আজ আমার কলমে- মানব জীবনের চিরাচরিত সম্পর্ক আর মানসিকতা নিয়ে একান্তই কিছু মনের কথা___ কলমে-নিতু চৌধুরী।

আজ আমার কলমে- মানব জীবনের চিরাচরিত সম্পর্ক আর মানসিকতা নিয়ে একান্তই কিছু মনের কথা,,,,

কলমে-নিতু চৌধুরী।

আজ সকাল সকাল কিছু অদ্ভুত কথা মনে হচ্ছে।আমাদের জীবন চক্র চলে নানা মানুষ, নানা সম্পর্ক এককথায় সম্পর্কের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে।সম্পর্কের সমীকরণ ঠিক কি হয় জানা নেই আমার।আমার মনে হয় সামাজিক বা ব্যক্তিগত যে সম্পর্কই হোক না কেন দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিস গুলিকে যেমন করে যত্ন করতে হয় নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে, সম্পর্ক গুলোকেও সেভাবেই যত্ন করতে হয়।সেটা না করলে ,লোহায় মরচে ধরার মতো তাতেও মরচে ধরে যায় তাই জীবনে ভালো থাকতে গেলে সম্পর্ক গুলোকেও যত্ন করতে হয়।আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ঘটনা ক্রমে কতো মানুষ আসে- যায়, বলা ভালো কতো মানুষের সঙ্গেই সম্পর্ক তৈরী হয় কখনও ইচ্ছেয় বা কখনও অনিচ্ছেয়।হয়তো সম্পর্ক টেঁকে বা টেঁকে না কিন্ত সেই যে পরিচিতির দাগ লেগে যায় প্রয়োজনে বা অ -প্রয়োজনে তা কি মুছে ফেলা যায়?
বোধগম্য হলো না তো?আচ্ছা, একটু বুঝিয়ে বলি, ধরুন আপনি যখন খুব ছোট ছিলেন বাবা মা ভাই বোন বা আপনার চেনা বাড়ির পরিবেশ ছেড়ে যখন স্কুলের গন্ডিতে পা রাখলেন নতুন নতুন কিছু আপনার মতোই ক্ষুদে মানুষ দের সাহচর্যে এলেন ,পরিচিত হলেন বন্ধু নামক সম্পর্ক টার সঙ্গে। টিচার দের সাহচর্যে এলেন ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কের আওতায় পরলেন।তৈরি হলো পারিবারিক সম্পর্ক ছাড়াও বন্ধুত্বের সম্পর্ক, শিক্ষক -শিক্ষিকা-ছাত্র ছাত্রীর সম্পর্ক। কালক্রমে যতো দিন যাবে স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজ, কর্মক্ষেত্রে ও এরকম অনেক সম্পর্ক তৈরি হবে কিন্ত সেই যে স্কুলের সম্পর্কগুলো ভোলা যাবে কি?হয়তো ঝালিয়ে নিতে গেলে দেখা যাবে তাতে মরচে পরেছে ঠিকই কিন্ত মনে দাগ থেকেই গেছে। এরকম কতো সম্পর্কের সমীকরণ ঠিক মেলানোই যায় না।যেমন ধরুন শাশুড়ি-বৌমা বা জামাই-শাশুড়ী মা মায়ের মতোন বা মেয়ের মতোন, ছেলের মতোন কিন্ত মেয়ে বা ছেলে কিন্ত নয়, মায়ের মতোন কিন্ত মা নয়। শবশুর মশাই বাবার মতোন কিন্ত বাবা নন।এই সম্পর্ক গুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট দেখভাল প্রয়োজন তাই না? হঠাৎই হয়তো কাউকে ভালো লাগলো, অনেক সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেলো, এমন একটা অবস্থা হলো কোন কথা শেয়ার না করে থাকাই যাচ্ছে না।তার পর একদিন তাকে টেকেন ফর গ্রান্টেড করে দেওয়া হলো কারণ সে তো আছে সবসময়ই, ঠিক আছে, কোন ব্যাপার না কিন্ত আমরা বুঝতেই পারিনা কখন যেন অবহেলিত হতে হতে সেই সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকে।আমরা নিজেদের দৈনন্দিন জীবনে এতো দৌড়োতে থাকি যে বাবা-মা, ভাই-বোন, শবশুর-শাশুড়ি, ননদ-দেওর, বন্ধু-বান্ধব,ছাত্র-ছাত্রী-শিক্ষক-শিক্ষিকা মোট কথা যতো রকম সম্পর্কের সমীকরণ আছে তাদের টেকেন ফর গ্রান্টেড করে নিই।
তারপর আর কি, যা হওয়ার তাই হয়। কালক্রমে সেই মানসিকতা ঘুন পোকার মতো কাটতে শুরু করে সম্পর্কের অদৃশ্য সুতো গুলোকে।
