্ধুরা হয়ত এমনই হয়। ১২ বছর একসাথে কাটানো। কত স্মৃতি। কত ঘটনা। সবাই সবার বেড়ে ওঠাটা জানে। তাই সেখানে কোন আগল নেই।

রাশিয়ার সহায়তায় বাংলাদেশের প্রথম পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হচ্ছে পাবনার রূপপুরে পদ্মা নদীর তীরে। পদ্মার পারে করার কারণ, এই ধরনের প্রজেক্টে প্রচুর জলের প্রয়োজন হয়। তাছাড়া পদ্মার চরে বিস্তীর্ণ খালি জমিও পাওয়া যাচ্ছে।

এই পারমানবিক কেন্দ্র বাংলাদেশের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান ও ভবিষ্যতের বাংলাদেশের চিত্রটা বদলে যাবে এই তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হবার পরে।

বাংলাদেশ তার ঢিলেঢালা ইকনমি থেকে বেরিয়ে একটা শক্ত পোক্ত অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যাবার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। দেশে যদি স্থিতিশীল সরকার থাকে, আভ্যন্তরীণ পরস্থিতি শান্ত থাকে, এবং সাবোতাজ না হয়, তবে আগামী দশ বছরে বাংলাদেশ অনেক বদলে যাবে। পদ্মা সেতু, ঢাকার মেট্রো রেল, এমন আরো উন্নয়ন চোখে পড়ার মত।

কৌস্তভদের কোম্পানি এই তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটা বড় অংশের কাজের দায়িত্ব পেয়েছে। আর সেই সূত্রেই ও এখন বাংলাদেশে পোস্টেড। বলতে গেলে কৌস্তভ এখন ওদের বাংলাদেশ অফিসের মাথা। তাই স্বাভাবিক ভাবেই প্রচুর কাজের দায়িত্ব।

ইতিমধ্যে আমি ফ্রেশ হয়ে নিয়েছি। খানিক পরে কেউ দরজায় টোকা দিল। খুলে দেখি কৌস্তভ এসেছে। আমি তো অবাক।
জিজ্ঞেস করি, কি রে এত তাড়াতাড়ি চলে এলি!
ও বলে, হ্যাঁ তুই এসছিস তাই আজ তাড়াতাড়ি এলাম। আগে বল, কি (একটা গালি দিল) ফোন এনেছিস তুই ? না ফোন যায়, না ফোন তুলিস, না ফোন করতে পারিস। এদিকে আমি চিন্তা করছি তোর জন্য !!

আমি বলি, আর বলিস না, এই ফোন যে কেমন কাজ করছে, তা আমিও ছাই বুঝতে পারছি না। যাই হোক, শোন, জিলিপি খা। গরম গরম ভাজছিল। নিয়ে এসেছি।

এদিকে গেস্ট হাউসের ছেলেটি দু কাপ চা নিয়ে এসেছে।
তার মধ্যেই, আবার কৌস্তভ গেস্ট হাউসের ছেলেটিকে ধমক দিল, কেন আমাকে এই খারাপ ঘরটা দিয়েছে। আর একটা ভালো ঘরে শিফ্ট করতে দিতে বলে দিল। এই ঘরে আমার যদিও কিছুই খারাপ নজরে পড়েনি।

আমারা চা খেতে খেতে আগামীকালের প্ল্যান করতে শুরু করি। প্রাথমিক ভাবে ঠিক হল যে, আগামীকাল নাটোরের রাজবাড়ী দেখে রাজশাহী যাওয়া হবে।

ক্রমশঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *