সরযূভিলা _____ সুদেষ্ণা সিনহা
সরযূভিলা
সুদেষ্ণা সিনহা
বেলা শেষের রোদটুকু বড় দ্রুত চলে যায়।
দোতলার বারান্দার কার্নিশ বেয়ে নীচের গ্রীল জানলা হয়ে বাগানের মাটিতে মিশে যায়।
সরযূভিলার পশ্চিমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রোদের ওমটুকু উপভোগ করেন সরযূবালা শেষবারের মতো।
একসময় সিঁদুরের টিপের মতো লাল সূর্যটা ঝুপ করে ডুবে যায় দিগন্তের অন্তরালে। চারিদিকের গাছ গাছালি আঁধার থেকে আঁধারতর। ঘরে ঘরে আলো জ্বলে ওঠে। সন্ধ্যেবেলায় শাঁখ বেজে ওঠে।
সরযূ ভিলা ভাঙা হচ্ছে।দেড় ফুট বাই এক ফুটের সাদা মার্বেল প্লেটে জ্বল জ্বল করছে খোদাই নাম ,কাঠের সদর দরজার ডান পাশে।
ইদানীং সরযূবালা ঘোলাটে জরাজীর্ণ চোখ বন্ধ করলেই
অতীতটাকে দেখতে পায় চোখের সামনে।পূব বাংলার গোলছুটের ছেলেবেলা তেমন করে মনে পড়ে না। মনে পড়ে রায়ট দাঙ্গা ,মনে পড়ে বড়দের দুশ্চিন্তা,দুর্ভাবনা,রুদ্ধশ্বাস আলোচনাসভা। নয় বছর না পেরোতেই তার বিয়ে হয়ে গেলো।ঠিক হল, তারা সবাই মিলে চলে আসবেন পূর্ব বাংলা থেকে। বাবা আর শ্বশুরমশাই অনেক বুঝিয়েছিলেন ঠাকুর্দাকে,এদেশে আর থাকা যাবে না। আপনি কিছু ভাবুন।
আম-কাঁঠালের বাগান,নারকেল-সুপারি খেত,বাঁধানো পুকুর,চন্ডীমন্ডপ,নিজের হাতে বানানো প্রাসাদের মতো বাড়ি ফেলে ঠাকুর্দা দেশত্যাগের কথা ভাবতেই পারতেন না।
দেশ ছাড়ার কথা উঠলেই ঠাকুর্দা চিৎকার করে উঠতেন, দ্যাশ বদল করবা ক্যামনে?রাতারাতি কি অন্যের দ্যাশটা আপন হইব?
অবুঝ ঠাকুর্দাকে ফেলে তারা একসময় বনগাঁ বর্ডার পেরিয়ে রাণাঘাটে এসে পৌঁছেছিলেন।
উদ্বাস্তু হয়ে এদেশে আসা। ভরা সংসার থেকে শূণ্যতা।ঢেউ এ ঢেউ এ ভেসে বেড়ানো জীবনে নোঙর ফেলতে বড় বাধা। পরিবার নিয়ে ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘোরা,কখনো বা উদ্বাস্তু কলোনীতে ঘরবাড়ি করে সাময়িক থিতু হওয়া।
সংসারের জোয়াল টানতে শশধর
কখনো নিয়েছে নাইট গার্ডের চাকরি,তো কখনো বা ট্রেনের হকার।
একা হাতে ঘর সামলেছে সরযূবালা।ফি বছর বিয়াতে বিয়াতে শরীরঅবসন্ন।অপুষ্টি অনাহার কাটিয়ে যে কটা
বাচ্চাকে বাঁচাতে পেরেছিল সেগুলোকে বড় করেছে সে একে একে।
উদ্বাস্তুদের জমিতে তৈরি বাড়ি ঘর ছেড়ে শশধর যেদিন শহরের বুকে তিন কাঠা জমি কিনে উঠে এসেছিল সেদিন সরযূবালার আনন্দের শেষ ছিল না।
প্রথমে ছিটেবেড়ার ঘরে টালির চাল,বাকি জমিতে সবজির চাষ।
অদূরে রেললাইন দিয়ে ট্রেন যেত কু উউউউ ঝিক ঝিক
আনমনা সরযূবালার মন ছুটে যেত কোন্ তেপান্তরে।
একটু একটু করে টাকা জমিয়ে আর পাঁচটা গেরস্থের মতো ভিত উঠেছিল এ বাড়ির।রান্নাঘর,শোবারঘর,বাথরুম
কালো বর্ডারে লাল মেঝে,নকসি গ্রিলের বারান্দা,দেওয়ালের চুন রঙ। এল সাদা মার্বেলে কালো অক্ষর খোদাই নেমপ্লেট,সরযূভিলা।
শশধরের মুখে হাসি,বুকে ভালবাসার গভীরতা,
সরযূবালাও আপ্লুত।তবুও স্বামীর ভালবাসার গভীরতা পরখ করতে বলেছিলেন,
— মরণ, আর নাম পেলে না বাড়ির?