তাই সম্পর্কের সুতোতে যত্নের মাঞ্জা দিতেই হবে সময় থাকতে নাহলে জীবনের চলার পথে একা হয়ে যেতে হবে।কে কি করলো ,কে কি বললো না ভেবে নিজের জীবনের সম্পর্কের ঘুড়িগুলো উড়তে থাকুক নিজের যত্নের মাঞ্জা দেওয়া সুতোয় আর লাটাই টা থাকুক উপরওয়ালার হাতে। শেষ বিচারের ভার তিনিই নিক সম্পর্ক থাকবে না থাকবে না।তাতে মরচে ধরবে না সোনার মতো উজ্জ্বল থাকবে আজীবন।
আজকাল অদ্ভুত হয়ে গেছে আমাদের দিনলিপি।আমরা ব্যক্তিগত অনুভূতির পরিসরে, নিজের চাওয়া-পাওয়ার খেয়াল রাখতে গিয়ে, কেমন যেন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো ভেসে বেড়াচ্ছি। সকাল বেলা ঘুম থেকে ওঠা থেকে রাতে শুতে যাওয়া অবধি কেমন যেন যন্ত্রচালিত মেশিনের মতো ব্যবহৃত হই।নিজে থেকে উপযাচক হয়ে কারোর খোঁজ খবর রাখতেই চাই না আবার কেউ যদি সেটা করে তাহলে ভাবি তার কোন কাজ নেই বা সম্পর্কের ক্ষেত্রে সে একটু বেশিই দূর্বল বা একটু হয়তো গায়ে পরা তাই তখন তাকে এড়িয়ে চলতেই চেষ্টা করি।ফোনের কনট্যাক্টগুলো মাঝেমধ্যে চেক করি, এমন প্রচুর নাম্বার সেভ করা আছে যাদের সাথে কথা হয়নি বহুদিন, অথচ তারাই আমাদের অভ্যাস ছিল কোনো এককালে। কেউ শুভ সকাল জানালে হোয়াটস এপ এ তবেই তাকে আমিও জানাবো নাহলে নয় এমনই মেন্টালিটি হয়েছে আমাদের।মানে ফর্ম্যালিটি ছাড়া সম্পর্কের প্রতি ভালোবাসা বা দায়িত্ব-কর্তব্য এসবের ধার ধারিনা আমরা। এমন অনেকে আছে যাদের কাছে ক্ষমা চাওয়া হয়নি ,আবার তার ভালোমন্দের খোঁজ খবর নেওয়ার কথাটাও মনে হয়নি।সেকি ভাববে, কি মনে করবে একথা ভাবতে ভাবতেই হয়তো মানুষ টা কখন পরপারে চলে গেছে। যখন জানতে পেরেছি তখন আফসোস করে কি লাভ।কত বন্ধুর সঙ্গে পুজোর প্ল্যান করতে করতেই ঝগড়া শুরু হয়েছে “তুই না গেলে, আমিও যাব না” বলা মেয়েটা একা একাই বেছে নিয়েছিল দূরত্ব। আমাদের ফোনে এমন কিছু নাম্বারও রয়ে গেছে যারা আজ বেঁচে নেই, জং ধরা গ্রিলের মতো শুধু পড়ে আছে স্মৃতিটা, কখন-সখনও ডায়াল করলে কি চেনা গলাটা পাওয়া যাবে ! কি জানি!
যেমন বছর তিনেক আগেই ফেসবুকের মাধ্যমেই খুঁজে পেয়েছিলাম আমার এক বন্ধু অয়ন কে। দু একদিন কথা ও হলো,হোয়াটস এপ নং দিলো কারণ আমার মেসেনজার ইউজ করাতে ঘোর আপত্তি। তার পর ওই গুড মর্নিং বা গুড নাইট কখনও-সখনও । বেশ কিছুদিন আমার ফোন বিকল থাকাতে গুড মর্নিং টুকুও হলোনা তার পর যথারীতি নতুন ফোন পেয়ে ওকে একটা মেসেজ করলাম ফোন খারাপের ব্যাপারে। দেখলাম সিন করেও উত্তর দিলোনা।আমিও আর কিছুই বললাম না।হঠাৎই ফেসবুকে দেখলাম অয়নের প্রোফাইল থেকে একটা পোস্ট, যে সময় আমার ফোন খারাপ ছিল, সম্ভবত সেই সময়ে কারোর করা। সেখানেই জানতে পারলাম ওর মৃত্যুর খবর। তার মানে আমার মেসেজ ও নয় হয়তো অন্য কেউ দেখেছে।আর আমি অভিমান করে বসে আছি বন্ধুর উপর যে কিনা তখন পরপারে।
ছোটোবেলায় আমরা যতো সহজে পেনসিল-রবার হারিয়ে ফেলতাম, বড়ো হয়ে ঠিক সেভাবেই “মানুষ” হারিয়ে ফেলছি,সম্পর্ক হারিয়ে ফেলছি,ভালোবাসা হারিয়ে ফেলছি, দায়িত্ব বোধ, কর্তব্য বোধ সব হারিয়ে ফেলছি কেবল মাত্র নিজের আত্ম অহংকার আর ব্যক্তিগত ইগোর জন্য। ইগনোর করতে শিখছি কেউ সেই দায়িত্ব বোধ, কর্তব্য বোধ, ভালোবাসা দেখালে। ভাবছি বড্ড বেশিই গায়ে পরা সেই মানুষটি।আসলে আমরা বড্ড বেশি বোঝদার হয়ে যাচ্ছি তাই না বন্ধুরা। রোজকার যোগাযোগ নাই বা হলো সংযোগ যেন থাকে, এটা তো জরুরি তাই না কারণ আমরা তো মানুষ, সামাজিক প্রানী তা না হলে তো জঙ্গলেই থাকতাম। আসলে আমাদের মানে মানুষ দের বুদ্ধিজীবী বলা হলেও সবথেকে বোকা কিন্ত আমরাই তাই না?
আপনাদের মতামতের অপেক্ষায় থাকলাম পাঠকগণ।
ধন্যবাদান্তে-লেখিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *