গল্প। # শিরোনাম-রক্তশপথ। # কলমে-ছন্দা চট্টোপাধ্যায়

# গল্প।
# শিরোনাম-রক্তশপথ।
# কলমে-ছন্দা চট্টোপাধ্যায়

অভিজাত বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়ালো মিলিটারির গাড়ি,নামানো হলো কফিনটা।অনুরাধা ধীর পায়ে এসে দাঁড়ালেন সামনে।ঐ কফিনের মধ‍্যে চিরনিদ্রায় শুয়ে আছে তাঁর একমাত্র ছেলে পুলওয়ামার বীর শহিদ অমিত।

অনুরাধার মনে পড়ে এইভাবেই কুড়ি বছর আগে এসে দাঁড়িয়েছিল কার্গিলের শহিদ সুমিতের কফিনে মোড়ানো মরদেহ।অমিত তখন মাত্র পাঁচ বছরের।চোখের জল ফেলার সময় পাননি অনুরাধা।শিশুপুত্রকে তার বাবার মতোই তৈরী করতে হবে।সুমিত বিয়ের পরেই বলেছিল অনুরাধাকে,-“আমরা দেশমাতার কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ।কথা দাও,যদি আমি না থাকি আমাদের সন্তানকে ঠিক আমার মতোই বড় করবে।ভারতমাতার সন্তান আমরা,দেশের কাজে সমর্পিত জীবন আমাদের।”-কথা দিয়েছিল অনুরাধা।কথা রাখার দায়িত্ব যে এত তাড়াতাড়ি এসে যাবে বোঝেনি সে।তখনো নতুন বিয়ের গন্ধ যায়নি শরীর থেকে।কত কী প্রতিশ্রুতি চায় তো নতুন বৌদের স্বামীরা।আমার মা-বাবার যত্ন নেবে,আমার ভাইবোনদের নিজের ভাইবোন ভাববে,ইত‍্যাদি।সুমিত কী চাইল,ভবিষ‍্যতে কী হবে,ভাবার অবকাশ কোথায়?ভারতমাতার বীর সৈনিকের সুঠাম,বলিষ্ঠ শরীরে নিজেকে মিশিয়ে দেওয়ার সুখে তখন আবিষ্ট সে।গর্ভে অঙ্কুরিত হলো ভবিষ‍্যৎ।অনুরাধার আর কী চাওয়ার থাকতে পারে?কোন প্রতিশ্রুতি চাওয়ার কথা ভাবতেই পারেনি সে।শুধু দিয়েই গেল।

শহিদের বিধবা স্ত্রী সরকারী চাকরি পেল।ছেলেকে ভর্তি করল পুরুলিয়া সৈনিক স্কুলে।কঠোর নিয়মানুবর্তিতায় বড় হলো ভবিষ্যতের দেশ-সেবক।বাবাকে দেওয়া মায়ের প্রতিশ্রুতি মতো আর্মিতে জয়েন করলো।ঠিক বাবার প্রতিচ্ছবি যেন। অনুরাধা ছেলেকে রওনা করিয়ে দিয়ে স্বামীর ছবির সামনে দাঁড়ালো-“তোমার কথা রেখেছি।ছেলেকে রক্ষা করো।ওকে যেন না হারাতে হয় আমার।”-ফটো প্রতিশ্রুতি দেয় না।

বিউগল বেজে উঠলো,গান স‍্যালুটে,শোকাবহ পরিবেশে ছাই হয়ে গেল অনুরাধার স্বপ্ন,আশা।নশ্বর দেহ ভস্মীভূত চিতানলের রুদ্র তাপে/ সর্বহারা শহিদের মা পুড়ছে দারুণ সন্তাপে।

বাড়ি ফিরে অনুরাধা দাঁড়ালো দেওয়ালে টাঙানো পিতা-পুত্রের ফটোর সামনে।পাশেই সুদৃশ‍্য সোকেসে রয়েছে সুমিতের মরণোত্তর সম্মানের স্মারক।পাঁচ বছরের অমিতের হাত ধরে গিয়েছিলেন এই স্মারক আনতে।উদ্গত অশ্রু গোপন করে নিয়েছিলেন স্মারক সম্মান।শহিদের স্ত্রীকে কাঁদতে নেই।গর্বে মাথা উঁচু করে দেখাতে হয় তিনি গর্বিতা স্ত্রী।আর পাঁচজন সাধারণ মেয়ের মতো মাথা ঠুকে শোক প্রকাশ একজন আর্মি অফিসারের স্ত্রীর পক্ষে শোভনীয় নয়।আবার একদিন মহীয়সী নারী,গর্বিতা মায়ের বেশে যেতে হবে অমিতের প্রাপ‍্য পুরষ্কারটা আনতে।করতে হবে দেশমাতৃকার প্রতি আনুগত্য ও কৃতজ্ঞতার অভিনয়।

বঙ্গোপসাগরে পুঞ্জিভূত নিম্নচাপ প্রবল ঘূর্ণিঝড় নিয়ে আছড়ে পড়ল উপকুলবর্তী এলাকায়।খোলা জানালার কপাটগুলো মাথা ঠোকাঠুকি করছে।অনুরাধার বুকের মধ্যে গর্বের ঝাড়বাতিটা ভেঙে চূরমার হয়ে গেল।হৃৎপিণ্ডে,ফুসফুসে বিঁধে গেল কাঁচ। তখন বিদ‍্যুৎ সংযোগ ছিন্ন হয়ে সারা শহরে নেমে এসেছে আদিম অন্ধকারের আস্তরণ।হঠাৎই বহু বছরের চেপে রাখা গোঙানিটা গলা চিরে হাহাস্বরে বেরিয়ে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে মিশে গেল–“ঈশ্বর কথা দিয়েছিলাম,দেশের সেবায় স্বামী -পুত্রের জীবন বলিদান মেনে নেব।কথা রেখেছি ঠাকুর।কেউ আমাকে কোন কথা দেয়নি।কিন্তু আমি এমন কথাও তো দিইনি যে,আমার শোককেও বলি দেবো?ঊচ্ছসিত সেই শোকের ঝড় যেন গিয়ে লাগল গাছেদের মাথায়।ব‍্যথার ভারে ভেঙ্গে পড়তে লাগল তারা হুড়মুড় শব্দে।আকাশের বুক চিরে বিদ‍্যুৎজিহ্ব লেলিহান রূপে সশব্দে নেমে আসল বজ্রপাত হয়ে।ভাগ‍্যহতা রমণীর দুঃখে এ যেন প্রকৃতির প্রকৃত শোকের প্রকাশ।সহানুভূতি নয়,সমানাভূতি।দশরথের পুত্রব‍্যথা গাথায় গাঁথলে পূণ‍্যশ্লোক/কেমন করে জানলে ঋষি কাকে বলে পুত্রশোক?

এতক্ষণে অনুরাধার চোখের কুল ছাপিয়ে ঊষ্ণ অশ্রুর প্লাবন বইতে লাগল।তাকে ভালো রাখবে বলে কেউ কথা দেয়নি।

————————————————————-

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *