পাপ ✒️✒️ পলাশ মজুমদার
পাপ
পলাশ মজুমদার
( “এক পেয়ালা অসুখ” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেয়া )
ছোটবেলায় মাকে দেখেছি, বাবার ঘামে ভেজা শার্ট, আন্ডারওয়ার অসীম মমতায় কেঁচে শুকোতে দিতেন। বাবা প্রতিবাদ করেননি কখনও। বাবাকে কোনোদিন দেখিনি, মায়ের মেলে দেয়া শাড়ি সন্ধ্যায় ভাঁজ করে ঘরে তুলে আনতে। বাবার ঐ নিদারুণ নির্লিপ্ততাকে আমি পাপ বলি।
ঠাকুরদা, ঠাম্মাকে দেখেছি, মায়ের নিকানো উঠোনে, লেপা পোছা বারান্দায় কি নিদারুণ অবহেলায় পানের পিক ফেলতেন। যত্রতত্র জগদ্দল কফের আলপনা আঁকতেন। মা নিরবচ্ছিন্ন পরিস্কার করতেন রোজ। দাদু-ঠাম্মার অপরাধবোধহীন ঐ নির্লিপ্ততাকে আমি পাপ বলি।
‘অতিথি দেব ভব’। প্রতিদিন জনে জনে অতিথি এসে জুটতো বাড়িতে। এমনও হয়েছে, সবার শেষে মা খেতে বসবেন, অতিথি এসে হাজির। খাবার ফেলে পরমানন্দে নতুন করে রাঁধতে বসতেন মা। মাহেন্দ্রক্ষণে মায়ের হাতে হাতে কাউকে সাহায্য করতে দেখিনি। বাকিদের সেই অসহ্য নির্লিপ্ততাকে আমি পাপ বলি।
ছোটবেলায় যখন পড়তে বসতাম, সারাদিনের ক্লান্ত ঘুম জড়ানো চোখ নিয়েও মা জেগে থাকতেন। ঘুম কাটাতে চোখে জল দিতেন বারবার। লোডশেডিং পরবর্তী তালের পাখায় হাওয়া করে করে আরাম দিতেন আমাদের। আমরা মাকে জাগিয়ে রাখতাম। তার কাছ থেকে সম্বল রাতটুকুও কেড়ে নিতাম নির্লজ্জভাবে। আমাদের ছোটবেলার সেই নির্দয় নির্লজ্জতাকে আমি পাপ বলি।
সেবার অষ্টমীর দিন ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছি সবাই। মা বললেন, ঘর ফাঁকা রেখে সবাই গেলে হবে কি করে? আমি পাড়ার ঠাকুর দেখে নেবো। সবাইকে নিশ্চিন্ত করতে মা রইলেন পাহারাদার হিসেবে। আশ্চর্য! বাবা, আমরা কেউ সেভাবে অনুরোধই করলাম না মাকে। মাকে আশ্বস্ত করে বলতে পারলাম না কেউ, চুরি হয় হোক, ঘর লুটে নিয়ে যাক দস্যু দানব, তবু তুমি যাবে!
ঠাকুর দেখে, পেটপুজো সেরে রাতভোরে যখন বাড়ি ফিরি, ঘরের ঠাকুর সকলের ফেরার প্রত্যাশায় অস্থির, অভুক্ত। আমাদের সবাইকে সুস্থ দেখে তবে তিনি খেতে বসলেন।
আমাদের সকলের সেদিনকার বেহায়া নির্লিপ্ততাকে আমি পাপ বলি।
কার্য-কারণ-ফলাফল। কত কি ঘটে যায় নিঃশব্দে। ভালো, মন্দ, অঘটন, ঘটনা। সবাই নিজেরটুকু ঠিক বুঝে নেই আমরা। ছাড়ি না একবিন্দু। সাফল্যের ভাগীদার সবাই, ব্যর্থতায় দোষারোপ পরস্পরকে। সবচেয়ে বঞ্চিত যে মানুষটি, সে মা। সংসারে দাবীহীন, অণুযোগহীণ থাকতে দেখেছি একমাত্র মাকে।
মায়ের সেই প্রতিবাদহীন অদ্ভুত নির্লিপ্ততাকে আমি পাপ বলি!
মায়ের সেই অদ্ভুত নিরাসক্ত ক্ষমাসুন্দর নিরব চাহুনিকে আমি পাপ বলি।
—————————————————
কাব্যগ্রন্থ “এক পেয়ালা অসুখ” থেকে