মিরুজিন আলো (পর্ব দশ) বিজয়া দেব
মিরুজিন আলো (পর্ব দশ)
বিজয়া দেব
-স্যার?
জয়মাল্য চমকে তাকাল। সেই অবয়ব, যে তার পিছু নিয়েছে। আজ খুব জ্যোৎস্না। দিকবিদিক ভেসে যাচ্ছে।
-আপনার মেয়ে জুহি আপনাকে নিয়ে খুব ভাবে স্যার।
-আপনি কে? কি করে জুহিকে চেনেন? ও আমাকে ভাবে, কি করে জানেন?
-আমাকে বলে কিনা।
-আর দেবাংশী?
-ও আপনাকে ভুলে গেছে।
-ভুলে গেছে? ও।
-আপনিও ভুলে যান। অতীত ফিরে আসে না স্যার।
বরং এই ভালো, আপনার দুই ছেলে আপনার এই স্ত্রী, আপনার বাঁহাতি উপার্জন.. তবে কিনা স্যার সবকিছু একটু রয়েসয়ে.. ঐ সোনার মোটা হারটা আপনার বউএর সম্পত্তি হয়ে গেল ধরে নিন। ঐ পার্বতিয়ার বরটার অবস্থা ভালো নয়। ও আর বাঁচবে না। থাকগে ওসব কথা। চলুন একটু ঘুরে আসি। কী চন্দনের মত জ্যোৎস্না দেখেছেন। এই গাছপালা পথঘাট সব মাখামাখি হয়ে আছে। জ্যোৎস্নায় হেঁটেছেন কখনো?
সত্যি জয়মাল্য অনেকদিন এমন পাগলপারা জ্যোৎস্না দেখেনি। সে লোকটার সাথে নিবিড় জ্যোৎস্নায় মিলিয়ে গেল। কেমন যেন অবয়বহীন দেহ ভেসে ভেসে চলেছে জ্যোৎস্নায়। মাঝেমাঝে লোকটার কথা শোনা যাচ্ছে।
-এভাবে মাঝেমাঝে হারিয়ে যেতে হবে। তাকিয়ে দেখুন কী বিশাল প্রান্তর। কতগুলো বাইসন ছুটে বেড়াচ্ছে। দেখুন এটা চন্দন গাছ জ্যোৎস্নায় গা মাখা হয়ে আছে। ঐ দেখুন বরফের প্রান্তর – এসকিমোরা শ্লেজ টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তাই তো বিশাল বরফের প্রান্তর… ঐ তো এসকিমোদের শ্লেজগাড়ি টেনে নিয়ে যাচ্ছে বারোশিঙা হরিণ।
-স্যার জীবনটা প্রান্তর হয়ে ছড়িয়ে আছে, কুড়িয়ে নিতে জানতে হয়। একটা জিজ্ঞাসা ছিল স্যার।
-কি জানতে চান?
-দেবাংশী আপনাকে ভালো বাসত স্যার।
-কী করে জানলেন?
-না মানে ভুলটা মনে হয় আপনার ছিল। আঁকড়ে ধরতে চেয়েছেন বেশি। ফেলে ছেড়ে রাখতেন, ওকে পেতেন।
-ওর জন্যে আমার কোনও আফশোষ নেই।
-বেশ স্যার। কিন্তু ভেতর থেকে খুব কষ্ট পান।
চন্দন গাছের নিচে লাল লাল বীজ ছড়িয়ে আছে অনেক। জ্যোৎস্নায় তার লাল রং এর ওপর নিবিড় রূপোলি রং মিশে গিয়ে নতুন এক বর্ণাভা তৈরি করেছে। লোকটি এখন বীজ কুড়োতে লেগে গেছে। আর কথা বলছে না।
একটা নিদারুণ হট্টগোল। জয়মাল্য চোখ মেলে তাকাল। তার জানালা দিয়ে সন্ধ্যাতারা দেখা যাচ্ছে। একটি ঝলমলে তারার ভেতর তার ঘুম ভাসছিল তাহলে, স্বপ্নও ভাসছিল।
কিন্তু হট্টগোলটা কীসের। সে উঠল। বাইরে রাস্তায় হবে। এই অসময়ের ঘুমে সে কি স্বপ্ন দেখল! জুহি কি তাকে খোঁজে? সে কি জুহির জন্যে একবার শহরে যাবে?
জয়মাল্য চমকে তাকাল নীচে রাস্তায়। কে লোকটা? ভারি চেনা। সবাই মিলে মারছে কেন? কি হয়েছে? কেন মারছে? লোকটা নির্বিকার দাঁড়িয়ে মার খাচ্ছে কেন? এ তো সেই লোকটা, একটু আগে যে তার সাথে ছিল, নিবিড় জ্যোৎস্নায় মাখামাখি হয়ে যে হাঁটছিল তার সাথে। যে তাকে বোঝে জানে তার সাথে লগ্ন হয়ে আছে যারা, ছিল যারা সবাইকে চেনে। এঁকে কেন মারছে সবাই? এভাবেই মার খেতে হবে কেন? কি করেছে সে? এমন মার খাওয়া মানুষেরা তারই ছায়ার মতই বা হবে কেন?
(ক্রমশ)