গিরিশ চন্দ্র ঘোষ ও তার নাট্যচর্চা পাপিয়া সাহা
গিরিশ চন্দ্র ঘোষ ও তার নাট্যচর্চা
পাপিয়া সাহা
শেষ পর্ব
1910 সালের 29 শেষ জানুয়ারী বারানসী শ্রীরামকৃষ্ণ অদ্বৈত আশ্রমে স্বামী বিবেকানন্দর জন্মতিথি পালিত হইয়াছিল। প্রচণ্ড শারিরীক অসুস্থতা থাকা সত্ত্বেও গিরিশ চন্দ্র বিবেকানন্দর জন্মদিন উপলক্ষে “সাধন ফল” নামে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখেন। ঐটি বিশাল জন মহাসভায় পাঠ করা হয়। ঐ প্রবন্ধে গিরিশ চন্দ্র লিখিয়াছিলেন ‐ শ্রীরামকৃষ্ণ সংসারী ও ত্যাগী ভক্তদের দুই ভাবে উপদেশ দিতেন। এই দুই ভাবের সাধনেই ঈশ্বর লাভ হয়।ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ গিরিশ চন্দ্র কে বলিয়াছিলেন “তুমি দিন দিন শুদ্ধতা লাভ করিবে। তোমার দিন দিন উন্নতি লাভ হইবে। লোকে তোমাকে দেখিয়া অবাক হইবে।” সত্যিই প্রকৃত পক্ষে লোকে গিরিশের পরিবর্তন দেখিয়া অবাক হইত।জীবনের শেষের দিকে আসিয়া গিরিশ চন্দ্র উপলব্ধি করিয়াছিলেন যে ঠাকুরকে মানা , ভালবাসা,পূজা করা কঠিন কাজ নয়, তাকে ভুলিয়া থাকাই কঠিন কাজ। এতেই বোঝা যায় ঠাকুরের বকলমার রহস্য। ঠাকুর কিভাবে গিরিশের দেহ ও মনে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে ছিলেন।
গিরিশ চন্দ্র শুধুমাত্র অভিনেতা ও নাট্যকার ছিলেন না। তার ছিল বিশাল জ্ঞান ভাণ্ডার ও অসাধারণ বুদ্ধি। প্রতিদিন তার কাছে বহু মানুষ আসতেন। তিনি তাদের সাথে শিল্প অভিনয় সাহিত্য বিজ্ঞান রাজনীতি চিকিৎসা শাস্ত্র মনস্তত্ব পুরান শাস্ত্র শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে তার সাক্ষাত কার এবং তার বিদ্রোহী উশৃঙ্খল জীবনের নানা রোমাঞ্চকর কাহিনী আলোচনা করতেন। সব ধরনের মানুষের সাথে তার মেলামেশা করবার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। মহেন্দ্র নাথ দত্ত লিখিয়াছেন- যাহারা গিরিশ চন্দ্র কে একটি দিক দিয়া দেখিয়াছেন, তাহারা সকলেই ভুল করিয়াছেন। দশ বারোটা গিরিশ একত্রে একটি গিরিশের মধ্যেই অবস্থান করিত। তার স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ।
ভারতের শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য মহাভারতে আছে—-জগতে যা কিছু আছে সবই ধ্বংসশীল। উন্নতির অন্তে পতন, মিলনের অন্তে বিচ্ছেদ, আর জীবনের অন্তে মৃত্যু এই অমোঘ নিয়ম সকল প্রানী এমনকি দেবতাদেরও গ্রাস করে। সর্বগ্রাসী মৃত্যুর কাছে প্রিয় অপ্রিয় বলে কেহ নাই। জগত রঙ্গমঞ্চে কেউ চিরকাল অভিনয় করতে পারেনা। নতুন অভিনেতাদের জন্য মঞ্চ ছেড়ে দিয়ে পুরোনো কে বিদায় জানাতে হয়। ইহাই প্রকৃত সনাতন রীতি।গিরিশ চন্দ্র প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে দাপটের সঙ্গে কোলকাতার সব রঙ্গমঞ্চে অভিনয় করিয়াছিলেন, নাটক লিখিয়াছেন, সঙ্গীত কবিতা সৃষ্টি করিয়াছেন, নাটক পরিচালনা করিয়াছেন, দর্শকদের চিত্ত বিনোদন করিয়াছেন । ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ও বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ হইতে যতদিন পর্যন্ত বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের ইতিহাস লেখা হইতে থাকিবে ততদিন গিরিশ চন্দ্রের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকিবে। গিরিশ চন্দ্রের বিশাল ও বৈচিত্র্যময় জীবনের শেষ ভাগের কথা লিখিয়াছিলেন তার সেক্রেটারি ও জীবনীকার অবিনাশ চন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়।1316 সাল মাঘ মাসের শেষ ভাগে কাশীধাম হইতে কলিকাতায় আসিয়া ধূমের যন্ত্রণায় কাতর হইয়া ছটফট করিতে লাগিলেন। এই জন্য বিখ্যাত সাহিত্যিক ও সুকবি শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্র নারায়ন রায় মহাশয়ের আগ্রহে তার ঘুঘুডাঙ্গার বাটিতে ফাল্গুন ও চৈত্র এই দুই মাস অবস্থান করেন। তাহার পর তিনি অসুস্থ শরীরে নিজের প্রিয় বাসভবনে ফিরিয়া আসেন। তার দ্বিতীয় ভার্যার প্রয়ানের পর হইতে তিনি নিজের শয়নকক্ষ ত্যাগ করিয়া সুদীর্ঘ দ্বিতল বৈঠক খানার এক প্রান্ত কাষ্ঠের প্রাচীর দ্বারা বিভাজিত করিয়া নিজের শয়নকক্ষে পরিনত করিয়াছিলেন। এই দ্বিতল বৈঠকখানার সহিত তাঁহার বহু প্রিয় মধুর স্মৃতি বিজড়িত ছিল। ইহাই ছিল তাহার অধ্যয়ন কক্ষ,ইহাই ছিল তাহার চিকিৎসালয়, এই স্থানই ছিল তাহার পরিচিত অপরিচিত বহু মানুষের সহিত তাঁহার সাহিত্য ধর্ম বিষয়ের প্রতিনিয়ত গভীর আলোচনা , নানা দুঃখ তাপে যন্ত্রণায় উত্যক্ত কর্মক্লান্ত জীবনের তাপ জুড়াইয়া শান্তি লাভ করিবার কক্ষ। এই কক্ষই ছিল তার কল্পনায় অবিস্মরণীয় রচনাবলীর সৃষ্টিভূমি।এই কক্ষই শ্রীরামকৃষ্ণদেবের পদধূলি বক্ষে ধারন করিয়া নানা পূন্য তীর্থভূমির মত তার কাছে মহিমান্বিত। এখানেই এই অমর কবি নাট্যকারের অন্তিম শ্বাস ফেলিবার পূর্ণ ইচ্ছা শক্তি সম্বলিত কক্ষ।পুত্র বৎসল পিতা গিরিশ চন্দ্র প্রিয় পূত্রের জন্য শেষ আশীর্বাদটুকু তার কম্পিত হস্তে পূত্র শিরে বর্ষন করিয়া জল চাহিলেন। শেষে 8th ফেব্রুয়ারি 1912 সালে রাত্রি একটা কুড়ি মিনিটে বৃহস্পতিবার গিরিশ চন্দ্রের অন্তিম শ্বাস শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ ঠাকুরের পদ প্রান্তে বিলীন হইল।তিনদিন অনিদ্রার পর মহাকবি মহানট মহানিদ্রায় মগ্ন হইলেন।
কাশী মিত্রের শ্মশান ঘাটে গিরিশ চন্দ্র ঘোষের অসংখ্য বন্ধুবান্ধব গুনগ্রাহী বহু সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির সমাবেশ হইল। মাননীয় ভূপেন্দ্র নাথ বসু, অমৃতবাজার পত্রিকার সম্পাদক মতিলাল ঘোষ, অধ্যাপক রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী, পণ্ডিত পাঁচকড়ি বন্দোপাধ্যায়, সুরেশ চন্দ্র সমাপ্তি,দীনেশ চন্দ্র সেন, বিশ্বকোষ সম্পাদক শ্রীযুক্ত নগেন্দ্র নাথ বসু,শ্রীযুক্ত দেবেন্দ্র নাথ বসু, প্রসিদ্ধ নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রের ললিত চন্দ্র মিত্র, আর জি করের প্রসিদ্ধ ডাক্তার নাট্যকার ক্ষীরোদ প্রসাদ বিদ্যাবিনোদ, অর্ধেন্দুবাবুর জ্যেষ্ঠ পুত্র ব্যোমকেশ মুস্তাফি, স্বামী সারদা নন্দ, শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ দেবের ভক্ত ও শিষ্যমণ্ডলী, নাট্যাচার্য অমৃত লাল বসু,অমরেন্দ্র নাথ দত্ত,,শ্রী যুক্ত মনমোহন পাঁড়ে, মহেন্দ্র কুমার মিত্র, শিশির কুমার রায় প্রায় সহস্রাধিক ব্যক্তি শ্মশানভূমিতে সমবেত হইয়াছিলেন। ধীরে ধীরে ঘৃত চন্দন কাষ্ঠ, ধূণা ও কর্পূরে ব্রক্ষ্মন্যদেব তার লেলিহান জিহ্বা বিস্তার করিয়া প্রিয়দর্শন, বীণাপানি বাগদেবীর বরপুত্র, শ্রীরামকৃষ্ণ ঠাকুরের শ্রীচরণ রজঃপূত বিশাল শরীর ভস্মে পরিনত করিলেন যা এই বিপুল সংসারের আনাচে কানাচে রন্ধ্রে রন্ধ্রে সেই উজ্জ্বল প্রতিভা মুকুট দেহের চিহ্নমাত্র অন্তর্হিত হইল। বেলুড় মঠের সন্যাসী গন নব বস্ত্র পরিধান করিয়া নব তাম্রকুণ্ডে ভস্মাবিষ্ট চিতা হইতে অস্থি সংগ্রহ করিয়া প্রস্থান করিলেন। এখন উহা বেলুড় মঠের সংরক্ষিত আছে।
জাঁকজমক ও বীরত্বের সঙ্গে গিরিশ চন্দ্র রঙ্গমঞ্চ ও জগত মঞ্চ হইতে বিদায় লইলেন। বাঙ্গালীরা আজও গিরিশ চন্দ্রের প্রতিভা হৃদয়ঙ্গম করিতে পারেনাই। গিরিশ চন্দ্রের দেহত্যাগের পর দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস বলিয়াছিলেন–গিরিশ চন্দ্রকে এখনও চিনতে বাকি আছে সকলের। মৃত্যুর একশত বৎসর পরে যেমন ইংল্যাণ্ডে শেক্সপীয়রের গ্রহণ যোগ্যতা বাড়িয়াছিল, তেমনই এমন একদিন আসিবে যেদিন সমগ্র দেশ গিরিশ চন্দ্রকে চিনিবে,তাহাকে আদর করিবে,তাহার গুনাবলী যথার্থ কীর্তন করিয়া গর্ব অনুভব করিবে। তাহার নাটক তাহার রচনাবলী তাহার সংগীত,তাহার নাটকের গভীরতা যাচাই করিবার জন্য কোনও মাধ্যম লাগিবেনা। পশ্চিম হইতেই বিদেশী শিক্ষার্থী নতজানূ হইয়া স্বীকার করিয়া যাইবে গিরিশ প্রতিভার বৈশিষ্ট্য,গিরিশ সাহিত্যের রস মাধুর্যের উৎস।
