পুরুলিয়ার জল সমস্যা ✒️✒️ কল্পোত্তম
পুরুলিয়ার জল সমস্যা
কল্পোত্তম
ছোটনাগপুর মালভূমির অন্তর্গত পুরুলিয়া জেলার ভূ-প্রকৃতি পশ্চিমবাংলার অন্যান্য জেলাগুলির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই জেলার উঁচু নিচু ভূ-প্রকৃতি গঠনগত দিক থেকে অন্যান্য জেলা থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে রেখেছে। ঢেউ খেলানো জমির উপর বেশিরভাগ জায়গাতে টিলা ও পাহাড়ের অবস্থান। এর ফলে নদীখাতগুলি অত্যন্ত গভীর। এই জেলার মৃত্তিকাও অন্যান্য জেলার তুলনায় রুক্ষ। নদী তীরবর্তী কিছু জায়গা বাদ দিলে বাকি সমস্ত এলাকাতেই কাঁকর আর পাথর। কিছু কিছু জায়গাতে পরিলক্ষিত হয় বেলে ও দোঁয়াস মাটির স্তর।
পুরুলিয়া জেলার প্রধান প্রধান নদীগুলি হলো দামোদর, কাঁসাই, সুবর্ণরেখা, কুমারী, দ্বারকেশ্বর, শিলাই এবং টটকো। এই সাতটি বড় নদী ছাড়াও একুশটি আরও ছোটো ছোটো নদী রয়েছে। বোঝার সুবিধার জন্য নদীগুলিকে থানা অনুযায়ী দেখতে চাইলে দেখব – হনুমাতা বয়ে চলেছে বলরামপুর হয়ে বরাবাজার থানায়। বেকো বয়ে চলেছে কাশীপুর থানায়। উত্লার অবস্থান নিতুরিয়া থানায়। পাঁড়গা নামের ছোটো একটি নদী রয়েছে জয়পুর থানায়। রুপাই রয়েছে ঝালদা থানাতে। পাতলই প্রবাহিত হয়ে চলেছে আড়ষা থানার উপর দিয়ে। জাম নদী বয়ে চলেছে মানবাজার থানার মধ্য দিয়ে। শাখা হল বাগমুণ্ডী থানা এলাকার একটি ছোটো নদী। তারা নদীর গতিপথ পুরুলিয়ার মফস্বল থানার মধ্য দিয়ে। এগুলো ছাড়াও রয়েছে কারকু, চাকা, হাড়াই, আমরু হাঁসা, লাঙ্গাসাই, শোভা, কুদলুং, বান্দু, শালদা, তসের কুয়া, কদমদা, গোয়াই, পাতলই ইত্যাদি।
এইসব ছোটো বড় নদীগুলি বাদ দিয়েও পুরুলিয়া জেলার এক একটা পঞ্চায়েতের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে তিন চারটি করে জোড়।
নদ-নদী ও জোড়ের বা অত্যন্ত সরু জলধারার কথা বাদ দিলে পুরুলিয়া জেলার বিভিন্ন জায়গাতে রয়েছে বেশ কিছু বড় বড় বাঁধ বা দিঘি। যেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো – সাহেব বাঁধ (পুরুলিয়া), সাহেব বাঁধ (আনাড়া), সাহেব বাঁধ (আদ্রা), রাণি বাঁধ (জয়পুর), বেড়োর বাঁধ (রঘুনাথপুর থানা), হরিশ্চন্দ্র সায়ের (নিতুড়িয়া), বেড়োর বাঁধ (রঘুনাথপুর থানা) ইত্যাদি। এইসব বড় বড় বাঁধ বা দিঘিগুলি বাদেও পুরুলিয়া জেলার বিভিন্ন স্থানে রয়েছে বহু জলাশয়। আছে বিভিন্ন আকার ও গভীরতা বিশিষ্ট পুকুর।
এত সংখ্যক নদনদী ও জোড় থাকা সত্ত্বেও ফাল্গুন, চৈত্র, বৈশাখ, জৈষ্ঠ এই চার মাস জলের জন্য হাপিত্যেশ করতে হয় এখানকার মানুষকে। বৃষ্টির জলে পুষ্ট নদনদী ও পুকুর ফাল্গুন মাসের শুরু থেকেই শুকিয়ে সাদা হয়ে যায়। নদীর প্রবাহ শুকিয়ে যেতেই দ্রুতগতিতে নিচে নামতে থাকে ভূ-জলস্তর। ফলে এক এক করে শুকিয়ে যেতে থাকে কুয়ো ও নলকূপ।
বিভিন্ন সময়ে ভারতবর্ষের অন্যান্য জায়গার মতো পুরুলিয়াতেও সরকারি উদ্যোগে ছোটো বড় নানা জলাধার বা ড্যাম নির্মিত হয়েছে। নেওয়া হয়েছে বহুমুখী নদী পরিকল্পনা। এদের সংখ্যাটাও নিতান্তই নগন্য নয়। পুরুলিয়াতে বড় জলাধার বা ড্যাম আছে প্রায় আঠারোটি। এগুলি হল- (১) পাঞ্চেত- নিতুড়িয়া থানা (২) মুরগুমা- বেগুনকোদরের সামনে ঝালদা থানা (৩) পুটিয়ারী- হুড়া থানা, লধুড়কার কাছে। (৪) মৌতোড়- রঘুনাথপুর থানা, চেলিয়ামার কাছে (৫) লহরিয়া – অযোধ্যা পাহাড়ের পাদদেশে, বাঘমুণ্ডি থানাতে (৬) কুমারী- বড় উরমা, বেড়াদা শিব মন্দিরের অদূরে (৭) শাখা- বলরামপুর থানায় (৮) কুলবেড়িয়া (৯) কেষ্টবাজার (১০) কফিভি – ঝালদা থানা (১১) ফুলঝরণা- আড়ষা থানা (১২) তারা- পুরুলিয়া মপস্বলে (১৩) গোলামারা (১৪) যমুনা – পুরুলিয়া মফস্বল থানা (১৫) রামচন্দ্রপুর- সাঁতুড়ি থানা (১৬) ফতেপুর (১৭) পিঠাজোড় (১৮) সাহার জোড়।
এইসব জলাধারের প্রায় প্রতিটা থেকেই কোথাও একটা বা কোথাও দুটো খাল কাটা হয়েছে জলাধারের জল নিয়ে গিয়ে চাষ-বাসের কাজে লাগানোর জন্য। কিন্তু সারা বছর যথেষ্ট পরিমাণে জলাধারে জল না থাকায় সেইভাবে চাষবাস করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
গ্রামে-গঞ্জে ও শহরে সর্বত্র রয়েছে সরকারি ও বেসরকারি ভাবে নির্মিত অসংখ্য পাতকুয়া। । রয়েছে বিশাল বিশাল কিছু ইদারা। এগুলিই এখানকার মানুষের পানীয় জলের চাহিদা মেটানোর একমাত্র উপায়। এখন জনসংখ্যা বেড়ে ওঠার সাথে সাথে এগুলি প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট কম হয়ে উঠেছে। এছাড়া যথাযোগ্য সংস্কারের অভাবে বেশিরভাগই মজে গিয়ে রয়েছে মৃতপ্রায় অবস্থায়।পঞ্চায়েতের উদ্যোগে আরও কিছু পুকুর খনন হলেও তা যথেষ্ট নয়। পঞ্চায়েত থেকে নির্মিত নলকূপ গুলির গভীরতা যথেষ্ট না থাকায় গ্রীষ্মের শুরুতেই শুকিয়ে যায়।
পুরুলিয়া জেলার বহু অঞ্চলের মানুষকে এখনো পানীয় জলের জন্য নির্ভর করতে হয় শুকিয়ে যাওয়া নদীর ধবধবে বালুরাশির মাঝে খনন করা চুঁয়ার ওপর। এখনও দেখা যায় গ্রামাঞ্চলের মানুষ সারবেঁধে জল আনতে যায় নদীতে।
বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই জলের সমস্যা আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। বর্ষা এবং বর্ষা পরবর্তী সময়ে স্বাভাবিক বৃষ্টি না হওয়ার কারণে একটা বা দুটো বৃষ্টির জন্য যথেষ্ঠ ধানের ফসল পাচ্ছে না চাষিরা।
আষাঢ় শ্রাবণ মাসে যথেষ্ট বৃষ্টি না হওয়ায় পুষ্টিমান চারা তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপর যথেষ্ট বৃষ্টির অভাবে পুরোদমে ধান রোপন করতেও পারছে না চাষিরা।
বর্ষা পরবর্তী সময়ে যে বৃষ্টিপাত হয় তার উপর নির্ভর করেই পুরুলিয়ার বিভিন্ন এলাকাতে রবি ফসল এবং গ্ৰীষ্মকালীন ফসল বা শাক সবজি চাষ করা হয়ে থাকে। সব এলাকাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রাকৃতিক জলের সুবিধা পাওয়া যায় না । উপযুক্ত জল সেচের ব্যবস্থাও প্রায় নেই। জলাধারে পর্যাপ্ত জল না থাকায় খালপথে জল দেওয়া সম্ভব হয় না। তাই স্বাভাবিক ভাবেই রবি ফসল এবং গ্ৰীষ্মকালীন ফসল থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ে বেশিরভাগ অঞ্চলের মানুষ।
অযোধ্যা পাহাড় সংলগ্ন ব্লকগুলির বেশ কিছু এলাকাতে কূঁয়ো খুঁড়লেও জল পাওয়া যায় না। মাটির সামান্য নিচেই পাথরের স্তর থাকায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে নলকূপ খনন করেও পাওয়া যায় না জল। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, বড় উরমাতে কেবলমাত্র হাই স্কুলের সামনে থাকা নলকূপ থেকেই পাওয়া যায় পানীয় জল। এত বড় বস্তির সমস্ত মানুষকে চেয়ে থাকতে হয় ঐ স্থানে থাকা দু’টা নলকূপের উপর।
উরমার সামনের গ্ৰাম বেড়াদার তিন দিক নদী দিয়ে ঘেরা। গ্ৰীষ্মকালে স্নানের জলের সমস্যায় পড়তে হয় তবুও। বৃষ্টির জলে পুষ্ট কুমারী নদীর জলের ধারা শুকিয়ে যায় ফাল্গুনের মাঝামাঝি সময়ে। তখন বালিতে এক দেড় মানুষ গর্ত খুঁড়ে বার করতে হয় জল।
এই জল দিয়েই কেউ কেউ সামান্য চাষবাস করে থাকে নিজের পরিবারের জন্য। অনেক গুলো নলকূপ রয়েছে। পানীয় জল নিতে হয় সেখান থেকেই। নলকূপগুলো হওয়ার পর ব্যবহার কমে আসায় মোটা হয়েছে পাতকূঁয়োর জল।পান করতে গেলে আটকে যায় গলায়। গিলতে ইচ্ছা যায় না। মাঝে মাঝে গিলতে হয় তবুও। নলকূপ খারাপ হলে উপায় থাকে না মানুষের।
সামনেই কুমারী জলাধার। হাফ কিমি দূরে থই থই করে জল। সকাল বিকেল বেরোলেই মাছ, গুগলি, কত রকম শাক। তরকারির অভাব হয় না কখনও। জলাধারে জল না থাকায় সে সবও নেই আর। শীত এবং গ্ৰীষ্মকালীন পাখিরাও কোথায় যেন হারিয়ে গেল। চোখে পড়ে না কাদাখোঁচা, সারস, টেঁটই, কঁচগুগলি প্রভৃতি পাখিদেরও।
শুধুমাত্র কুমারী জলাধার নয়, অন্যান্য জলাধার থেকেও উধাও হয়ে যাচ্ছে এইসব পাখিরা। উধাও হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। কিছুদিন আগেও যে সকল মাছ পাওয়া যেত, এখন আর পাওয়া যায় না।
বৃষ্টির জলে পুষ্ট পুরুলিয়া উপযুক্ত বৃষ্টির অভাবে দিন দিন রুক্ষ হয়ে উঠছে আরও। যার ফলে চাষবাস হচ্ছে না। অর্থের অভাবে মানুষকে ছুটতে হচ্ছে ভিনরাজ্যে। পুরুলিয়া জেলার প্রায় প্রতি পরিবারেরই এক দু’জন সদস্য বাইরে রয়েছে। বাইরে না গেলে বর্তমান সময়ে পারিবারিক অর্থের জোগান দেওয়া কোনভাবেই সম্ভব হয়ে ওঠে না।
অর্থনৈতিক দিক থেকে পুরুলিয়া জেলার পিছনের সারিতে চলে আসার প্রধান ও একমাত্র কারণ এই চাষের জলের ঘাটতি। এই সমস্যার সমাধান না হলে অর্থনৈতিক দিক থেকে এই জেলার অবস্থান সামনের সারিতে আসা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
কল্পোত্তম/২৫/৫/২০২১
________________