নিত্য যাত্রীর কড়চা ✒️✒️ কলমে : সাহানা
নিত্য যাত্রীর কড়চা
কলমে : সাহানা
সকাল ন’টা পনেরোর লোকালটা একদম ঠিক সময়ে স্টেশনে ঢোকে। এক মিনিট নড়চড় নেই। প্রায় বছর পাঁচেক এই ট্রেনে রোজ যাতায়াত করতে গিয়ে দেখেছি, ট্রেনের ঘড়ি ধরে পাল্লা দেয় হকার, ঝালমুড়িওলা, রুমাল বিক্রেতা, জুতো পালিশ, ঝাড়ুদার……মায় পকেটমারটি পর্যন্ত! অবাক কান্ড, ঝড়-বৃষ্টি কি প্রবল শীত উপেক্ষা করেও সবাই হাজির, কাঁটায় কাটায়! যাই হোক্, ব্যাগপত্র সামলে টুক্ করে উঠেই বরাদ্দ সিটটিতে বসে পড়ি। শিয়ালদা পর্যন্ত একটানা চলে যাব, কোনো সমস্যা নেই!
রোজকার মত আজও কামরায় ঠাসা ভিড়, শুধুমাত্র ডেইলি প্যাসেঞ্জার হিসেবে আমরা কয়েকজন বসতে পাই, নাহলে সিট আগেই দখল। এর মধ্যে চলে দাদাগিরি! দিদিগিরি ও বলা চলে।
এমনই এক দিনে…
-অ দিদিভাই, দিব্যি তো সেজেগুজে চললে, তা এই চামেলিকে দাও কিছু!
রুক্ষ গলার স্বর এবং ভঙ্গি থেকেই বৃহন্নলাকে সনাক্ত করা যায়। তাকাতে হয় না। সকলেই টুকটাক টাকা পয়সা দিচ্ছে সাধ্যমতো। হঠাৎ একটি সিট থেকে ভেসে এলো বিশ্রী কন্ঠস্বর …
এই এক হয়েছে! ঢং!
সঙ্গে ছুঁড়ে দেওয়া দু-চারটে মার্কামারা গালাগাল!
কানে যেতেই দাঁড়িয়ে পড়লো ‘চামেলি’ নামক লাল হলুদ সবুজে সজ্জিত মানুষটি। হাততালি থেমে গেল! মুহূর্তে আশেপাশের কামরা থেকে ওই দলেরই আরো কয়েকজন….ঘিরে ধরল বক্তাকে।
-অ্যাই! অ্যাই! কি হচ্ছে?
-কী হচ্ছে সেটা তো তুমি বলবে…চটুল হিন্দি গান গেয়ে শরীর মুচড়ে বলে একজন।
-রোজ তোদের পয়সা দিতে হবে? ইয়ার্কি পেয়েছিস? আবার গালাগাল।
-তোমার ইচ্ছে হলে দেবে। কিন্তু মুখ খারাপ করবে না। খবরদার!
-আলবাত করব। ট্রেন কি তোদের বাপের সম্পত্তি?
বচসা চলতে লাগল!
নিত্যযাত্রীরা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। কেউ কাগজের আড়ালে, কেউ জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখতে ব্যস্ত!
যেন কিছু ঘটছেই না!
চামেলি এবং তার দলবল উক্ত ব্যক্তিকে ভালোমত শিক্ষা দিয়ে উঁচু গলায় ঘোষণা করে…
-যা, এবারের মত ছেড়ে দিলাম। ফের যদি…
ছেঁড়া কলার এবং উস্কোখুস্কো চুলে ব্যক্তিটি চেঁচিয়ে ওঠে…
-এর শেষ দেখে ছাড়বো….
