সেই টেলিফোন…. ✒️✒️ রত্না রায়

সেই টেলিফোন….

রত্না রায়

রিফ্রেস রুম থেকে ফিরে ঝিনুক সেলফ থেকে একটা ম্যাগাজিন তুলে নিয়ে চেয়ারে আরাম করে বসে। ডিপ্রেসনের পৃথিবীতে সহচরীর এই কাজটা ওকে বড়ো তৃপ্তি দেয়। কাজটাকে ও বড়ো ভালবাসে। কত মানুষ, কত সমস্যা। জীবন জলের মতোই জটীল।
আচমকা রাতটাকে চমকে দিয়ে সামনে রাখা ফোনটা বেজে ওঠে। কোনো একটা প্রাইভেট নাম্বার। ফোনটাকে তুলে নেয় ঝিনুক।
” হ্যালো। ”
” এটা কি সুইসাইডিয়াল হেল্পলাইন সংস্থা সহচরীর নাম্বার?” একটা মাদকতা ভরা সুরেলা কন্ঠস্বর ভেসে আসে।
“ইয়েস ম্যাম।”
” যদি অসুবিধা না হয়, আমি কি একটু কথা বলতে পারি?”
“ও সিওর ম্যাম। আপনার নামটা…”
” নাম…. নাম….ধরুন বিশ্বজয়ী ঐশ্বর্যা কিংবা কৃষ্ণসুন্দরী পাঞ্চালি।”
” বুঝেছি ম্যাম। আপনি বলুন, আমি শুনছি…”
” কিন্তু শুরু করি কোথা থেকে?”
“এক কাজ করুন মিষ্টি ছোটবেলা…..
“ছোটবেলা!” একটা কষ্টের হাসি ভেসে আসে।
ছোটবেলা, হ্যাঁ, মিষ্টি ছোটবেলা।
ভীতু, সংকুচিত ঝাঁকড়া চুলের গাবলুগুবলু একটা ছোট্ট মেয়ে। চর্তুদিক থেকে ছুটে আসা হাজার প্রশ্নের সামনে কী ভীষণ অসহায়। বিষাক্ত তীরের ফলাগুলো প্রতিনিয়ত এফোঁড় ওফোঁড় করে দিতো তাকে। তোর বাবা তোদের সাথে থাকে ? আচ্ছা তোর মায়ের বিয়ে হয়েছে? তোদের বাড়িতে এখন কোন আঙ্কেল আসে রে? তোর দাদা দিদিরা তোকে বোন বলে ডাকে?
নিশ্চুপ অপমানিত মেয়েটার কাছে লজ্জা ছাড়া আর কোনো উত্তর ছিল না। ঢাল হয়ে কেউ কোনোদিন আগলে রাখেনি তাকে। কেউ মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়নি। কেউ ভালবেসে মুখে খাবার তুলে দেয়নি। কেউ কোলের কাছে ওকে আদর করে টেনে নিয়ে বলেনি, ভয় নেই আমি আছি তো।
জানেন, সবার মা বাবা স্কুলে দিতে নিতে আসতো, পেরেন্টস টিচার মিটিং, আ্যনুয়াল ফাংশন, স্পোর্টস। কিন্তু সেই মেয়েটার জন্য কেউ নেই। কিংবা এলেও সবার চোখ যেন বলতো, এ কেন এখানে!
” আপনার মা!”
“মা।” একটা অন্যমনষ্ক কন্ঠস্বর বলতে থাকে,
” প্রতিদিন মাঝরাতে বন্ধ দরজার ওপার থেকে দেওয়াল ফুঁড়ে দুটো সাপের হিসহিসানি ছটফটানি ওকে ঘুমোতে দিতো না। একটা ময়াল সাপের মতো নিঃশব্দ ঠাণ্ডা ভয় রোজদিন একবার করে ওকে গিলে নিতো। সারারাত, সারারাত একা বালিশে মুখ গুঁজে অপেক্ষা।
কখন যুদ্ধটা শেষ হবে, সূর্য উঠবে…..
