#বুদ্ধ ✒️✒️ কলমে – মোনালিসা সাহা দে
#বুদ্ধ
কলমে – মোনালিসা সাহা দে
গৌতম বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নন, এমন ব্যক্তি হয়তো খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। এক আগন্তুক একসময় গৌতম বুদ্ধের কাছে জানতে চেয়েছিলেন বুদ্ধদেব কি করে এত শান্ত ও ভদ্র আচরণে থাকতে পারেন সবসময়? কেন তাঁর মুখে কোনোরকম কটুক্তি শোনা যায় না, কেন তাঁর মধ্যে কখনো ক্রোধের আস্ফালন দেখা যায় না? অথচ এই সকল রিপু তো পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষের মধ্যে বর্তমান! এই দোষ বা অপগুণের ঊর্ধ্বে তো কেউ থাকেনা।
বুদ্ধদেব স্মিতহাস্য মুখে সে আগন্তুককে এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শুধু এটুকুই বলেছিলেন “এসব কথা থাক। কারণ আমি দেখতে পাচ্ছি তোমার আয়ু আর মাত্র সাত দিন। যেভাবে পারবে এই সাতদিনে নিজের জীবনটাকে কাটিয়ে নাও।”
আগন্তুক সম্পূর্ণ স্তম্ভিত এবং মর্মাহত হয়ে ফিরে যান নিজের ঠিকানায়। সময় এগোয়। সাত দিন পরেও যখন দেখলেন তিনি মারা যাননি তখন তিনি গৌতম বুদ্ধের কাছে আবার আসেন এবং বলে ওঠেন “হে প্রভু এ আপনার কেমন লীলা!”
বুদ্ধদেব লোকটির কাছে জানতে চান এই সাত দিন তিনি কিভাবে কাটিয়েছেন! আগন্তুকটি বলেন এই সাত দিনে তার মনে অনুশোচনা এসেছে জীবনে যা যা ভুল করেছেন তার জন্য। এই সাত দিনে তিনি সকলের সঙ্গে সুব্যবহার করে গিয়েছেন, যাদের প্রতি তিনি অবিচার করেছেন, তাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন। কিছু মানুষকে ক্ষমা করে দিয়েছেন বিনা শর্তে। শোকে কাতর হয়েছেন, কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও তার মনে ক্রোধ আসেনি, বরং এগুলির মাধ্যমেই তিনি শেষ মুহূর্তের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। বুদ্ধদেব বললেন, “আশা করি তোমার প্রশ্নের উত্তর তুমি পেয়ে গিয়েছো। আমি প্রতি মুহূর্তে জীবনের সারমর্ম উপলব্ধি করি, তাই আমার আচরণ নম্র। আমি জানতাম তোমার মৃত্যু এত তাড়াতাড়ি নেই, তবু শুধুমাত্র তোমার প্রশ্নের উত্তর তোমাকে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য এমনটা বলেছিলাম, এবং এটুকু মিথ্যা বলার জন্যও আমি তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। তোমার আর কোন জিজ্ঞাস্য আছে?”
আগন্তুকের চোখ দিয়ে জল ঝরতে থাকে। তিনি নতজানু হয়ে গৌতম বুদ্ধের কাছে শ্রদ্ধাবনত হয়ে পড়েন। এত সুন্দর ভাবে জীবনের সারসত্য বোঝানো সকলের পক্ষে সম্ভব হয় কি? হয় না!
কখনো গৌতম বুদ্ধের ছবি বা মূর্তি খেয়াল করে দেখেছেন? তাঁর মাথার মধ্যে কুণ্ডলী পাকানো কেশরাশি দেখে কিছু কি কখনও মনে হয়নি? আসলে আপাতদৃষ্টিতে দেখে মনে হয় যে ওটি কেশরাশি, যা আদপেই তা নয়। সন্ন্যাস নেওয়ার পরে মুণ্ডিত মস্তকে প্রখর রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে তিনি ধ্যানমগ্ন অবস্থায় বসে থাকেন তপস্যারত হয়ে। সূর্য তখন মধ্যগগনে। তাঁর সাধনাভঙ্গ যাতে না হয় সে কথা ভেবে একটি শামুক তার স্যাঁতস্যাঁতে ও শীতল শরীর বুদ্ধের মাথায় মেলে ধরে তাঁকে স্পর্শ করে থাকে। সেই শামুকের সঙ্গী আরও একশ সাতটি শামুক একইভাবে বুদ্ধের মস্তক আবৃত করে দেয় তাদের শীতল শরীর দিয়ে। প্রখর রৌদ্রে একসময় ওই একশ আটটি শামুকই মারা যায়। ধ্যানভঙ্গের পরে বুদ্ধদেবের দু চোখ সিক্ত হয়ে ওঠে শামুকগুলির অবদান উপলব্ধি করে। সেই শামুকদের আজও শহীদের মর্যাদা দেওয়া হয়। তাই বুদ্ধমূর্তি অথবা বুদ্ধচিত্রে তাদের উপস্থিতি সচেতন ভাবে লক্ষণীয়, যা আমরা কেশরাশি ভেবে ভুল করে থাকি। এমন ভালোবাসার উদাহরণ কি সচরাচর দেখা যায়? বাস্তবে বৌদ্ধবাণীর মূল ভাবার্থই যে ভালোবাসা উদযাপন; মানুষ এবং সকল জীবজগতের প্রতি ভালোবাসা উদযাপন।
আজ বুদ্ধজয়ন্তী। আড়াই হাজার বছর আগে এই দিনে মহামতি গৌতম বুদ্ধ আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁর জন্ম, বোধিলাভ ও মহাপ্রয়াণ এই একই বৈশাখী পূর্ণিমার দিনে হয়েছিল বলে এর (বৈশাখী পূর্ণিমা) অপর নাম হয়ে ওঠে ‘বুদ্ধপূর্ণিমা’। বাস্তবে গৌতম বুদ্ধ এমন এক ব্যক্তিত্ব যাঁকে শ্রদ্ধা করার জন্য কোনো কারণ অনুসন্ধান করতে হয় না। তিনি কোনোদিন নিজেকে ঈশ্বর রূপে দাবি করেননি, কোনো অলৌকিকতার প্রচারও করেননি। তাঁর ভক্তকুল এমন শ্রদ্ধেয় রূপের জন্য তাঁকে ঈশ্বরের মর্যাদা দেন। যদিও হিন্দু শাস্ত্র মতে আজকের পূর্ণিমায় ভগবান বুদ্ধ, ভগবান বিষ্ণু ও ভগবান চন্দ্রদেবের পূজা করার বিধান রয়েছে। কারণ মতভেদে মহাত্মা বুদ্ধ ভগবান বিষ্ণুর অবতার রূপেও বন্দিত।
ত্রিপিটকে উল্লেখ আছে, জগৎ অনাচার, পাপাচারে নিমজ্জিত হলে জগতের কল্যাণে এবং মানুষকে জীবনের সঠিক পথ দেখাতে জীবের দুঃখমোচনে সম্যক সম্বুদ্ধের আবির্ভাব ঘটে। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ জাত-পাতের চরম বৈষম্য, প্রাণযজ্ঞ আর হিংসায় মানুষ যখন মেতে ওঠে, মানুষকে আলোর পথ দেখাতে বুদ্ধ ধরায় আসেন, শুরু থেকে শেষ অব্দি শুধু প্রেমের বাণীই প্রচার করে এসেছেন।
আজকের এ কলিযুগে বড় বেশি বুদ্ধদেবের অভাব অনুভূত হয়। তাঁর বাণী আমাদের সঙ্গেই রয়েছে, কিন্তু সেই সকল বাণীর সার্থকতম রূপের প্রকাশ ঘটাতে আর একবার ওনার জন্মগ্রহণ করা বড্ড প্রয়োজন, তাই না?
© মোনালিসা সাহা দে