শেষে আমার নামে নাম! একেবারে
খোদাই করে!
শশধর হেসেছিল।
–ও তুমি বুঝবে না গো।বাড়ির লক্ষীকেই তো সর্বাগ্রে রাখতে হয়।
শশধরের পাশে বসে গর্বে ফুলে উঠত
সরযূর বুক।
কি অক্লান্ত পরিশ্রমে আবার একটু একটু করে নিজের পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে মানুষটা।
দ্রুম দ্রুম দ্রুম দড়াম দ্রাম
সরযূভিলা ভাঙা হচ্ছে।
বাধা দিয়েছিলেন সরযূবালা।
–বাবা চোখ বুঁজতে বুঁজতেই তোরা প্রমোটারকে দিয়ে দিলি বাড়িটা?
তিন ছেলে বৌরা হিসহিসিয়ে উঠেছিল।
–নিজের ভালো পাগলেও বোঝে আর তুমি মা-
কবে যে লাভ লোকসানটা বুঝবে!
প্রমোটার রতনলাল পাকা লোক।
সরযূবালার ছেলেরাও কম যায় না।
সরযূভিলা বেচে ঢের লাভ,
তিন তিনটে ফ্ল্যাট আর জমির দাম হিসাবে মোটা টাকা, একেবারে হাতে হাতে।
আর সরযূবালা ভাগের মা হয়ে আপাততঃ তিন ছেলের সংসারে।
পাশেই একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে উঠে গেছে সরযূবালারা।
সরযূভিলা ভাঙছে।দিনভর শব্দ তান্ডব।
দ্রূম দ্রুম দ্রুম দড়াম দ্রাম দ্রাম।
লেবারগুলো ভেঙেই চলেছে ।শাবল-গাউতি-হাতুড়ি একযোগে ভেঙে দিচ্ছে সরযূ-শশধরের বড় সাধের ইমারত।
বাড়ির কঙ্কালটা বড় অযত্নে পড়ে থাকে রাতভর
স্তূপীকৃত রাবিশের মাঝে আধভাঙা দেওয়াল,কুলুঙ্গী,লোহার শিক বেরোনো খোয়ার ছাদ,অজস্র ফাটল ধরা মেঝে,পলেস্তরা খসা দেওয়াল চাঁদের আলোয় বড় অচেনা।ইঁটের পাঁজরের ফাঁদে রাতচরদের আনাগোনা।শশধরের সাজানো বাগান তছনছ।
ইদানিং ভালো ঘুম হয় না সরযূবালার।
অবসন্ন শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে দিয়ে তাকিয়ে থাকে সরযূভিলার দিকে।
দুচোখেই ছানি।ভালো ঠাওর হয় না।তবুও এক অস্পস্ট অবয়ব দেখেন সরযূভিলার ধ্বংসস্তূপের ওপর।
কে ও?
বুকের দলা পাকানো কান্নাটা উঠে আসে নীরবে,”তোমার সরযূভিলা আর নেই গো।।”ডুকরে ওঠে সরযূবালা বহুদিন পরে।