ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে (সপ্তদশ পর্ব) ✒️✒️ সায়ন্তন ধর
ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে (সপ্তদশ পর্ব)
সায়ন্তন ধর
আমি ব্রহ্মপুত্র পাড়ে সারাবছর না থাকলেও তিস্তা নদীর সৌজন্যে আমি যে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার সন্তান তা আগেই বলেছিলাম। কিন্তু কখনো কখনো আমাকে গুয়াহাটি যেতে গেলে এনজেপি থেকে ট্রেনে উঠতে হয়। এই যে ৪৫+৪৫=৯০ কিলোমিটার পিছিয়ে যাওয়া, এটা আমাকে মানসিক পীড়া দেয়। অযথা গঙ্গা অববাহিকায় (মহানন্দার সৌজন্যে) প্রবেশ করার কেন প্রয়োজন তা আমি বুঝি না। তবে এমনটা করতে হয় আমার কলিগদাদার জন্য। জলপাইগুড়ি রোডে সব গুয়াহাটিগামী ট্রেনের স্টপেজ নেই। কিন্তু যে ট্রেনগুলো স্টপেজ দেয়, তাদের মধ্যেও কিন্তু সিট অ্যাভাইলেবল ছিল। তবু দাদা এমন একটা ট্রেনে টিকিট কাটলো যেটা রোড স্টেশনে ননস্টপ ট্রেন। অগত্যা আমাকে এনজেপি পৌঁছতে হলো নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই। এদিকে দাদা কিছু অফিসিয়াল স্ট্যান্ডি, ফ্লেক্স আমার কাছে গচ্ছিত রেখেছিল তার বাড়ি শিফটিং এর সময়। সেই ভারী ভারী কিছু জিনিস আমাকে বয়ে নিয়ে যেতে হলো। সাথে আমার দু’দিন থাকার জামাকাপড় ও প্রয়োজনীয় জিনিস আর দু’শোটি হার্বেরিয়াম সহ দু’শো তা খবরের কাগজ। এগুলো আমি দুই মাস ধরে সংগ্রহ করেছি ডুয়ার্সের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। আমার হার্বেরিয়াম বা মায়ের মাধ্যমিকের খাতা বহনের জন্য আমাদের একটা লাল রঙা হ্যালো কিটি লেখা ব্যাগ ছিল। টানা দশ বছর সার্ভিস দিয়ে সে কিছুটা জীর্ণ। তবুও হয়তো বহনক্ষম ছিল, কিন্তু আমি রিস্ক নিলাম না। বাবা অনেক খুঁজে (কারণ শহরটা জলপাইগুড়ি, এখানে সবসময় সবকিছু সহজে পাওয়া যায় না) ওই লাল রঙেরই একটা ব্যাগ কিনে আনলো। এবারে বলি, লাল রঙই কেন… এটা ফ্যাসিনেশন নয়, এটা জরুরী। কারণ, নীল বা সবুজ রঙ ট্রেনের অন্ধকার কামরায় চোখে নাও পড়তে পারে, ফলে ভুল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই উজ্জ্বল লাল রঙকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল। এনজেপি পৌঁছে দাদার কাছে ফ্লেক্স আর স্ট্যান্ডি হ্যাণ্ডওভার করে দিলাম। এদিকে ট্রেন আসতে ঘন্টাখানেক সময় লাগবে। সুদূর গুজরাটের ওখা থেকে আসছে। ততক্ষণ ওভার ব্রীজের ওপরেই অপেক্ষা করতে লাগলাম। সুন্দর রঙীন আলোয় সাজানো হয়েছে উত্তরবঙ্গের গর্বের স্টেশনকে। আন্তর্জাতিক এই স্টেশনের পরিসেবা ও পরিকাঠামো আরও উন্নত করতে কাজ চলছে। এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে অনেক কিছু নতুনত্ব দেখলাম। প্রথম ঘন্টায় ৫০ টাকা করে ও পরের ঘন্টা প্রতি ৩০ টাকা করে এসি ওয়েটিং রুম রয়েছে যা টয় ট্রেনের বাতিল কোচ দিয়ে তৈরি হয়েছে। ওভার ব্রীজে থাকার জন্য ঠাণ্ডা হাওয়ায় শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে। এমনিতেও ঝড়ের পূর্বাভাস রয়েছে। সবে বুদ্ধপূর্ণিমা গেলো। আকাশে চাঁদ নিজেকে উজাড় করে দিচ্ছে মেঘের ঘনঘটার মাঝেও। এরপর ট্রেন এলো। নিঃশব্দে পেরিয়ে এলাম আমার শহর, তিস্তা ব্রীজ। এসি কম্পার্টমেন্টগুলো আরামদায়ক হতে পারে, তবে প্রাকৃতিক পরিবেশের সৌন্দর্য থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন করে রাখে। জানালার কাঁচগুলো এতো ঘষা যে বাইরের কোন দৃশ্য অবিকৃত অবস্থায় দেখা যায় না। মনে মনে ভাবি এই যে আমরা ডুয়ার্স পথে লোকাল ট্রেনে চাপি, জেনারেল কামরায়… আমরা কত ভাগ্যবান… প্রকৃতি ছুঁয়ে যায় আমাদের। ফ্রি ফ্লোইং বাতাস গায়ে লাগে। বাইরের থেকে আসা শব্দ পশে কর্ণকুহরে। দৃষ্টিপথে বাঁধা দিতে থাকেনা সামান্য স্ক্র্যাচও। ঝকঝকে প্রকৃতি ও আমার চোখের মাঝে থাকেনা কোন কাঁচ। হ্যাঁ ভিস্তাডোম কোচের চেয়ে বহুগুণ ভালো এই জেনারেল কামরাগুলো। তেমনই এসি কোচের তুলনায় আমার পছন্দ ননএসি স্লিপার কোচ। রাত যত বাড়ে তত এসির ঠাণ্ডা সহ্য সীমা লঙ্ঘণ করে। দূরপাল্লার ট্রেন এই অযৌক্তিক অজুহাত দিয়ে বেডরোল পেলাম না। এভাবেই রাত কাটলো। ভোর হলে একটু বাইরে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়া বেশ ভালো লাগছে। সারা রাত ধরে আলো ঢেলে ঢেলে ক্লান্ত চাঁদকে দেখাচ্ছে ম্লান। পশ্চিম আকাশে তার ঢলো ঢলো অবস্থান। রেল লাইনের ধার ঘেঁষে গুলমোহরেরা রেড কার্পেটে স্বাগত জানাচ্ছে যেন। হঠাৎ ট্রেনের শব্দ কিছুটা জোড়ালো হলো। সরাইঘাট ব্রীজ অতিক্রম করছে ট্রেন। অহনা আলোয় আমার ব্রহ্মপুত্র দর্শন। ওদিকে কামাক্ষা পাহাড়ে তখনো নেভেনি কৃত্রিম আলোগুলি… ট্রেন বিফোর টাইমে পৌঁছে গেলো কামাক্ষা জংশনে। এখানে প্রায় ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করবে তার শিডিউল টাইম ধরতে। প্ল্যাটফর্মে নেমে একটু আড়মোড়া ভেঙে নিলাম। প্ল্যাটফর্ম শেড ও ট্রেনের মাঝে যে এক চিলতে আকাশ দেখা যাচ্ছে, সেখান দিয়ে উঁকি মারছে লাল সূর্য। উত্তাপ ছড়াতে কিছুটা যেন কার্পণ্য করছে। এরপর নির্ধারিত সময়ে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। স্টেশনে নেমেই দেখা হয়ে গেলো ভারতের সবচেয়ে বেশি দূরত্ব অতিক্রম করা ট্রেন ডিব্রুগড়-কন্যাকুমারী বিবেক এক্সপ্রেসের সাথে। আমি চেয়েছিলাম স্টেশনের কাছেই একটি সস্তায় ভালো হোটেল আছে। সেখানে একরাত কাটিয়ে দিতে। কিন্তু সস্তা শুনলেই কিছু মানুষের নাকটা সিঁটকে যায়… অথচ হোটেলটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ভালো খাবারের ব্যবস্থা আছে। নেই এর মধ্যে শুধু এসি নেই। একে মনোরম আবহাওয়া চলছে। তার উপরে গুয়াহাটিতে গরম ওই জলপাইগুড়ির মতোই, সহনীয়। মাত্র সাড়ে ছয়শো টাকায় যেখানে দুজনের আরামসে হয়ে যেতো, সেখানে কলিগদাদা বুক করে বসলো সতেরোশো টাকা দিয়ে রেলের অবসরকক্ষ। ওই যে একটা কথা আছে না, ছুঁয়ে নাও আকাশ, কিন্তু মাটিতে পা রেখে… সেটারই বড় অভাব এখন। ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় দাঁড়ালাম একটু। এখান থেকে প্ল্যাটফর্ম দেখা যায়… এমনিতে সুন্দর ব্যবস্থা, তবে ট্রেনের হুইসেল ও ইঞ্জিনের শব্দ নিঃস্তব্ধতা ভঙ্গ করে চলেছে নাগাড়ে। কলিগদাদা হঠাৎ বললো যে এত যে হার্বেরিয়াম এনেছো, সব গাছের ঔষধি গুণ পেয়েছো? আমি বললাম যে এমন কোন গাছ নেই যার ভেষজ গুণ নেই, সবার এখনও পাইনি, তবে পেয়ে যাবো। যদি না পাই, তবুও একজন উদ্ভিদবিদ্ হিসেবে সঠিক গাছের স্পেসিমেন সঠিক নিয়ম মেনে ও আইডেন্টিফাই করে সংগ্রহ করা আমার কর্তব্য। এমনটা হতেই পারে যে এই একই গাছের এথনিক ব্যবহার দেশের অন্য কোন অংশে, অন্য কোন এথনিক গ্রুপের দ্বারা হয়। এই বলে আমি অফিসের সেকেন্ড বসকে আমাদের পৌঁছ সংবাদ দিয়ে দিলাম। আমাদের এবারের গুয়াহাটি আসার কারণ আমাদের নতুন ডাইরেক্টরের নর্থইস্ট সেলে আগমণ প্রথমবারের মতো। তাই ঠিক সাড়ে ন’টায় অফিসে পৌঁছানোটাই বাঞ্ছনীয়। তার জন্য গ্রীন ভ্যালির বাসে যাওয়া যেতে পারে, তাছাড়া আমার একটা ইচ্ছের কথা মনে রেখেই স্যার বললেন যে আমরা লঞ্চে ব্রহ্মপুত্র পেরিয়েও যেতে পারি। সেক্ষেত্রে প্রথমে ফাঁসিবাজার যেতে হবে অটোতে করে। কিছুটা পরিচিতি থাকায় জিজ্ঞেস করলাম ফ্যান্সি বাজার? স্যার বললেন যে ওটা আদতে ফাঁসি বাজারই। লোকমুখে বা হয়তো ইংরেজদের বদান্যতায় ফ্যান্সি হয়ে গেছে। যাই হোক সেখান থেকে লঞ্চে ব্রহ্মপুত্র পেরিয়ে মাজগাঁও ঘাট। তারপর টোটো ধরে আইআইটির ফ্যাকাল্টি গেট। আমি ঠিক করলাম স্যারের যখন প্রচ্ছন্ন মদত আছেই, তাহলে এভাবেই যাবো। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিলাম। কলিগদাদাকেও তাড়া দিলাম। ডাইরেক্টর স্যার ও উপস্থিত সকলের জন্য মকাইবাড়ির দার্জিলিং চা নিয়ে এসেছি। আসামে বসে দার্জিলিং এর তথা আমার রাজ্যের ছোঁয়া দিতে এই চায়ের যে কোন জুড়ি নেই তা বলাই বাহুল্য। এরপর কি হলো… জানতে হলে অপেক্ষা করতেই হবে আরও একটি পর্বের।
(ক্রমশঃ)