‘ শকুন ‘ গল্প পাঠে প্রতিক্রিয়া। ✒️✒️ গীতশ্রী সিনহা
এক পাহাড় প্রমাণ ধ্বংস আর মৃতের স্তুপের ওপর দাঁড়িয়ে মানুষের বেঁচে থাকার দীর্ঘকালীন বাস্তবকে তুলে ধরেছেন হাসান আজিজুল হক।বাস্তবিকই আমাদের স্বাধীনতা – উত্তরকালে এমন প্রখর কন্ঠস্বর খুব কম শুনেছি আমরা। চারিদিকে বিভ্রান্তি ও দোলাচলে ভরা পরিস্থিতি তাঁর চেতনা স্থিত ও আপোষহীন থাকার অঙ্গিকার আমাদের বিস্মিত করেছে বার বার।
‘ শকুন ‘ গল্প পাঠে প্রতিক্রিয়া।
গীতশ্রী সিনহা
হাসান আজিজুল হকের প্রথম গল্প ‘ শকুন ‘, প্রকাশ হয়েছিল ১৯৬০ সালে। গল্পটি আমার প্রিয় গল্পের মধ্যে অন্যতম। বাস্তবকে সামনে রেখেই বাস্তবকে বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নির্মাণ তাঁর গল্পে। কাহিনীর বাইরে নিরন্তর কাজ করে চলেছে তাঁর স্মৃতি, তাঁর সত্তা, তাঁর মানবিক বোধ আর সমষ্টি জীবনের আশৈশব অভিজ্ঞতায় যারা তিল তিল করে গড়ে ওঠে। ঠিক যেন কল্পনা তাঁর সত্তারই সম্প্রসারণ। এই সত্তার মূলে আছে সমাজ বাস্তবতা। আর আছে চারিপাশের দৃশ্যমান প্রকৃতি, আর তাঁর স্বচ্ছ, সজাগ চোখে দেখা গ্রামীণ জীবনে হাভাতে মানুষ, পরিবেশ, তাদের অন্তর্নিহিত বাস্তবতা, তাঁর স্মৃতিবাহিত হয়ে যারা উঠে এসেছে এই গল্পে।
‘ শকুন ‘ গল্পের শুরুটা আমাদের এক গ্রামীণ সন্ধ্যার পরিবেশে নিয়ে যায়ঃ ‘ কয়েকটি ছেলে বসেছিল সন্ধ্যার পর, তেঁতুলগাছটার দিকে পিছন ফিরে। খালি গায়ে ময়লা হাফসার্টকে আসন করে। গোল হয়ে পা ছড়িয়ে গল্প করছিল। একটা আর্তনাদের মতো শব্দে সবাই ফিরে তাকাল। তেঁতুল গাছের একটা শুকনো ডাল নাড়িয়ে, পাতা ঝরিয়ে, সোঁ সোঁ শব্দে একটা কিছু উড়ে এলো ওদের মাথার ওপর। ফিকে অন্ধকারের মধ্যে গভীর নিকষ একতাল সজীব অন্ধকারের মতো প্রায় ওদের মাথা ছুঁয়ে সামনের পোড়া ভিটেটায় নামল জিনিসটা। ‘
তারপর হৈ চৈ করে ছেলেরা ছুটলো জিনিসটার কাছে। অনেক গবেষণা, পর্যবেক্ষণ করে ছেলেদের দল বুঝলো ওটা ‘ শকুন ‘। তবু কারও কারও মনে ভয়, ‘ ক্যা জানে, সঞ্জব্যালায় ক্যার মনে কি আচে ?… বুকে থু থু দিল। ‘ তারপর ওটা ঘিরে সবাই দাঁড়িয়ে গেল। আর দেখলো ——
‘ এক জায়গায় নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সমস্ত সুন্দর জিনিসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মতো সেই কুৎসিত জীবটা।
তারা হিংস্র কৌতুহলে প্রাণান্ত খেলায় মেতে ওঠে শকুনটাকে নিয়ে। এবং রফিক নামক ছেলেটি ‘ শকুনিটাকে ধরবুই ‘ বলে জেদ ধরে। শেষ পর্যন্ত সবাই ধরে ফেলল ওকে, আঁকড়ে জাপটে দুমড়ে… তারা বুক দিয়ে অনুভব করলো হাঁপরের মতো ফ্যাসফ্যাসে শব্দ উঠছে শকুনিটার যন্ত্রের ভিত্তিতে থেকে। দীর্ঘশ্বাসের মতো – ফাঁপা, শূন্য, ধরা পড়ার ক্লান্তির ক্ষোভের। আর তখনই লেখকের জিজ্ঞাসা… ‘ ছেলেগুলোর কৌতুহল, নিজেদের তুষ্টি, তৃপ্ত ক্লান্তিকর সম্ভাব্য পীড়ন দেওয়ার উত্তেজনাকর বক্ষস্পন্দন পাখিটা অনুভব করতে পারল কি ? ‘ শেষে ‘ দুই ডানা অসহায়ভাবে, নিরুপায় ভাবে ছড়িয়ে দিয়ে আত্মসমর্পণ করলো শকুনটা। ‘
এবার ছেলেদের ‘ দ্বিতীয় দফা দৌড়। প্রত্যাশার পিছু পিছু নয়। প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে। অকারণ নিষ্ঠুরতার সঙ্গে। আত্মতৃপ্তির নিষ্ঠুরতা ‘।
‘ শকুন ‘ প্রতীকে প্রাপ্তি। প্রাপ্তির প্রত্যাশা নিয়ে উদ্দাম আর প্রাণান্তকর পরিশ্রম তাদের। গল্পটি জুড়েই ছেলেদের ‘ শকুন ‘ ধরার প্রাণান্তকর চেষ্টার ছবি। তার বর্ণনা লেখক নিপুণভাবে করেছেন। ‘ শকুন ‘ ধরার পর ওরা ভয়ানক হুল্লোড় করে ওরা দৌড়াচ্ছে এই টানার পিছু পিছু, চেঁচাতে চেঁচাতে। অদ্ভুত রকমের মজার খেলা খেলে কি লাভ ?
‘ লাভ? তোকে দেখে লোব — তু তো শকুনি, তোর গায়ে গন্ধ, তু ভাগাড়ে মরা গরু খাস, কুকুরের সাথে ছেঁড়াছেঁড়ি করিস —- তোকে দেখে রাগ লাগে ক্যানে ?
ছেলেদের কথায় শকুনিটাকে দেখে তাদের রাগ লাগে — মনে হয় তাদের খাদ্য যেন শকুনির খাদ্য —- তাদের পোশাক যেন ওর গায়ের বিকৃত গন্ধভরা নোংরা পালকের মতো —- সুদখোর মহাজনের কথা মনে হয় ওদের দেখলেই।নইলে মহাজনকে লোকে শকুনি বলে কেন ‘।
তারপর ‘ ওরে শালা, পালাইতে চাও, শালা শকুনি, শালা সুদখোর অঘোর বোষ্ঠম।
অঘোর বোষ্ঠমের চেহারার কথা মনে করে হা হা করে হেসে উঠলো সবাই। ‘
এসবই হাসান দেখেছেন গ্রামীণ বাস্তবতায় মার খাওয়া হাড় হাভাতে হতচ্ছাড়া একদল ছেলের চোখ দিয়ে। এইখানে হাসান অসহনীয় সমাজ বাস্তবতার কদর্য দিকগুলো তল থেকে তুলে আনেন। শকুনটা হঠাৎ কখনও হয়ে ওঠে সুদখোর মহাজন, অঘোর বোষ্ঠম, কখনোবা নীচতায় ভরা নিরন্ন জীবনের আসন্ন কদাকার মৃত্যু।
শেষে শকুনিটার ঘাড় মুচকে, ঠোঁট ফাঁক করে অতি সাবধানে ছেলেরা তাকে খড়ের টুকরো খাওয়াচ্ছে।
‘ খা, শালা, মর শালা। ‘
তারপর সবাই শকুনের পালক ছিঁড়ে ছিঁড়ে নিলো।
তারপর তারা বাড়ির দিকে ফিরতে চাইলেই, —
জামু বলল, ‘ উদিকে যাস না —- চ’ ঘুরে যাই।
তোর বাড়ি তো উদিকেই —- চ ‘ দেখি না উ দুটো কি !
বাড়ি কাচে বলেই জানি উ শালা —– শালী ক্যা?
ক্যা – র্যা?
দরকার কি তোর শুনে ?
বল ক্যানে !
উ হবে জমিরদ্দি আর কাজু শ্যাখের রাঁড় বুন।
কি করচে উখানে ?
আমড়ার আঁটি? চ ‘ বাড়ি যাই। ‘
লেখক অতি অল্প কথায় অল্প ইঙ্গিতেই ছেলেদের কথায় একটি অবৈধ সম্পর্কের প্রত্যক্ষচিত্র তুলে ধরেছেন, যার ফলশ্রুতি ধরা পড়লো যখন সূর্য উঠলো, রোদ উঠলো, গাছপাতা ঝকমক করে উঠলো, তখন —— । হাসানের ভাষায়ঃ
‘ ন্যাড়া বেলতলা থেকে একটু দূরে প্রায় সকলের চোখের সামনেই গতরাতের শকুনিটা মরে পড়ে আছে। মরার আগে সে কিছু গলা মাংস বমি করেছে। কত শূন্য কতো ফাঁপা —- ঠোঁটের পাশ দিয়ে খড়ের টুকরো বেরিয়ে আছে। ডানা কামড়ে, চিৎ হয়ে, পা দুটো ওপরের দিকে গুটিয়ে সে পড়ে আছে৷ দলে দলে আরও শকুনি নামছে তার পাশেই।কিন্তু শকুনি শকুনির মাংস খায় না। মরা শকুনিটার পাশে পড়ে রয়েছে একটি মানুষের শিশু। তারই লোভে আসছে শকুনির দল,চিৎকার করতে করতে। কিন্তু শিশুটির পেটে প্রথম দুর্বল ঠোঁটের আঘাত বোধহয় মরা শকুনিটারই। ভীড় জমে গেল আস্তে আস্তে, এলো না শুধু শেখের বিধবা বোন। সে অসুস্থ। দিনের চড়া আলোয় তাকে অদ্ভুত ফ্যাকাশে দেখায় মরা শকুনিটার মতোই। ‘
হাসান এইভাবেই বাংলাদেশের মানুষের ক্রম মৃত্যুর এক ধারাবাহিক বিবরণী দেন তার গল্পে। তার গল্পের শেষ বড় মার্মান্তিক, বড় করুণ হয়ে ওঠে। অফুরান জীবনের রস অফুরানভাবে পরিবেশন করতে গিয়ে তিনি কেবলই নীলবিষ উগরে দেন।