ছোট গল্পঃ – আশ্বিনের ভোলবদল কলমে :- আবু ওবাইদুল্লা আনসারী
ছোট গল্পঃ – আশ্বিনের ভোলবদল
কলমে :- আবু ওবাইদুল্লা আনসারী
আশ্বিনের বিকেল,চারিদিক খাঁ খাঁ করছে ,তাপদাহ প্রকৃতি,ঝড় হবে মনে হচ্ছে।একটু আগে কিন্তু সেইরকম ছিল না,চারিদিকে কাশফুলের উল্লাস,আকাশে সাদা মেঘের লুকোচুরি ,মাঝে মাঝে পাগলা হওয়ার নাচন। আশ্বিন মাসের বিকালের এই ভোলবদল দেখে মৃদু হাসতে থাকে বৃদ্ধাশ্রমের বারান্দায় বসে থাকা প্রতিমা ব্যানার্জি, হাতে ছোট্ট একটা বাটিতে পায়েস, চোখে একরাশ প্রতীক্ষা,শূন্যতার মহাসমুদ্র হতে উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে বুকে।রাত্রি হয়ে আসছে,বারান্দার অন্ধকারে জোনাকিরা নিরাপদে উঠোনের বুকে আল্পনা এঁকে দিচ্ছে।এই ভাবেই বসে থাকে, এটি তার নৃত্য দিনের অভ্যাস।ওই যে রাস্তাটা নদীর ধার ঘেঁষে চলে গেছে বড় রাস্তার দিকে,সেই দিকেই তাকিয়ে থাকে সে,ছেলের অপেক্ষায়।ছেলে কিছুদিন পর আসবে বলেছিল,আজ তিন বছর হয়ে গেল,এই তিন বছরের প্রতি মুহূর্ত ছেলের জন্য অপেক্ষা করে সে,এই ভাবেই একাকী বসে থাকে,শুধু একাকী নয় বৃদ্ধাশ্রমের প্রায় প্রত্যেকটা চোখ এই রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে, এত কাছে থাকলেও সব একাকীর মতো থাকে,একাকী বলা ভুল,সাথে থাকে অসংখ্য এলেমেলো কিছু স্মৃতি, দশ মাস একটা লড়াইয়ের আর্তনাদ,গভীর সুমুদ্রের শূন্যতা সাথে থাকে,।
হাজার হতাশা বুকে নিয়ে সে বৃদ্ধাশ্রমের দায়িত্বে থাকা ছেলেটিকে বলে, বাছা এই ফোনটি খারাপ নাকি,কিছুদিন থেকে বাজে না তো,দেখ না আমার ছেলে হয়ত ফোন করেছে,
কিছুটা বিরুক্ত হয়েই সে বলে,” প্রতিদিনই তোমায় বলি মাসী,ফোনটি ঠিক আছে,আগে দেখগা তোমার ছেলে বেচেঁ আছে কি না,ওই জনোয়ার ফোনও ধরে না”
মুখে হাত দিয়ে প্রতিমা দেবী কাঁদতে থাকে,আসে পাশে আরও অনেকেই জমা হয়,বৃদ্ধাশ্রমে এই নাটক খুব দেখা যায়,কেউ বেশি ভেঙ্গে পড়লে, বুকে হাজার হাজার যন্ত্রণাকে লুকিয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে মিথ্যা আশ্বাস দেয়,বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিটি কোণা যন্ত্রণার চোরাবালিতে বিদ্ধ হলেও এর দেওয়াল গুলিতে লুকিয়ে থাকে এই পৃথিবীর সমস্ত মানবিকতা,তাই তো বৃদ্ধা শ্রমের আর্তনাদ দেওয়াল ভেদ করে আপনজনদের কর্ণকুহরে কোনদিনই পৌঁছায় না।কত মায়ের অপেক্ষা,কত বাবার স্বপ্ন ,মমতার আর্তনাদ সবই বন্দী থাকে এই চার দেওয়ালে।মানবিকতা এখানে পদদলিত হয়,।
হাতে পায়েস নিয়ে প্রতিমা দেবী মনে পড়ে সেই দিনের কথা, দশ মাসের জরায়ুর লড়াই করে যমকে হারিয়ে কল্যাণকে জন্ম দিয়েছিল।সেই দিন ছিল তার জীবনের সবচাইতে খুশির দিন,গোটা বাড়িতে প্রাণোচ্ছল উল্লাস, সদ্যোজাত ছেলেকে কোলে নিয়ে বিভাষ মুখার্জী ছেলের নাম দিয়েছিল কল্যাণ,সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে পরিবারের কল্যাণ নিয়ে এসেছে বলে ধারণা করেছিল সে।বৃদ্ধ ঠাকুরমা আর পাঁচজনের মতো না,সে বরাবরই বলত নাতনি হওয়ার পক্ষে,নাতনিকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখেছিল,নাম ও রেখে দিয়েছিল ,তাই কিছুটা মুখভারী করেই সে প্রতীক্ষা বলে ডাকত।এই ভাবেই চলতে থাকে, নব্বই দশকের একটা সামান্য প্রাইমারী স্কুলের মাস্টারের ছেলে মানুষ করা স্বপ্ন,ঠিক বামন হয়ে চাঁদ ছোঁয়ার স্বপ্ন,সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রম,সাথে এক্সট্রা টিউশনি ক্লান্ত শরীর এই ভাবেই দায়বদ্ধতার কাছে হেলিয়ে দিত, দুটি প্রাণী তাদের সমস্ত যৌবন,আনন্দ,সমস্ত বিনোদন লুটিয়ে দিত সন্তানকে মানুষ করার জন্য,সন্তানের ভবিষ্যতের কাছে।এই ভাবেই চলছিল,হটাৎ একদিন বাস দুর্ঘটনায় বিভাষ মুখার্জীর মৃত্যু ঘটে।তারপর শুরু হয় আসল লড়াই,একদিকে স্বামীর ক্লান্ত শরীরে দেখা স্বপ্ন,একদিকে বাবাকে হারিয়ে মণি হারা ফণির মতো সন্তান,আর অন্যদিকে স্বামীকে হারিয়ে ভেঙ্গে পড়া মন। না সেদিন ভেঙ্গে পড়িনি,অন্তত সন্তানের চোখে ভেঙ্গে পড়েনি বেহুলার মতো সন্তানের ভবিষ্যৎকে ফিরিয়ে এনেছিল সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে।তিন চার বাড়িতে ঝির কাজ, সারারাত জেগে তাঁতের কাজ,নিজে সমস্ত সখ,আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে ছেলেকে মানুষ করেছিল,মানুষ করেছিল কি ঠিক বলতে পারবে না বড় সাহেব বানিয়ে ছিল,তারপর কয়েকমাস ছিল স্বপ্নের মতো দিন গুলি,রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি, রানীর মতো ছিল প্রতিমা দেবী,তারপর ছেলের আপত্তি সত্ত্বেও ছেলের জন্য নিয়ে আসল একটা সুন্দর ফুটফুটে বউ। এরপর হঠাৎ আশ্বিনের ভোলবদলের মতো কল্যানের পরিবর্তন ।
প্রতীমা দেবীর চোখের জলের কয়েক ফোঁটা সাদা পায়েসের ওপর পড়ে,ছেলেটা যে খুব পায়েস ভালোবাসে।”হয়তো সে জন্মদিনে বিশাল পার্টির আয়োজন করেছে,সেখানে এর চেয়ে কত দামী দামী খাবার আছে,তাই মার হাতের সেই পায়েস ভুলে গেছে,”প্রতীমা দেবী হাসতে হাসতে বলে।বৃদ্ধাশ্রমের খাবারের ঘণ্টা বেজে উঠে। দেরি দেখে সকিনা বিবি তার জন্য একটা শুকনো রুটি আর একটু ডাল,নিয়ে আসে সাথে একটু লবণ বাটা,।শুকনো গলায় রুটি মুখে দিয়ে পায়েসের দিকে তাকাতে থাকে প্রতিমা ব্যানার্জি,আজ শাশুড়ির প্রতীক্ষা ডাকটা খুব মনে পরে,আশ্বিনের ভোলবদলের মতো কল্যাণ প্রতীক্ষা হয়ে উঠে।তার জীবনে কল্যাণ আজ দু চোখের প্রতীক্ষা হয়ে উঠে।