গিরিশ চন্দ্র ছিলেন চিরকাল স্পষ্টবাদী, অকপট এবং সত্যে স্থিত। তিনি নিজেকে পরিচয় দিয়া অকপটে বলিতেন “আমি পাপী”। জীবন সায়াহ্ণে স্বামী বিশুদ্ধানন্দকে গিরিশ চন্দ্র বলিয়াছিলেন—-“ওরে আয় আয়,আমাকে দেখ, আমাকে দেখবি তবে তো বিশ্বাস করবি। আমি কি ছিলাম আর কি করে দিয়েছেন—একেবারে দেবতা করে দিয়েছেন। ধমকে নয় রে ভালবেসে। ঠাকুর কি চমৎকার করিতে জানেন আমাকে দেখিলেই বুঝিতে পারিবি। মহাপ্রভু জগাই মাধাইকে উদ্ধার করিয়াছিলেন। তারা তো কোন ছাড়। ভাবিয়া দেখ তিনি আমার মত পাষণ্ড কে তাহার পায়ে স্থান দিয়াছেন। যদি জানিতাম আবর্জনা ফেলিবার মত এত বড় একটা ডাস্টবিন আছে তাহলে জীবন টা আরও চুটিয়ে ভোগ করে নিতাম।আমায় দেখ আমিই ঠাকুরের মিরাক্যাল। একজন বীরপুরুষ সর্বক্ষেত্রেই তার বীরত্ব বা পৌরুষত্বকে রক্ষা করিতে সংকল্প করেন। গিরিশ চন্দ্র ও তাই করিয়াছিলেন যেমন একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষ তার বীরত্বের সূচীকে রক্ষা করিয়া থাকেন। তার জীবন ছিল সর্বদাই লক্ষ্যাভিমুখী এবং কর্তব্যপরায়ন। যোগীপুরুষ যেমন নিন্দা ও স্তুতিতে অবিচল থাকেন গিরিশ চন্দ্রও তেমন প্রশংসা ও সমালোচনা কোনওটাই গ্রাহ্য করিতেন না।
গিরিশ চন্দ্রের ভিতরে একটি পবিত্র আধ্যাত্মিকতার ধারা প্রবাহিত হইত তার শৈশব হইতেই। বাল্য ও কৈশরে তিনি কোনও উপযুক্ত ধর্ম বিশ্বাসের সহায়তা লাভ করেননাই যা তার অন্তরকে উদ্দীপ্ত করিতে পারিত।সেই কারণেই তিনি সংশয় ও অনিশ্চয়তার অন্ধকারেই বহুবছর নিমজ্জিত ছিলেন। এই সময় একমাত্র নাটকই ছিল তার অবলম্বন আর থিয়েটার ছিল তার দেবালয়। পরম ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাকে শৈশব ও কৈশোরের ভ্রান্ত বিশ্বাস ফিরাইয়া আনিয়া তাকে সঠিক সরল দিশার সন্ধান দিয়েছিলেন এবং সেই পথে চালনা করিয়াছিলেন পরম সহিষ্ণুতা ও ভালবাসার মাধ্যমে যা গিরিশের নাটক ও তার চরিত্রগুলির মধ্যে প্রতিভাত হইয়া ভিন্ন মাত্রা সংযোজিত করিয়াছিল। এখানেই গিরিশ চন্দ্রের সফলতার প্রবাহ নাট্যমঞ্চ ও আধ্যাত্মিক মঞ্চকে অভিষিক্ত করিয়া সার্থকতা আনয়ন করিয়াছিল। তাই সবশেষে বলা যায় গিরিশ চন্দ্র ছিলেন সবদিক থেকেই ব্যতিক্রম ও সফল।