ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে (দশম পর্ব) ✒️✒️ সায়ন্তন ধর

ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে (দশম পর্ব)

সায়ন্তন ধর

ডিসেম্বর মাস, ২০১৯ সাল, একটা চাকরির পরীক্ষা দিতে গুয়াহাটি যাওয়ার কথা। আসলে ফর্মটা ফিল আপ করেছিলাম আগেই। পরীক্ষাটা আমার কাছে তখন খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তবুও একই সাথে অফিসের ত্রৈমাসিক মিটিং এর ডেট থাকায় ভাবলাম একসাথে দুটো কাজই করে আসি। ভাবনা মতোই একা একাই হাজির হলাম গুয়াহাটি। গুয়াহাটি এয়ারপোর্টের কাছে একটা ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে সিট পড়েছে। যে হোটেলটা বুক করেছিলাম সেটা একদম স্কুলের পাশে। মানে দোতলায় আমার রুমের জানালা দিয়ে স্কুলটা দেখা যায়। যাই হোক পড়াশোনার তো কোন বালাই নেই। একদিন আগে পৌঁছে অফিসের কিছু পেণ্ডিং কাজ করছিলাম। সন্ধ্যা নাগাদ একটু ঘুরে দেখতে বেরোলাম। চকচকে রাস্তা দিয়ে তীব্র গতিতে ট্যাক্সিগুলো ছুটছে। ওই দিকেই এয়ারপোর্ট। আমাদের হোটেলে ডাইনিং এর ব্যবস্থা নেই। তাই ভাবলাম একবারে রাতের খাবার খেয়েই রুমে ফিরবো। সেই মত হাঁটছি তো হাঁটছি। কোন হোটেল চোখেই পড়লো না। অবশেষে একটা চাইনিজ খাবারের রেস্তোরাঁ চোখে পড়লো। ঢুকলাম, নতুন তৈরী হয়েছে। সবকিছুরই ভীষণ দাম। এক প্লেট চাউমিন আর স্যুপ অর্ডার করলাম। তারপর আহারাদি সম্পূর্ণ করে ফিরে এলাম হোটেলে। পরদিন দুই শিফ্টে পরীক্ষা। রিপোর্টিং টাইমে পৌঁছে ওয়েট করার সময় একটা দাদার সাথে পরিচয় হলো। উনি একটা প্রাইভেট স্কুলের টিচার। বাড়ি ধুবড়ি। আসামের বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও সে আদতে বাঙালি। আর পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী কোকরাঝাড়, ধুবড়ি ও দক্ষিণ শালমারা-মানকাচর জেলার মানুষরা বাংলা ভালো মত শেখে। যাইহোক প্রথম হাফের পরীক্ষা শেষে টিফিন করতে হবে। আগের দিন কোন হোটেল না খুঁজে পেয়ে আমি সকালেই কিছু কেক বিস্কুটের প্যাকেট কিনে রেখেছিলাম টিফিনে খাবো বলে। কিন্তু ওই দাদা বলল এখানে নাকি হোটেল আছে। ওমা সত্যিই তাই। তিন চারটা দোকান চোখে পড়লো। ঝুপড়ি টাইপের দোকান। সন্ধ্যার পর তাদের দেখা যায় না। শেষমেশ একটু কম ভীড় যেটায় সেখানে খেয়ে নিলাম। আর আমাকে লজ্জায় ফেলে দাদা আমার টাকা দিয়ে দিলো। আমি দুটো কেকের প্যাকেট দাদাকে দিয়ে বললাম যে সে যেন বিকেলে বাড়ি ফেরার পথে এটা খায়। অনেক সাধ্য সাধনা করার পর সে নিল। যাই হোক পরের হাফের পরীক্ষা শেষে দাদাকে বিদায় জানিয়ে ফিরে এলাম হোটেলে। আজকের রাতটা থেকে কাল সকালেই পৌঁছতে হবে সেই ডনবস্কো ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট এ। এবারও ওখানেই থাকার ও মিটিং এর ব্যবস্থা হয়েছে। হোটেলে কানে এলো পরেরদিন নাকি বন্ধ। “নো ক্যাব” কথাটা অনেকবার কানে এলো। আমি আবার ভাবলাম আমি তো ক্যাব বুক করেই যাবো। তাহলে আদৌ যাওয়া হবে তো? কিন্তু বেশি চিন্তা করলাম না। পরদিন খুব ভোরে উঠে ক্যাব বুক করলাম। গোছগাছ করে হোটেল ছেড়ে দিলাম। ক্যাবও এসে গেলো। একটা আফশোস রয়ে গেলো এত কাছে এয়ারপোর্ট অথচ সেটা দেখা হলো না। যারা নিয়মিত বিমান পরিসেবা নিয়ে থাকেন তাদের কাছে অবশ্যই এয়ারপোর্ট কোন দর্শনীয় স্থান নয়, কিন্তু আমার তখনও প্লেন বা হেলিকপ্টার দেখলে ছুটে বাইরে এসে আকাশের দিকে তাকাতে ভালো লাগে। সেরকমই আমার ক্যাব ছাড়ার সময় একটা প্লেন টেকঅফ করলো। পিছনে লাগেজটাকে রেখে সামনে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসলাম কিছু অভিজাত নিয়মকে ভাঙার জন্য। এমনিতেই আমি এতদিন যত ক্যাবে উঠেছি সব ড্রাইভারই ভীষণ ভদ্র ছিল। এই ড্রাইভার দাদার সাথেও আলাপ জমে গেলো। হিন্দিতেই কথা বলছিলাম। রাস্তাঘাট শুনসান। ড্রাইভারদাদা হঠাৎ করেই বলল যে আজকে নাকি আমিই শেষ যাত্রী। এয়ারপোর্টে যাত্রী নামিয়ে সে ফিরছিল। আমার ডেস্টিনেশনের সাথে তার বাড়ির ঠিকানা মিলে যাওয়ায় আমাকে নিয়েছে। বুঝলাম আমি লাকি। কারনটা তখনো বুঝতে পারিনি। তবে রাস্তায় সত্যিই কোন গাড়ি দেখতে পাচ্ছি না। একটু ভয় ভয় করছিল। হঠাৎ করেই সে বলল যে ক্যাব বিরোধীদের সাথে না দেখা হয়ে যায়। আমি মওকা পেয়ে জিজ্ঞাসা করে বসলাম যে ক্যাবে কি সমস্যা? তখন সে আমার প্রশ্ন বুঝে বলল যে ওলা বা উবের ক্যাবের কথা নয়। দেওয়াল নির্দেশ করে বলল ওই যে লেখা আছে কালো কালিতে। ব্যাপারটা বুঝলাম। স্পর্শকাতর সে প্রসঙ্গ এড়াতে একটা সাইনবোর্ড দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম এখানে কোন জায়গার নামের সাথে “লৈ” বিভক্তি যুক্ত হয়, তার কারণ কি? সে বলল যে তার জানা অন্য কোন ভাষাতেই স্থানকে সম্মান জানানো হয় না। কিন্তু অসমীয়া ভাষায় স্থানকে সম্মান জানাতে লৈ ব্যবহৃত হয়। যেমন গুয়াহাটিলৈ। বেশ ভালো লাগলো ব্যাপারটা। এভাবে চলতে চলতে কথা বলতে বলতে প্রায় গন্তব্যে পৌঁছেছি এমন সময়ে সে বলল যে এখানেই জুবিন গর্গের বাড়ি। আমি তাকে চিনি কিনা জিজ্ঞেস করল। আমি বললাম জুবিন গর্গ আমার অন্যতম প্রিয় গায়কদের একজন। তার অসাধারণ গায়কীর আমি ভীষণ ভক্ত। সে শুনে খুশি হয়ে বলল একবার নাকি এয়ারপোর্ট থেকে এভাবেই জুবিনকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল। এখন অবশ্য গায়কের পার্মানেন্ট ঠিকানা মুম্বাই। তার শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি পেরিয়ে এলাম। ছবি তোলা হোলো না। যাই হোক এরপর আগের বারের মত আবারও পথ ভুল হলো। আসলে পরপর দুটো বাঁক একদম এক হওয়ায় পথ চিনতে অসুবিধা হয়। যাইহোক আমাকে গন্তব্যে পৌঁছে সে বিদায় নিল। আমিও আমার রুমের চাবি নিয়ে বিছানায় এলিয়ে দিলাম শরীর। অনেকক্ষণ কোন কাজ নেই। অন্যান্য কলিগবন্ধুরাও কেউ আসেনি তখনো। ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালাম। ব্রহ্মপুত্র বর্ষার ভয়াবহ রূপ ছেড়ে স্নিগ্ধ ভাবে বয়ে চলেছে। সাদা চর জেগেছে তার বুকে। এলোমেলো কাশের বন হলদেটে হয়ে রয়েছে। দূরের পাহাড়গুলোও ভীষণ স্পষ্ট। দু’জন কলিগবন্ধু এসে পৌঁছালো। সবার মুখেই সেই এক আলোচনা। তাদেরও পথে আসার সময় অনেক ঝক্কি পোহাতে হয়েছে। যাইহোক এভাবে রাত নামলো। রাত কাটলো। ভোর হলো। কুয়াশামাখা নদের চরের কাশবনে সোনার আলো ঢেলেছে সূর্যদেব। সকাল সকাল আগুন জ্বলেছে তেমাথা মোড়ে। একটা চাপানউতোর চলছে সবার মনেই। এর মাঝেই আমাদের প্রথম দিনের মিটিং শুরু হলো। মিটিং তো শুরু হলো কিন্তু স্থানীয় কলিগবন্ধু ও বস এসে পৌঁছতে পারলেননা। বাইরের পরিস্থিতি এতটাই সিরিয়াস ছিলো। অগত্যা কনফারেন্স রুমে ভিডিও কনফারেন্স হলো। স্যারের বক্তব্য শেষ হতে কলিগরা সবাই সবার নিজস্ব কর্ম অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে লাগলো। আমিও হার্বেরিয়াম সংক্রান্ত কিছু কথা ও টেকনিক শেয়ার করলাম। দু’জন জুনিয়র কলিগ বলল গাছ কি করে চিনতে হয় বা তাদের কিভাবে হার্বেরিয়ামের জন্য সংগ্রহ করতে হবে সেটা নাকি হাতে কলমে দেখালে ভালো হতো। আমিও লুফে নিলাম এই কাজ। কারণ আমার ভীষণ ইচ্ছা ছিল। ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে এসে একবার তার চরে পা রাখবো না এটা কেমন কথা। সুযোগ এসে গেলো। মিটিং শেষ হলে বিকেলের সোনা রোদ গায়ে মেখে তিনজনে বেরিয়ে পড়লাম। ঘোরা হলো। চরের প্রায় ফুট চারেক নীচ দিয়ে জল রয়েছে। ছবি তোলা হলো। গল্পগুজব হলো। গাছ চেনা হলো। ওরা আমার দেখানো পদ্ধতিতে গাছ কালেকশন করলো। তারপর দেখলাম সূর্য টা ডুবে গেলো ব্রহ্মপুত্রের জলে।

(ক্রমশঃ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *