।। ছায়াময় মায়াময়ী।। #কলমে : সাহানা
।। ছায়াময় মায়াময়ী।।
#কলমে : সাহানা
ঘাড়ে একটা শিরশিরে অনুভূতি হতেই সীমা লাফিয়ে উঠল। এই রে! পশ্চিমের জানলাটা এখনও খোলা! সকালের রোদ খাইয়ে বন্ধ করে দেওয়ার কথা! ছুটতে গিয়ে থমকে গেল!
পশ্চিমের জানলা বাড়ির শেষ প্রান্তে। বাড়িটা একটু অদ্ভুত। চৌকোণো মাপের। কিন্তু দুটো সাইডে, উত্তরে আর পশ্চিমে কেমন যেন ভেতরে ঢুকে এসেছে! একটা অস্বাভাবিক খাঁজ। অন্তত সীমার মনে হয়!
এই দুই অস্বাভাবিক স্হানেই আছে দুটি জানলা। গরাদবিহীন। কাচের পাল্লা। খুলে দিলেই রোদ আর হাওয়া ঝাঁপিয়ে আসে। পুব দক্ষিণের বাতাসের থেকেও অনেক শীতল, অথচ অস্বস্তিকর। এর রহস্য আজও অজানা। সীমার কাছে।
বাড়িটা বানিয়েছিল একজন বিদেশী স্থপতিকার। তার প্ল্যানেই ব্যাপারটা আছে। একফালি ফাঁকা জমি চারপাশ ঘিরে। পাঁচিল। পেছনে এবং সামনে সীমানা ঘেঁষে ফুলের বেড। বড় গাছগুলো সব কম্পাউন্ডের বাইরে। দেওদার আর ঝাউ। বর্ষার ঝাপসা দিনে ওরা মাথা দোলায়। মনে হয়, হাতছানি দিয়ে ডাকছে। পাহাড়ের এই ঢালে বৃষ্টি হয়, জল দাঁড়িয়ে থাকে না। অথচ, এক ঘোর বর্ষায় বাড়ি ফেরার পথে দেখেছিল, বাড়ির ঠিক দুহাত দূরে একটা ডোবা তৈরি হয়েছে। অস্হায়ী ডোবা। বাড়ির ছবিটা পড়েছে উল্টো হয়ে। বৃষ্টির ধারা গুলোর উল্টো ছবি। ঠিক যেন বাস্তব আর কল্পনার এক আজব গন্ডী।
আজও ভাবলেই অবাক লাগে তার। কেমন যেন গা শিরশিরিয়ে ওঠা অনুভূতি! অথচ এই অনুভূতি নিয়ে বাড়িটায় কেটে গেল এক, দুই, পাঁচ, দশ…..প্রায় চল্লিশ বছর। এখনও পশ্চিমের জানলাটা খুললে একইরকম ফিলিংগস্!!
হঠাৎ মনে হল, কিচেনের পাশে কেউ বা কিছু একটা নড়ে উঠল।
-কে ওখানে?
গলাটা অনাবশ্যকভাবেই চড়া হয়!
বাতাসে ভেসে যায় শব্দগুলো। একটা মৃদু আলোড়ন।
কেউ যেন ছুটে পালালো।
কে ও?
চিন্তা ভাবনা সরিয়ে রেখে দ্রুত পায়ে জানলা বন্ধ করতে যায়। কাচের পাল্লা টেনে দিয়ে বন্ধ করতেই বাইরের ঝাপসা কুয়াশায় একটা মুখ! এক দৃষ্টিতে এদিকে তাকিয়ে আছে। অবিকল সেই মুখ। যেটা দেখেছিল বেশ কিছু বছর আগে। এক সন্ধ্যায়। তারপরেই তো….
এইরকম আরও অজস্র অস্বাভাবিক ব্যাপার স্যাপার বয়ে নিয়ে এতগুলো বছর কাটানো। মায়া ত্যাগ করা সম্ভব হয়নি।
ইদানিং ভারী অদ্ভুত কিছু অনুভব করে সে। কারা যেন ছায়া ছায়া অবয়ব নিয়ে চলাফেরা করে। ফিসফিস গুনগুন শব্দ সারাদিন। একটা মিষ্টি সুর বাজতে থাকে কানে…বহুদিন আগের গ্রামোফোন! সব থেকে বড় ব্যাপার, সে বুঝতে পারে, এ বাড়িতে সে একা নয়। তাকে ঘিরে রয়েছে আর একটা জগৎ..অনেকটা নাটকের সিনের মত..একটার পর একটা…অনেকগুলো চরিত্র অনবরত হাসছে, খেলছে, ছুটছে কিন্তু স্পর্শ করা যাচ্ছে না, যাবেও না বোধহয়! এভাবেই কেটে যাবে আরও এক যুগ! দীর্ঘশ্বাস পড়ে ছায়া কায়া দুলিয়ে।
卐卐卐卐卐卐卐卐卐卐卐卐卐
অমলা আর তার মেয়ে রিমকি ভালোই আছে। বাড়িটাও দিব্যি। রিমকির বাবা কিনেছেন জলের দরে। পাহাড়ের ঢালে লাল টালির বাংলো…দূর পাইনের বন আর আঁকাবাঁকা সর্পিল পথে বিচরণের সময় ঝিরঝিরে হাওয়া কি যে ভালো!
রিমকির বাবা একটি প্রজেক্ট নিয়ে মাস দুয়েক হল বাইরে আছেন। শহরের বাইরে।
বাড়িতে দুটি প্রাণী। অমলা আর রিমকি কিন্তু বুঝেছে তারা ছাড়া আরও একজন আছে আনাচে কানাচে মিশে, এ বাড়ির নিঃশ্বাসে, নিঃশব্দে! তাকে ধরা বা ছোঁয়া সম্ভব নয়। কিন্তু সে আছে। ভারী ভালো একজন কেউ।
বাড়ির প্রতিটি অংশে সে নজর রাখে। কোনো জানলা বা দরজা বন্ধ করতে ভুলে গেলে সে ঠিক বন্ধ করে দেয়। আলমারির পাল্লা খুলে চলে এলে, গুছিয়ে বন্ধ করে চাবি দেওয়া হয়ে যায়, কিচেনে গ্যাসের নব কখনও খোলা পড়ে থাকে না! ওভেনে আজ পর্যন্ত দুধ ওথলায়নি! কাপড় কাচার মেশিনটাও বেশ চলে! নিজেই।
প্রথম প্রথম হতচকিত হলেও ধীরে ধীরে সব অভ্যাস হয়ে যায়। সব মেনে নিয়ে তারা সবাই মিলেমিশে থাকে। একসাথে।
অথচ ঘরোয়া কাজকর্মের জন্য যে স্থানীয় মহিলা এসেছিল, চোখ কপালে তুলে দ্বিতীয় দিনই বলেছিল, এ বাড়িতে সে কাজ করবে না। ভুত আছে এখানে!
স্থানীয় বাজারে ফলমূল শাকসবজি কিনতে গিয়েও একটাই ফিসফাস শুনেছে….এই বাড়িতে অবিবাহিত এক ভদ্রমহিলা…খুন হয়েছিলেন এক দালালের হাতে…বাড়ি বেচতে রাজি হন নি…নজর রাখা হত তাঁর গতিবিধির ওপর, অনবরত, তারপর এক রাতে সুযোগ বুঝে ঝাঁপিয়ে পড়ে আততায়ী। দেহের মৃত্যু হল ঠিকই, মুক্তি পেল না আত্মা। ঘুরে ফিরে বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যেই তার আবাস, জীবন্ত জীবনের মধ্যে বিদেহীর ভেসে থাকা!!
এক আশ্চর্য সহাবস্থান!!