ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে (একাদশ পর্ব) সায়ন্তন ধর
ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে (একাদশ পর্ব)
সায়ন্তন ধর
ব্রহ্মপুত্রের চর থেকে ফিরে এলাম সন্ধ্যায়। রাতে আবাসিক ক্রিশ্চান শিশু ছাত্রছাত্রীরা আসন্ন বড়দিন উৎসব পালণের জন্য রিহার্স্যাল দিচ্ছিলো। বাইরে আধো আলো আধো ছায়ায় ব্যালকনিতে একা দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে সে সুর শুনছিলাম। দ্বিতীয় দিনের মিটিং শুরু হলো স্বাভাবিক ভাবেই। তবে লাঞ্চের পর থেকেই স্থানীয় দুই কলিগবন্ধুর মধ্যে চাপা উত্তেজনা লক্ষ্য করছিলাম। ঐ দু’জন মাঝে মধ্যেই মোবাইল ফোনে নিউজ আপডেট দেখছিলো। একসময় সম্ভাবনাকে সত্য প্রমাণিত করে তারা স্যর -কে বললো যে অবস্থা ঠিক সুবিধার নয়, আর দেরী করলে ফেরা অসম্ভব হয়ে পড়বে।সভা শেষ হবার নির্ধারিত সময়ের কিছু আগেই সভা মুলতুবি করা হলো এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনজন স্থানীয় সহকর্মী সহ স্যার বেরিয়ে গেলেন। এদিকে বাড়ি ফিরে গেলো সেই আবাসিক শিশুরা যারা রোজ সন্ধ্যায় যীশুর জন্মদিনের উৎসব পালণের রিহার্স্যাল দিত। শুনশান হয়ে গেলো সেই মিশণ চত্বর। ঠিক সন্ধ্যা সাতটায় ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলো। কার্ফু জারি হলো। বাড়িতে জানালাম যে ইন্টারনেট ছিন্ন হলেও এই মুহুর্তে ফোনে কথা বলা যাচ্ছে। তবে কতক্ষণ মোবাইল পরিষেবা উপলব্ধ হবে তা জানা নেই। এমনিতে জায়গাটা নিরাপদ, কারণ মিশনারী ইন্সটিটিউট হওয়ায় সেটা সবরকম ভাবেই সুরক্ষিত। বাইরে থেকে ভেসে আসছে প্রতিবাদের শব্দ। ঝলসে উঠছে আগুন। এভাবেই সে রাতটাও কাটলো। তৃতীয় দিন অর্থাৎ মিটিং -এর শেষ দিন কোনভাবেই কার্যতঃ কোন কাজ করা সম্ভব হলো না। মুহুর্মুহু ফোন বেজে যাচ্ছে প্রত্যেকের। উৎকন্ঠা, উদ্বেগ নিরসন করতে হচ্ছে। স্যোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। টিভিতে স্থানীয় চ্যানেলে ঘটমান বর্তমানে প্রত্যেকের চোখ কান খোলা। এদিন কারও সময় যেন কাটছিলো না। সকলেই চাইছিলো কিছু কাজ খুঁজে বের করতে। কলিগবন্ধুরা বিভিন্ন স্টেট থেকে হার্বেরিয়ামের জন্য প্রচুর গাছ এনেছিলো। আমি সেগুলি সব আইডেন্টিফাই করতে লাগলাম। এক সময়ে সে কাজও শেষ হয়ে গেলো। ওই ইন্স্টিটিউটের একটা ব্রোশিওর পেলাম, সেটায় চোখ বুলিয়ে সময় কাটলো কিছুটা। বাজার বন্ধ থাকায় এই দিন থেকে ইন্স্টিটিউটের রসদেও টান পড়লো। লাঞ্চ -ডিনারের মেনুতে রইলো আলুসেদ্ধ, আলুর ডালনা, আলু-বীনস্ ভাজা। অনিশ্চয়তার পথে থেকে তৃতীয় দিনও অতিবাহিত হলো। চতুর্থ দিনে ঘরে ফেরার কথা ছিলো সকলেরই। আমার আর আমার কলিগদাদার ফেরার কথা ছিলো একসাথে, নর্থ ইস্টে। সব ট্রেন ক্যান্সেল হয়ে গেলে অনির্দিষ্ট কালের জন্য সেই অস্থায়ী আবাসেই কাটাতে হতে পারে – এমনই নির্দেশ এলো অফিসের ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। স্বজনহীন, কর্মহীন সময় অতিবাহিত করা দুঃসহ ঠেকতে লাগলো সকলেরই। পড়ার মতো বইও ছিলো না হাতের কাছে। এরকম অবস্থায় ঘুমিয়ে বেশ সময় কাটানো যায়। সেদিন কয়েক ঘন্টা তাই ঘুমিয়েই কাটলো। ঘুম ভেঙে গেলো হৈ চৈ আর প্রতিবাদী শ্লোগানে। অলিন্দে দাঁড়িয়ে দেখলাম তে-মাথার মোড়ে টায়ার জ্বালিয়ে মানুষজন বিক্ষোভ প্রদর্শণ করছে। কালো ধোঁয়া ও ঝাঁঝালো টায়ার পোড়া গন্ধে ভরে উঠেছে চারদিক। পাহাড়ের মাথায় ঘরবন্দী আমরা ক’জন। হতাশা আর কলরবে কেটে গেলো চতুর্থ দিন। পরদিন সকালে পাস্তা দিয়ে প্রাতরাশ করলাম। ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম ইন্স্টিটিউটটিকে। অসম্ভব সুন্দর স্থাপত্য ও সৌন্দর্যায়ণ। প্রতিটি বিল্ডিং অদ্ভুতভাবে একে অপরের সাথে যুক্ত। নানা রঙের বোগেনভেলিয়া, ক্রিসান্থেমাম্, ট্যাজেটস, ট্রাইডাক্স, ইউফরবিয়া পালচেরিমা, ক্যাথারান্থাস, ডালিয়া, হিবিস্কাস সাবডারিফা (চুকুর)- এর ফুলে রঙীন হয়ে রয়েছে ব্যালকনিগুলি। একপাশে পাহাড় ও অন্যপাশে নদী – সব মিলিয়ে ঠান্ডাটা একটু বেশীই। অতবড় ইন্সিটিউটের ওলিগলি সব ঘোরা সাঙ্গ হল, এদিকে সময় ফুরায় না। সকলের অনুরোধে মিশণ কর্তৃপক্ষ ওয়াইফাই -এর পাসওয়ার্ড দিলে মরুভূমিতে মরূদ্যানের সন্ধান পেলাম যেন। পুনরায় ট্রেনের খোঁজখবর নেওয়া শুরু হলো। জানা গেলো বেশির ভাগ ট্রেনই বাতিল হয়েছে। কিছু ট্রেন চলাচল করলেও তাদের সময় অনিশ্চিত এবং যাত্রাপথও নিরাপত্তাবিহীন। তখন ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষ ফ্লাইটে যাবার বিশেষ অনুমতি দিলেন যার খরচ সবটাই সংস্থা বহন করবে। সেই অনুযায়ী বিমানের টিকিট বুকিং-এ কিছুটা সময় অতিবাহিত হলো। বাকি সময়টা কেটে গেলো স্যোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রেখে ও খবর শুনে। রাতে একবার ছাদে এলাম অন্ধকারে আলোয় ঝলমল করছে পাহাড়, ব্রহ্মপুত্রের জলে প্রতিফলিত হচ্ছে। তবু যেন সব কিছুই বিষাদমাখা। বড়দিনের প্রাক প্রস্তুতির আনন্দে আবাসিকরা হয়তো স্টার বানিয়েছিল। সে স্টার জ্বলছে নিভছে, কিন্তু তাকে দেখার কেউ নেই। রাতে ঘুম হলো না ভালো করে। সকাল ন’টা পনেরোতে ফ্লাইট। নির্ধারিত সময়ের দু’ঘন্টা আগেই এয়ারপোর্টে পৌঁছতে হবে। ভোর চারটেতে উঠে গীজার চালিয়ে উষ্ণ জলে স্নান সেরে নিলাম। ভোর পাঁচটায় অটো ভাড়া করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। সেই এয়ারপোর্ট যেখান থেকে এ যাত্রা শুরু করেছিলাম। অবশেষে এয়ারপোর্ট দেখা হলো, প্লেনে চড়াও হলো। সেখানে দুই প্রস্থ চেকিং -এর পর লাউঞ্জে নির্ধারিত ফ্লাইটের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। সময় কাটতে লাগলো