জানেন আমার না, একবার সাঙ্ঘাতিক ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়েছিলো। জ্বরে বেহুঁস। জবা মাসি, মানে যে আমাকে দেখাশোনা করতো, কোনো কারণে কয়েকদিনের জন্য ছুটি নিয়ে দেশে গিয়েছিলো। বাড়িতে আমি আর মা।
বাধ্য হয়ে বিরক্ত মাকে গোটা একদিন আমার জন্য খরচ করতে হয়েছিল। সেই বোধহয় প্রথম আর শেষ আমার পাশে মায়ের থাকা।”
“সরি ম্যাম, আপনাকে আঘাত দিয়ে থাকলে। আপনি বরঞ্চ আলোর কথা বলুন।”
“আলো! কিন্তু অন্ধকার না থাকলে আলোর তো কণামাত্র দাম নেই। আলোর ঔজ্জ্বল্য তো অন্ধকার চিরেই বেড়িয়ে আসে। তাইনা?
ছন্দ, তাল, লয়… নাচ, নাচ আর নাচ… আমার জীবনের একমাত্র আলো…আমি চোখ মেলেছি রুমঝুম শব্দে। টলমলো পায়ে হাঁটতে নয়, নাচতে চেয়েছি ঝমঝমিয়ে। আমার সমস্ত ক্ষতের একমাত্র উপসম। ঘুঙুরের ঝঙ্কার আর তবলার বোলে ধুয়ে নিতে চাইতাম আমার সব কষ্ট।
আর আমার মা তখন উচ্ছাকাঙ্খার সলতে পাকিয়ে সোনার ডিম পাড়া হাঁসকে তৈরীতে ব্যস্ত। একটা ভুল আর সপাং করে বসে যেতো লিকলিকে কঞ্চি।
একটার পর একটা রিয়েলিটি শো, মাচা।
কিন্তু এই কৃত্রিমতা ভরা সার্চলাইটের আলো কখনো কখনো বড়ো বেশি অতিরিক্ত হয়ে যায়। একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকা যায় না। ঝলসে ওঠে চামড়া। আলোর থেকে অনেক দূরে একটু নিরালা শান্তি খোঁজে সে। মায়াবী আলোয় একদণ্ড জিরিয়ে নিতে চায়।
আমি ক্রমশ ক্ষয়ে যাচ্ছিলাম।
তুমি বোর হচ্ছো না তো? এই দ্যাখো তোমাকে তুমি বলে ফেললাম। অবশ্য তুমি আমার থেকে বয়সে অনেক ছোটো‌ই হবে। কি, তুমি বললে অসুবিধা নেই তো তোমার?”
” না, না । আপনি আমাকে তুমিই বলবেন। তুমিই আমার বেশি ভালো লাগে। আমি শুনছি, আপনি বলুন আপনার আগুনের ওপর দিয়ে পথ চলার কাহিনী।”
“বাহ্, বেশ বললে তো। আগুনের ওপর দিয়ে পথ চলা। কিন্তু এতো সবে কাঠকুটো জড়ো হচ্ছে। তারপর পাথরে পাথর ঘষে আগুন জ্বলবে। তীব্র হাওয়ায় ঝলকে উঠবে শিখা। পোড়াবে আর পুড়বে।
উফ্ আবার বাজে বকা শুরু । একটা রিনরিনে হাসি ভেসে আসে।” কি যেন বলছিলাম….”
” রিয়েলিটি শো , মাচা…”
” হ্যাঁ, রিয়েলিটি শো..ওখান থেকেই আমার গুরুদর্শন। ভীষণ নামী ভীষণ দামী । নামটা আর বলছি না, কেমন।”
“ঠিক আছে।”
” একটা রিয়েলিটি শো তে উনি আমার মধ্যে আগুনটা চিনতে পারেন। আমাকে গুরুকূলে নিয়ে আসেন উনি। ভীষণ আনন্দ হয়েছিল আমার। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে এ এক আলোর নিশান। এবারে মনপ্রাণ ঢেলে শুধুমাত্র ভালবেসে নাচবো আমি। ”
ফোনের ওপার থেকে একটা ব্যঙ্গের হাসি কানে আসে।
” প্রথম রাত্রিতেই, গুরু যখন আমার জামা ধরে টান দিয়েছিলেন , প্রাণপণে বাধা দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু যখন স্পষ্ট করে আমাকে জানিয়ে দেওয়া হলো ফ্রি তে কিছু পাওয়া যায় না কোথাও, কখনো । কিছু পেতে গেলে কিছু না, অনেককিছু ই দিতে হয়। দেশের একনম্বর গুরুকূলে শিক্ষার বিনিময় মূল্য ধার্য হয়েছিলো আমার ভার্জিনিটি। আর তাছাড়া এমনি এমনি আমার মা আমাকে ওনার হাতে ছেড়ে দেননি। আমার জন্য মাকে মোটা টাকা দিতে হয়েছে ওনাকে। নিমেষে সবকিছু কেমন কালো হয়ে গিয়েছিল। মাথা, মন, শরীর পুরো অবশ। সমস্ত প্রতিরোধ ভেঙে পরেছিলো। আমার নিরাভরণ পঞ্চাদশী শরীরটায় একটা পঁয়ষট্টি বছরের বৃদ্ধ কেঁচো তার ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়িয়েছে সেই রাতে। আর আমি রক্তস্নান করে যন্ত্রণা আর ঘৃণায় কুঁকড়ে উঠেছি।
খুব কেঁদেছিলাম, বালিশ ভিজিয়ে মনপ্রাণ উজাড় করে কেঁদেছিলাম।
তারপর চোখ মুছে আয়নাকে বলেছিলাম আর কান্না নয়।
হায় রে মানুষ, নিজের ভবিষ্যৎ যদি সে দেখতে পেতো…..”
” ইস্।”
” না, না,ইস্ বলো না। আমি যা আজ হতে পেরেছি, সব‌ই ওনার শিক্ষা। নিঙরে নিয়েছিলাম ওনার সমস্ত সম্পদ। পায়ের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কাজ, কথা বলা, আদবকায়দা, চোখের ইশারা, ঠমকঠামক। ওনার গ্রুপে আমি সর্বেসর্বা। নানা শহর, দেশ, সমস্ত পৃথিবী আমার পায়ের জাদুতে মুগ্ধ।একনাগাড়ে শো করেছি। নাচেই মুক্তি, নাচেই শক্তি।
তারপর একসময় ওনাকে ছাড়াই গ্রুপ নিয়ে গেছি ।
ওনার দিন শেষ। অর্গানাইজাররা আমাকে খুঁজতো,। আমি অবশ্য ওনাকে ভুলে যাইনি। কিছু টাকা মাসোহারা দিতাম। যত‌ই হোক উনি আমার গুরু।”
” বাহ্, এই তো। জীবনের মানে খুঁজে পেয়েছেন।”
” হ্যাঁ, তখন চারদিকে সোনালী আলো। আর সেই সোনাঝরা পথ মাড়িয়ে এসে দাঁড়ালো আমার মধুকর। আমি সবটা জানতাম। সব…সব..সব…. জানতাম সে বিবাহিত, আমি আইনের স্বীকৃতি কোনোদিনই পাবো না। কিন্তু কি এসে যায় ওই একটা কাগজে দুটো কলমের আঁচরে। আমি ওকে সুখ দেবো, এক নিরিবিলি শান্ত আঁচলের ছাউনি দেবো। যা ওর স‌ই করা স্ত্রী কোনোদিনই দিতে পারেনি।
বাঁধভাঙা জলের তোড়ে ভেসে গেলাম দুজনে।
সে যে কি উদ্দাম প্রেম তোমাকে বোঝাতে পারবো না।
এই প্রথম কেউ আমি কি চাই জানতে চাইলো। আমি কি ভালবাসি শুনতে চাইলো। আমার কি প্রয়োজন বুঝতে চাইলো।
লোকে বলে নিজের নজর সবচেয়ে বেশি নিজের‌ই লাগে। বিশেষ করে সে নজর আমার মতো কালনাগিনীর হয়। তারপর, তারপর আশ্বিনের ঝড় উঠলো। আমার আকাশটাকে তছনছ করে দেওয়া ঝড়। শরীরটাকে আঁকড়ে ধরে যে সোনার পুতুলটা একটু একটু করে বেড়ে উঠছিলো। থাকলো না সে।
এক নিমিষে সব শেষ…..পুড়ে ছাই হয়ে গেলো।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে… উফ্ কি যন্ত্রণা.. রক্তের নদীতে যেন বান এসেছে। কোনোরকমে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে এসে ফোন করেছিলাম… কিন্তু, কিন্তু, পারলাম না…
আমি… আমি… আমি বাঁচাতে পারলাম না…
আমার মা হ‌ওয়ার আশা, আমার স্বপ্ন, আমার ভালবাসা…. সব শেষ…..
পাগলের মতো ছুটে গিয়েছি…বন্ধ দরজার ওপারে. কাঙালের মতো হাত পেতে দাঁড়িয়েছি। শুধু একটু ভালবাসা। আর কিছু চাই না।”
” কিন্তু উনি তো আপনাকে ভালবাসতেন!”
” ভালবাসা! এ ছিলো চাঁদ বেনের বাঁহাতে ছুঁড়ে দেওয়া ফুল। প্রয়োজন.. প্রয়োজন…
ওর বিয়ে করা আইনত ব‌উ আমাকে স্পষ্ট গলায় জানিয়ে দিলো,আমাদের মতো ছেনাল মাগীরা শুধু বিছানা গরম করতে পারে। ডোরম্যাটকে দরজার বাইরে রেখে আসাই নিয়ম। আস্তাকুঁড়ের রেণ্ডির এর বেশি চাওয়াটাই আস্পর্দা।
একটা সন্তানের প্রয়োজন ছিল ওদের। একটা ভালবাসার নিজস্ব সন্তান। যা ওর স্ত্রী কোনদিনই দিতে পারবে না।
সেই হেতুটাই যখন নেই। তখন আমি মানুষটাই তো অহেতুক।” একটা খ্যাপাটে হাসি মেশানো কান্না গুঙিয়ে ওঠে।
” সেকি এতোবড়ো প্রতারণা আপনি মেনে নিলেন!”
” এই তো এতোক্ষণে একটা বুদ্ধিমানের মতো প্রশ্ন। আমাকে বুঝতে পারছো তুমি এবারে।”
” নিজেকে শেষ করেই দিতেই চেয়েছিলাম। শব্দগুলো ঘা মেরে মেরে আমাকে টুকরো টুকরো করে দিয়েছিলো। কখনো কোনো থান‌ইঁটের আঘাতে জানলার কাঁচকে ঝুরো ঝুরো হয়ে ভেঙে পরতে দেখেছো! আমিও ভেঙে পরেছিলাম ঠিক ওইরকম গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে। তারপর সমস্ত সংসার থেকে পিছন ফিরে নিজেকে শামুকের শক্ত খোলের মধ্যে গুটিয়ে নিয়েছিলাম। মুছে ফেলতে চেয়েছিলাম নিজেকে। চব্বিশঘন্টা নেশায় বুঁদ হয়ে হারিয়ে যেতে চেয়েছিলাম।
কতরকম যে নেশার জিনিস আছে পৃথিবীতে। তবু নেশা হতো না। একটা কচি গলার মা ডাক… ওই কান্নার আওয়াজ থামানোর জন্য আরো নেশা… আরো নেশা…
কিন্তু না, হলো না, আমার আগুন আমাকে শেষ হতে দিলো না। নিজেকে ভুলিয়ে রাখার সাধনায় আমার গোটা বছরটা নষ্ট হলো। এক অদ্ভুত কান্নাভেজা হাসির আওয়াজ ভেসে এলো।
তারপর একদিন, সমস্ত সংসারের ওপরে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালাম।
চিৎকার করে বলে উঠলাম, আমার কথা যেমন কেউ ভাবেনি, আমিও ভাববো না। কারুর কথা নয়…. কাউকে নয়…. রেণ্ডি! বেশ রেণ্ডিই স‌ই। রেণ্ডিই আমি হবো…. একটার পর একটা পুরুষ…. জলসাঘরের ঝাড়বাতিটার মতো শুধু আলো ছড়িয়ে একা জ্বলে যাওয়া। হি হি হি কত লোক আমাকে ঘিরে কিন্তু হাত ধরে পথ চলতে কেউ চায়না।
আর এইসময়েই আমি বিয়ে করে ফেলি। আমার থেকে দশ বছরের ছোটো একটা বাচ্চা ছেলে। আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী। দামী উপহারে ভরিয়ে রাখতো। দুহাতে আগলে নেশাগ্রস্থ আমাকে বাড়ি ফিরিয়ে আনতো। কিন্তু কখনো কোনো অন্যায় সুযোগ নেয় নি।। বিছানা নয়, আমাকে নিজের করে পেতে চায় ও। কিন্তু আমি তো তখন পাথর।”
” তাহলে! পাথর গললো কি করে!”