আশপাশ থেকে কেউ বলে, ছেড়ে দিন মশাই। চুপচাপ বসুন।
কামরাটা শান্ত হয়ে আসে।
এর মধ্যেই ঝালমুড়িমাখার টক-ঝাল-মিষ্টি গন্ধটা ঘোরাফেরা করে। রুমাল, সেপটিপিন, চিরুণির মত অকিঞ্চিত্কর অথচ জরুরী জিনিস ফিরি হয়।
আমার মনে পড়ে বছর দুয়েক আগের কথা।
এই ট্রেনটায় তখন রোজ উঠতো স্থানীয় মস্তান, (তথাকথিত) বিলু আর তার দলবল। চামেলিদের দলটা তখন এত বড়ো ছিল না। যথারীতি ট্রেনের দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে চার-পাঁচটি মস্তানগোছের অল্পবয়সী বিস্তর টিটকিরি এবং অশ্লীল মন্তব্য করে চলতো। অনেকেই মুখ ঘুরিয়ে নিতেন। প্রতিবাদ করতেন কেউ কেউ। একদিন…
একটি অল্পবয়সী মেয়ে কামরায় উঠতেই ভারী গোলোযোগ! যথারীতি মস্তানের দল মন্তব্য করে চলেছিলো। কিছু অশ্লীল ভাষাও কানে এলো।
হঠাৎ, আমার উল্টোদিকে বসা মেয়েটির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়লো ওদেরই একজন।
হাত ছোঁয়াতে যেতেই আমার সহ্য হলো না, প্রতিবাদ করে বসলাম।
-কি হচ্ছে কি? সরে যাও।
-আপনি বোসুন, দিদিমণি।
-না, সরে যাও এখখুনি।
-বললাম তো, চুপ করে বসুন। আপনাকে সোমমান করি।
টেনে টেনে বলে ছেলেটি।
কখন যেন সঙ্গের আরও ক’টা এসে ঘিরে ধরেছে। যাকে নিয়ে এত কান্ড, সে মেয়েটি ভয়ে জড়োসড়ো।
-সরে যান, বলছি।
-কেন, ডার্লিং? আমরা তো কিছু করিনি!
গোলাপী ওড়নাটা ধরে টান…
কামরার অনেকেই শশব্যস্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু এগোয় না। সকলেই অল্পবিস্তর জানে, কুখ্যাত বিলু মাস্তানের পকেটে ছোরা এবং একটা পিস্তল থাকে। ওগুলো ব্যবহার করে অনেককেই ‘চমকেছে’ সে!
-ছাড়ুন আমাকে, কি হচ্ছে!
ঠিক এমনি সময়ে একটা শক্ত হাত ছেলেটির ঘাড় ধরে টেনে আনে।
চমকে তাকিয়ে দেখি, চামেলি স্বয়ং!
পেছনে আরও দুজন।
-সবকটাকে আজ শিক্ষা দেবো। মেয়েদের গায়ে হাত দেওয়া!
পলকে ছুরি বের করে শাসায় বিলু, সরে যা, নাহলে মরবি।
-মরবি তুই।
একহাতের মোচড়ে ভারী অদ্ভুত কৌশলে ছুরি ধরা হাতটা পাকিয়ে ধরে চামেলি। তার শক্তির সঙ্গে এঁটে উঠতে না পেরে হাঁসফাঁস করছে তথাকথিত মস্তান!
অবস্থা দেখে অনেকেই সিট ছেড়ে উঠে আসে।
দীর্ঘদিন অত্যাচার সহ্য করা নিত্যযাত্রীদের বিরক্তি প্রকাশ পায়।
কিল, চড়, ঘুষি ইত্যাদি খেয়ে মস্তানের দল অদৃশ্য হয় ট্রেনের গতি কমলেই। এরপর থেকে আর এই নটা পনেরো’তে ওদের দেখিনি।
আর চামেলিদের দল কলেবরে বৃদ্ধি পেয়েছে!
দূর থেকে দেখা যাচ্ছে মেন স্টেশন এগিয়ে আসছে, ট্রেনের গতি কমছে। পুরোপুরি থামার আগেই এরা টুপটাপ নেমে ভিড়ে মিশে যাবে। অপদস্থ ব্যক্তিটি মুখ নামিয়ে বসে আছে!
কিছুই করার নেই। নিত্য দুর্ভোগের হাত থেকে চামেলির দল বাঁচিয়েছিল সেদিন। ওদের দলকে অস্বীকার করবে, এমন নিত্য যাত্রী কমই আছে। সুতরাং, নিত্য যাতায়াতের কড়চা-য় এদের কথা না বলে থাকি কি করে!