এয়ারপোর্টের বিভিন্ন দোকানের বই, চকোলেট, খাদ্যদ্রব্য, বস্ত্র, প্রসাধনী, উপহারসামগ্রী -দেখে। এরপরও সময় কেটে গেলো রাণওয়েতে একের পর এক স্পাইসজেট, এয়ার ইন্ডিয়া, এয়ার এশিয়া, গো এয়ার, ইন্ডিগো, ভিস্তারা ফ্লাইটের অবতরণ, ট্যাক্সিং ও টেকঅফ দেখে দেখে। নির্ধারিত সময়ের ত্রিশ মিনিট বিলম্বে অর্থাৎ সকাল নয়টা পঁয়তাল্লিশে রানওয়ে ছেড়ে আকাশে উড়লো প্লেন। টেকঅফের সময়ে “কৈলাসে কেলেঙ্কারী”-তে অভিকর্ষকে কাটিয়ে ওঠার সময় জটায়ুর অভিব্যক্তিকে মনে করে মনে মনে হেসেও নিলাম। নিমেষের মধ্যে নিচের শহর আণুবীক্ষণিক হয়ে মিলিয়ে গেলো মেঘের সমুদ্রে। উত্তরের তুষারশুভ্র পর্বতশৃঙ্গগুলি দৃষ্টিগোচর হতে লাগলো। ব্রহ্মপুত্রের পাড় তখন গুগল ম্যাপে দেখা নদীখাতের মতো। গন্তব্যে পৌঁছনোর বারো মিনিট আগে আকাশ থেকে দেখতে পেলাম জলশহর ও তার পাশ দিয়ে বয়ে চলা তিস্তানদীকে। ইচ্ছে হলো ইমার্জেন্সী এক্সিট খুলে প্যারাসুট নিয়ে লাফিয়ে পড়ি প্রিয় নদীর বালুচরে। ঠিক একঘন্টা উড়ান শেষে গন্তব্যে অবতরণ করলো ফ্লাইট। এয়ারলিফ্ট সিনেমার ক্ষুদ্র সংস্করণ যেন। এরপর বাড়ি ফিরে আমাকে দেখে সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তারা কতটা চিন্তায় ছিল সেটা মার লেখাটা পড়ে বুঝেছিলাম। মা লিখেছিল –
” ‘মা, চিন্তা কোরো না। আমি সেই অর্থে নিরাপদে আছি।
ফেরার ট্রেনের টিকিট হয়তো ক্যান্সেল করতে হবে,
ওরা যা খাওয়াবে, তাই খাবো।’
রাত আটটা চৌত্রিশ,
ইন্টারনেট,মোবাইল পরিষেবা .. সব বন্ধ হয়ে গেলো।
ফেরার ট্রেনের টিকিট ক্যান্সেল করবে কি ভাবে ?
জানি, এ মুহুর্তে এসব কথা
মনেও আসেনি তোমার।
প্রতীক্ষা তোমার জন্য।
প্রতীক্ষা সকাল-সন্ধ্যে, সারা দিনমান।
তোমার কিনে দেওয়া যন্ত্রটা সবসময় আমার হাতের তালুতে।
কান পেতে রাখি মাসীমণির মোবাইল ফোনের জোরালো রিংটোন শোনার জন্য।
দৃষ্টি নিবদ্ধ হোয়াটস্ অ্যাপ -এ, ম্যাসেঞ্জারে …
আজ সকালেই আমি তোমাকে বক্সা পাহাড়ের ছবি পাঠিয়েছিলাম, সেখানে প্রকৃতি শান্ত সমাহিত।
আজ সন্ধ্যায় তুমি শোনালে আর্ত চিৎকার,পাঠালে আগুনের ছবি, সব পুড়ে ছারখার।
এরপর ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার, টিয়ার গ্যাস …
বড়ো ক্লান্ত, মন অশান্ত।
তবু কাঁদছি না, ঘুম পেয়েছে অসম্ভব,
তবু ঘুমোচ্ছি না।
শুধু শুধু অনলাইন, আসবে না কোন ম্যাসেজ জেনেও।
তুমি আগুনের ছবি পাঠিয়েছো।
এদিকে আমি চিন্তার আগুনে পুড়ে যাচ্ছি যে।”
তারপর ২০২০ এলো, কোরনা কাল শুরু হওয়ায় আর যাওয়া হয়নি ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে। ভেবেছিলাম হয়তো এই ধারাবাহিক প্রকাশের গতির সাথে পাল্লা দিতে পারবো না, তাই এখানেই শেষ হবে। কিন্তু কাকতালীয় ভাবে তিন বছর পর আবার ডাক দিলো ব্রহ্মপুত্র। অগত্যা পরের পর্বের জন্ম নিশ্চিত।
(ক্রমশঃ)