” একদিন ভূতপূর্ব প্রাণসখা ব্ল্যাঙ্ক চেক নিয়ে হাজির। ওর বড়ো আদরের ছোটো ভাইকে ছেড়ে দেওয়ার দাম। শুধু আমার মুখ ফুটে বলার অপেক্ষা।
ব্যাস, সেইদিনই বিয়ে।
হি হি হি .. কি মজা, আমার প্রাণসখার অসহায় চোখের সামনে দিয়ে আমরা প্রেম করতাম।
জ্বলেপুড়ে সব খাক হয়ে যাক।
কিন্তু পোড়াতে গিয়ে দেখলাম আমিই পুড়ছি বেশি। যে নাচ ওকে পাগল করেছিলো। সেই নাচ ভুলতে হবে। আর নাচলেও শুধু ওর জন্যে। কিন্তু নাচ ছাড়া আমি তো জীবন্ত লাশ। আসলে আমি ছিলাম বড়লোকের বিগড়ে যাওয়া আদুরে ছেলের হাতের ট্রফি।
ওকে ছেড়ে ফিরে এলাম আমার নিজের ফ্ল্যাটে।
আর আসার আগে মুখের ওপর বলে দিলাম সব.. সবটুকু। কেমনভাবে আমি ওর দাদার হাতের খেলনা ছিলাম, আর আজ ওর দাদা শুধুই নাচ ভুলুয়া নাচের ,বান্দর…. হি হি হি হি…. আর ও ডুগডুগি। যাকে যেমন খুশি বাজিয়ে, আমি খেলা জমিয়ে দিয়েছি। হো হো হো হো… এই দ্যাখো হাসতে হাসতে চোখে জল চলে এলো।
কিন্তু ভীষন বিরক্তিকর এই খেলা। এই নেকুপুষু আহ্লাদী সতীপনা ঠিক আমার টাইপ নয়। অত‌এব খেলা শেষ। এবার যে যার ঘরে ফিরে যাও।”
” তারপর?”
একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ভেসে এলো।
” বাচ্চাদের হাত থেকে খেলনা নিয়ে নিলে কি হয় দেখেছো? এও তাই হলো। প্রথমে জোরজুলুম তারপর কান্নাকাটি। যখন বুঝলো কিছুতেই কিছু হবে না। তখন প্রতিশোধ। আমি তখন ইউরোপে ট্যুরে। আমার ফ্ল্যাটে এসে, আমার শাড়ির ফাঁসে নিজেকে শেষ করে দিলো।”
” কী সাঙ্ঘাতিক!”
” সাঙ্ঘাতিকের সবে শুরু। নিষ্পাপ পৃথিবী আমার গায়ে পুরুষখোকো ডাইনীর স্ট্যাম্প সেঁটে দিলো।
সারাজীবন ধরে খুঁজে গেছি শুধু একটু ভালবাসা, একটা পরিচয়, নিজের একটা ছোট্ট সংসার, খুব বেশি তো চাহিদা ছিলো না…. তবু বারবার ফিরেছি শূন্যহাতে। আরো বেশি রক্তাক্ত হয়ে একটা দমবন্ধকর স্যাঁতসেঁতে ঘরে। সম্পূর্ণ একা নিঃস্ব রিক্ত।
যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেই বিগ জিরো তে আবারো ফিরে এলাম। তবু নিজেকে শেষ করে দিতে পারলাম না। সেই কোন ছোটবেলা থেকে বেঁচে থাকার এক প্রবল আকাঙ্খা আমাকে মাটিতে ফেলে থেঁতো করেছে‌। আবার ঢেউএর মাথায় চড়িয়ে দিয়েছে।”
” তারপর?”
