সেদিনের কবিগান : পর্ব ২ ✒️✒️ কলমে : গীতালি ঘোষ
সেদিনের কবিগান : পর্ব ২
কলমে : গীতালি ঘোষ
কবিগানের উদ্ভব ও বিকাশের কিছু বিশেষ কারণ ছিল। এই পর্বে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক আর সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বাঙালির বিরাট বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছিল। ধীরে ধীরে সাহিত্য ও সংস্কৃতির মূল কেন্দ্র হয়ে উঠছে মানুষ, সেকালীন দেবদেবীর পরিবর্তে। কিছুটা আধুনিক মনোভাবে আচ্ছন্ন হচ্ছে সমাজ। সেই কারণে কবিয়ালরা মধ্যযুগীয় বৈষ্ণব কাব্য, শাক্ত কাব্য এবং বিভিন্ন পুরাণের কাহিনী থেকে গানের উপাদান গ্রহণ করলেও সেকালের জীবনের কথাকেও অনেক সময় গানের বিষয় করে তুলতেন। কবিওয়ালারা প্রাচীন বাংলা কাব্যের বিষয় গ্রহণ করলেও নানা যুক্তি, মানবতাবাদ ও বিভিন্ন সামাজিক বোধকেও তাদের গানে স্থান দিয়েছিলেন। তাদের সমসাময়িক নানা পরিবর্তন কবিগানকে ভীষণ ভাবে প্রভাবিত করেছিল।
কবিগানের উৎপত্তি ও উৎস নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে নানা মতানৈক্য রয়েছে। কারো কারোর মতে কবিগানের সর্বপ্রথম প্রচলন দেখা যায় শান্তিপুরে। সেখানেই প্রথম, আখড়াতেই কবির লড়াই শুরু হয় এবং পাড়ায় পাড়ায় তা ছড়িয়ে যায়। প্রাথমিকভাবে কৃষ্ণলীলার রসমাধুর্য আস্বাদন ছিল এই সংগ্রামের মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু কালক্রমে কেমন ভাবে যেন এই মাধুর্য বিকৃত হতে আরম্ভ করল। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে কবিগান ব্যবহৃত হতে দেখা গেল। প্রথম দিকের সেই মধুর সংগীত সংগ্রাম এবার পুরোপুরি কবির লড়াইএ রূপান্তরিত হল। ধীরে ধীরে শান্তিপুর থেকে বেরিয়ে কবিগান গিয়ে পৌঁছাল চুঁচুড়া, চন্দননগরের বাণিজ্যিক কেন্দ্রে। এর পর থেকেই কবিগান তার উত্তরণের পথ খুঁজে পায়। এর পরে কলকাতার বাবুসমাজে এই ধারার ঠাঁই হয়। প্রাচীন কোনো লোকসংগীতের ধারা থেকেই কবিগানের উদ্ভব হয়েছিল বলে মানা হয়। তবে তা নিয়েও বহু বিতর্ক রয়েছে।
নানান পণ্ডিতের মত ভিন্ন হলেও কবিগানের একটা স্পষ্ট পর্ববিভাগ করা যায়।
১. প্রথম পর্ব–
অষ্টাদশ শতকের পূর্ববর্তী পর্ব… যদিও এই যুগের বিশেষ কিছু তথ্য পাওয়া যায় না। শুধু অনুমান করা হয় যে এই সময় কালেও কবিগানের অস্তিত্ব ছিল।
২. দ্বিতীয় পর্ব–
অষ্টাদশ শতকের গোড়া থেকে মধ্যভাগ পর্যন্ত এই পর্ব। এই সময়েই গুঁঞ্জলা গুই কবিগানের আসরে আসেন। কেউ কেউ এনাকেই কবিগানের উদ্গাতা বলে মনে করেন। এই সময় থেকেই তার স্বনামধন্য শিষ্যদেরও দেখা মেলে, যাদের কথা পরবর্তী পর্বগুলিতে পাওয়া যাবে।
৩. তৃতীয় পর্ব–
অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগ থেকে উনিশ শতকের প্রায় তৃতীয় দশক পর্যন্ত এ পর্বকে ধরা যায়। এই সময় পাওয়া যায় হরু ঠাকুর, রাম বসু, নিতাই বৈরাগী এবং আরও কয়েকজন নামী কবিয়ালকে।
৪. চতুর্থ পর্ব–
উনিশ শতকের পরবর্তী সময়ে অনেক শক্তিশালী কবিয়ালকে পাওয়া যায়, যাদের মধ্যে ভোলা ময়রা, এন্টনি ফিরিঙ্গী, যজ্ঞেশ্বরী প্রমুখ অন্যতম। তাছাড়াও অনেক কবিয়াল গান বেঁধেছেন, আপন আপন দলকে বিখ্যাত করেছেন স্ব স্ব প্রচেষ্টায়।
কবিগান নানা ভাবে বিতর্কিত হলেও এর শিল্পগুণকেও অবহেলা করা যায় না। এগুলি একাধারে গান, কবিতা, সমালোচনা, পর্যালোচনাও বটে। সাধারণ মানুষের সমস্যা জর্জরিত জীবনের দলিল এর মধ্যেই লক্ষ্য করা যায়। কবিগান একই সাথে সমৃদ্ধ করেছে বাংলার লোকসাহিত্য ও লোকশিক্ষাকে। সেকালের বাঙালির প্রাণের কথা, মনের ভাবনা, জীবনানুভূতির সামগ্রিক পরিমণ্ডলে পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে এই কবিগান। তাই এর মূল্য অপরিসীম। রবীন্দ্রনাথের কথায় ” কথার কৌশল, অনুপ্রাসের ছটা, এবং উপস্থিত মতো জবাব ছিল কবিগানের মুখ্য আকর্ষণ।”
কবিগান সম্পর্কে সর্বপ্রথম সকলকে অবগত করান কবি ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত। কবিগানের পূর্ণাঙ্গ রূপটি ছিল দশটি বিভাগ-বিশিষ্ট, যেমন, চিতেন, পরচিতেন, ফুকা, মেলতা, মহড়া, শওয়ারি, খাদ, দ্বিতীয় মহড়া, দ্বিতীয় ফুকা ও অন্তরা। এই ব্যাপারটি কবিয়ালরা মেনে চলার চেষ্টা করতেন। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর অন্যথাও দেখা যেত। কবিগানের স্থায়িত্ব হত, হারজিৎ নিষ্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত। একদল পরাস্ত হলে তবেই সমাপ্ত হত কবিগান পালা। অনেক সময়ই রাত পার করেও পালা চলতে থাকত।
( চলবে )