মিরুজিন আলো ✒️✒️ বিজয়া দেব
পর্ব সাত
মিরুজিন আলো
বিজয়া দেব
ক’দিন থেকে লক্ষ করছে জয়মাল্য সে বাড়ি ফেরার পথে একজোড়া চোখ তাকে নজরে রাখছে। কে এই লোকটা? কেন তাকে নজরে রাখছে? পরপর তিনদিন একই ঘটনা ঘটল। চতুর্থ দিন সে লোকটার দিকে এগিয়ে যেতেই লোকটা লম্বা লম্বা পায়ে চলে গেল। চেহারাটা ভালো করে দেখা গেল না। মাথায় খাটো, হালকা ঠান্ডা আটকাতে গলামাথা পেঁচিয়ে একটা মাফলার জড়ানো।
রাতে ঘুমোতে যাবার সময় একটা ফোন এল। ফোনটা তুলতেই হালকা একটা কাসি। তারপর চুপচাপ।লোকটা লাইনে আছে, কথা বলছে না। শিউরে উঠল জয়মাল্য। কী ব্যাপার কিছু কি ঘটতে চলেছে? ঠিক এরমধ্যে কিছু ঘটনা ঘটেছে কিনা স্কুলে সে সেটা নিয়ে ভাবতে শুরু করল। কেউ কি তাকে ভয় দেখাচ্ছে? বেশ কিছুদিন আগে স্কুল যাবার পথে একজোড়া ছাত্র ছাত্রী পানের দোকান থেকে কীসব কিনে খেয়েছিল। মুখ লাল থুতু ফেলছিল আর হ্যা হ্যা করে হাসছিল। ডেকে বকেছিল সে। ওদের মুখ থমথম করছিল। এরবেশি কিছু নয়। পরীক্ষার হলে একটা ছাত্র ক্রমাগত পেছনের ছাত্রটিকে বিরক্ত করছিল। সে উত্তরপত্রটি কেড়ে নিয়েছিল, তার বেশি কিছু কি? হ্যাঁ ছাত্রটি কাকুতিমিনতি করেছিল আর সে উত্তরপত্রটি ফিরিয়ে দেয়নি। নাহ আর কিছু তো মনে পড়ছে না তেমন করে। তবে হ্যাঁ, মাসদুয়েক আগে একটা ঘটনা আছে। হ্যাঁ, ওটা গুরুতর হয়ে উঠতে পারে। যদিও দুমাস অতিক্রান্ত আর ব্যাপারটা শেষ হয়ে গেছে। ব্যাপারটা ছাত্রদের স্কুল ইউনিফর্ম সংক্রান্ত। হ্যাঁ হেডস্যার যে কোটেসন কল করেছিলেন তাতে যে সর্বনিম্ন চার্জ ধার্য করেছিল সেই ব্যবসায়ীটি তার শ্যালক। তাতে বাকিরা ট্যা ফোঁ করেছিল কিছুটা কিন্তু ওতে আর কী হবে! নিয়মভঙ্গ করে তো কিছু হয় নি। কিন্তু সে বেশ কিছুদিন চলে গেছে। এখন ঐ ব্যাপার নিয়ে ভয় পাওয়ানোর মত কিছু হতে পারে কিনা সেটা ভাববার বিষয়। মনটা হঠাৎ বিমর্ষ হয়ে যায় তার। তার জীবনটা কেমন একটা হয়ে গেছে। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। মাঝেমাঝে মনে হয় নিজের জীবনটা ভয়ঙ্কর একটা ভুল অঙ্ক। যা কিছুতেই মেলে না, মেলানো যায় না, যাবেও না মেলানো।
স্মৃতি ছেড়ে যায়নি তাকে। ছেড়ে যাবেও না। তার সেই তুলতুলে পুতুলের মত মেয়েটি – জুহি কত বড় হয়ে গেছে হয়তো। কেমন হয়েছে দেখতে? তার মতো না কি দেবাংশীর মত? দেবাংশী তো তার নামেরই আদ্যাক্ষরে মেয়ের নাম রেখেছিল জুহি। ভালো নামটি? কী চমৎকার! জোনাকি। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ভেতর থেকে। কিচ্ছু ভালো লাগে না। তার ও জীবনটা একটা অন্যখাতে চলে গেল দেবাংশীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর। এই বিয়েটা না করলেও চলত। বলা ভালো একটা চাকুরি সুনিশ্চিত করার জন্যে তাকে বিয়েটা করতে হয়েছে। তার বর্তমান স্ত্রী অন্নপূর্ণা। দেখতে ভালো নয়। বিয়েতে পণ ইত্যাদি প্রথা এখানে দিব্যি গেড়ে বসে আছে। এই স্কুলের তখনকার পরিচালন কমিটির প্রেসিডেন্ট ছিল অন্নপূর্ণার কাকা। তার চাকুরিটা তখন অস্থায়ী, সুতরাং পাকেচক্রে বিয়ে করতে হল অন্নপূর্ণাকে। জয়মাল্য দেখতে ভালো এবং পণের ঝামেলা বিলকুল নেই। প্রতিদানে নিজের চাকুরি স্থায়ী হল আর ওদিকে অন্নপূর্ণাকে ভেতর থেকে একটুও ভালবাসতে পারল না। গোটা ঘটনার জন্যে দায়ি তার অভিমান। দেবাংশীর সঙ্গে যাতে আর দেখা না হয় তার জন্যে জেদ। জয়মাল্য একটা বেসরকারি কলেজে পড়াত। মাইনে কম ছিল। আর দেবাংশী সরকারি চাকুরে। ভালো মাইনে পেত তখনই। ভালো পোস্টে ছিল। অহং ছিল বাইরের জগত ছিল পুরুষ বন্ধু ছিল অবাধ মেলামেশায় বিশ্বাসী ছিল। জুহি কী আদুরে ছিল। চমৎকার ফুটফুটে। এখানে তার ও অন্নপূর্ণার দুটো ছেলে মামাবাড়ির ব্যবসা সামলায়। পড়াশুনো কোনরকম গ্রাজুয়েশন অব্দি। পড়াশুনো পছন্দ করত না তেমন। দুটো ছেলেরই কোনও উচ্চাকাঙ্খা নেই। ওরা পয়সা কামাতে ভালবাসে। জয়মাল্যর নিজের খাওয়া দাওয়া আচার আচরণ পাল্টে গেছে অনেকটাই। তবে মাঝে মাঝে মনটা খারাপ হয়ে যায় খুব। ভীষণ একা লাগে। নিজের পরিবারকে এবং নিজেকেও অপরিচিত মনে হয়।
স্কুলে ব্যাপারটা বলল সে সৌজন্যকে। সৌজন্য অল্পবয়েসি ছোকরা। খুব উদ্যোগী সব ব্যাপারে। শুনে সে গম্ভীর হয়ে বলল – তোমাকে আগেই বলতে চাইছিলাম কিন্তু কাজের চাপে ভুলেই গেছি। একটা লোক তোমার খোঁজ করছিল সেদিন, লোকটির পরিচয় জিজ্ঞেস করেছিলাম কিন্তু কোনও উত্তর না দিয়ে চলে গেল। কেন খোঁজ করছে জিজ্ঞেস করলাম তাতেও কোনও উত্তর দেয়নি। খুব অদ্ভুত লাগল।
একটা আলগা চিন্তা গায়ে লেগে আছে জয়মাল্যর। ভালো লাগছে না। কে হতে পারে? কেন এমন হচ্ছে? সৌজন্য তাকে কেমন যেন খুঁটিয়ে দেখছে। হঠাৎ বলে ওঠে – তোমার সবকিছু ভালো কিন্তু ঐ বাঁহাতি অভ্যেসটা ছাড়তে হবে দাদা।
জয়মাল্য চমকে তাকাল।
সৌজন্য বলে – কে কখন কীভাবে বদলা নেবে তুমি জানো? কোনও মানে হয়?
কথাটা বলে সৌজন্য চলে গেল।
জয়মাল্য চমকে গিয়ে ভাবে সৌজন্য কীভাবে জানল! হ্যাঁ, দেয়ালেরও কান আছে।
হ্যাঁ, বাঁহাতি অভ্যেস তার হয়েছে। তেমন কিছু নয়, ছাত্র ভর্তির সময় সিট না থাকলে কিংবা ক্লাসপরীক্ষা প্রমোশন আরও দু’চারটে ইতিউতি ব্যাপারে একটু আধটু বাঁহাতি হয়ে যায়। লোকজন নিজে থেকেই অফার দেয়। সে ফিরিয়ে দেয় না এই আর কি! তবে এই অধঃপতনে মনটা খারাপ হয়ে যায়। শুধু মনে হয় এমনটা হওয়ার ছিল না। কিন্তু পাকেচক্রে হয়ে গেল।
(ক্রমশ)