” তারপর আমার পাঁচশিকের নৈবেদ্য, আমার বেঁচে থাকার রসদ, আমার দক্ষিণের জানালা… আরো নিবিড় করে জড়িয়ে ধরলাম। শুধু নাচ, নাচ আর নাচ। কত যে রত্ন ছড়িয়ে আছে। নাচের খোঁজে নিজেকে লুকিয়ে চষে ফেলেছি ভারতবর্ষ।
আর আমার মাদার হাউস। ক্যান্সার আক্রান্ত অনাথ অসহায় ছোট ছোট মুখ। অজস্র কচি মুখের মধ্যে আমি আমার হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট সোনাটাকে খুঁজে পেয়েছিলাম।
চার বছর। তারপর সব আবার স্বাভাবিক।
কদিন আগে একটা পুরস্কার পেলাম জানো। না, পুরস্কারে আমার বাড়ির দেওয়াল জোড়া শোকেস ভর্তি। কিন্তু এটা স্পেশাল। যখন আমার কাছে ফোনটা এলো, আমি একটাই শর্ত দিয়েছিলাম ওটা নেবো আমি আমার বাবার হাত থেকে। নাহলে ও পুরস্কারে আমার কোনো রুচি নেই ‌ আমি রিফিউজ করছি। মেনে নিয়েছে। আমার সব শর্ত মেনে নেবে এখন মানুষ। আমি যে সকলের চোখের মণি। মাইকে আ্যনাউন্স হচ্ছে দেশের আইকনের হাতে পুরস্কারটা তুলে দিচ্ছেন ওনার বাবা … হি হি হি হি, আজ আর আমি আস্তাকুঁড়ের পোকা ওই লোকটার জারজ সন্তান ন‌ই। ওই লোকটাই দেশের আইকনের বাবা। হাজার একটা ঝলসে ওঠা ক্যামেরার সামনে ঝলমলে স্টেজে আমার মাথায় হাত দিয়ে সেটা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হলেন উনি। আমি আজ ওনার মেয়ে…. ওনার রক্ত আমার শরীরে… আমি বেজন্মা ন‌ই…. আমারও পরিচয় আছে… আর সেটা আমি অর্জন করেছি…. ছিনিয়ে নিয়েছি..,
আমি খুশি, ভীষণ খুশি…. এতোদিন আমি যা হারিয়েছি আজ তা লক্ষগুণ হয়ে ফেরৎ এসেছে।” একটা খিলখিল হাসি ফোন ছাপিয়ে ঝিনুককে ও ভাসিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো।
আওয়াজটা বন্ধ হতে ঝিনুক ভদ্রমহিলাকে শান্ত করতে চাইলো।
” বাহ্ আপনার উত্তরণের গল্প শুনে ভালো লাগলো। অনেক রাত হলো। এবারে আপনি ঘুমিয়ে পরুন।”
” হ্যাঁ ঠিক বলেছো, এবারে আমায় ঘুমতে হবে। ছোটবেলা থেকে একা… একেবারে একা লম্বা কালো একটা সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ। একঝলক যদি চোখে পড়েছে একটুকরো নীল আকাশ। পরক্ষণেই ভয়ঙ্কর একটা কালো মেঘ এসে পুরোটা ঢেকে দিয়েছে। আজ যখন একমুঠো আলো আমার চারদিকে ঝিলমিল করছে। তা হারিয়ে যাওয়ার আগেই আমাকে ঘুমাতে হবে। সমস্ত রাত জুড়ে গভীর ঘুম….. ভীষণ ক্লান্ত আমি……”
একটা ঠাণ্ডা বিপদের ইশারায় চিৎকার করে ওঠে ঝিনুক ‌
” ছেড়ে দেবেন না প্লিজ। একটু শুনুন……”।
যাঃ! ফোনটা ছেড়ে দিলো!
হঠাৎ ওর পার্সোনাল ফোনটা আর্তনাদ করে ওঠে। জার্নালিস্ট বন্ধু কিয়ারা।
” বল।”
” একটা খারাপ খবর ছিলো।”
” সে তো বুঝতেই পারছি। আমার নাইট ডিউটি জেনেও যখন ফোন করছিস।”
” এই দুঘন্টা হলো সুলেখা ব্যানার্জী মারা গেছেন। ঘুমের ওষুধ খেয়ে চারদিন আগেই হসপিটালে ভর্তি হয়েছিলেন। সেই ঘুম আর ভাঙেনি। প্রেসের কাছ থেকে ব্যাপারটা লুকিয়ে রেখেছিলো হসপিটাল কর্তৃপক্ষ। একটু আগে আ্যনাউন্স করলো। আমি তো জানি তুই ওনার কত বড়ো আ্যডমায়ার। শেষবার দেখতে চাইলে ভোরেই পৌঁছে যাস হসপিটালে। এরপর পুলিশ,পাবলিক আর মিডিয়ার হাতে পুরোটা চলে যাবে। রাখছি বুঝেছিস। এখন অনেক কাজ।”

কি বললো!

মারা গেছে! কে!

আগের ফোনটা কে করেছিলো!

ফোনটা কি আদৌ এসেছিলো!

কোলের ওপরে রাখা ম্যাগাজিনে সুলেখা ব্যানার্জীর মুখে এক আশ্চর্য আলোর রূপটান।
ঝিনুকের চোখ থেকে টপটপ করে জল পরে ভিজিয়ে দিতে থাকে সেই মুখ….. ঝিনুক গুনগুনিয়ে ওঠে.,.
“অন্ধকারের উৎস হতে উৎভাসিত আলো
সেই তো তোমার আলো…………….”

্্্্্্্্্্্

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *