গিরিশ চন্দ্র ঘোষ ও নাটক ✒️ পাপিয়া সাহা

গিরিশ চন্দ্র ঘোষ ও নাটক

পাপিয়া সাহা

পূর্ব প্রকাশিতের পর
পঞ্চম পর্ব।

গিরিশ চন্দ্র জানতেন তার অভিনেতা অভিনেত্রীরা উচ্চ শিক্ষিত নয়।তাই তিনি এমন সহজ সরল ভাষায় সংলাপ রচনা করতেন যাতে নাটকের কুশী লবেরা সহজেই উচ্চারণ করতে পারে এবং স্বচ্ছন্দে তা প্রকাশ করতে পারে।তিনি অনুভব করেছিলেন ঘাত-প্রতিঘাত নাটকের প্রানশক্তিকে ধরে রাখে এবং ঘটনা প্রবাহকে বয়ে নিয়ে চলে ভাষা।তাই গিরিশের নাটকের ভাষা ছিল স্বাভাবিক, আবেগপূর্ণ,কথ্য, কাব্যিক ও সহজবোধ্য।

গিরিশের সক্রিয় বুদ্ধিদীপ্ত মনন শক্তি এত দ্রুত বিচরণ করত যে তার ভাবের সঙ্গে তাল মেলাতে একজন দক্ষ সেক্রেটারির প্রয়োজন হয়ে পরেছিল। অমৃতলাল বসু, কেদারনাথ চৌধুরী, অমৃতলাল মিত্র, দেবেন্দ্র নাথ মজুমদার, দেবেন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ স্বনামধন্য লেখকেরা তার সেক্রেটারি ছিলেন। এরা গিরিশের মুখ থেকে শ্রুতি লিখনের মাধ্যমে তার বহু নাটক লিপিবদ্ধ করেছেন। শেষ পনের বছর গিরিশের সেক্রেটারি হয়ে কাজ করেছিলেন অবিনাশ চন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়। ফলে তার পক্ষে পরবর্তি কালে গিরিশ চন্দ্র ঘোষের তথ্যপূর্ণ জীবনী লেখা সম্ভব হয়েছিল।
গিরিশ চন্দ্র দু বছর ন্যাশনাল থিয়েটারের ম্যানেজার ছিলেন। ঐ সময়ের মধ্যে তিনি নয়টি নাটক ও ছয়টি গীতি নাট্য রচনা করেন। সে সময় তার তত্ত্ববধানে ন্যাশনাল থিয়েটার স্বর্ণযুগের সৃষ্টি করেছিল। যে বঙ্গ রঙ্গশালা অবাঞ্ছিত নাটক ও অভিনয়ের চাপে প্রাণ হীন হয়ে পড়েছিল , নাট্যবানীর বরপুত্র গিরিশ চন্দ্র সেই মৃতকল্প দেহে সঞ্জিবনী মন্ত্র ছিটাইয়া প্রাণ সঞ্চার করিলেন। সকলেই উপলব্ধি করিলেন কেবল অভিনয় প্রতিডাই নাট্যশালার সর্বাঙ্গীন শ্রী বৃদ্ধি করিতে পারেনা ।নাট্যপূজার প্রধান উপকরন ইহার প্রাণ আর ইহার অন্ন হইল নাটক। গিরিশ চন্দ্র অন্ন দিয়া বাংলা নাট্যশালার প্রাণ রক্ষা ও পুষ্টি বর্ধন করিয়াছিলেন। নাটকের মজ্জায় মজ্জায় রসবোধ সঞ্চার করিয়া ইহাকে আনন্দ পূর্ণ করিয়া তুলিয়াছিলেন। আর এই জন্যই গিরিশ চন্দ্র “Father of Native Stage”। যে অমৃত পানে বাংলা নাট্যশালা আজও বছরের পর বছর উত্তীর্ণ করিয়া বাঁচিয়া আছে। প্রকৃতপক্ষে তা গিরিশের বহন করিয়া আনা অমৃত ভাণ্ড থেকে অমৃত পান করিয়া। কাজেই এ কথা অনস্বীকার্য যে বাংলা নাট্যশালার পিতৃত্বের গৌরবের অধিকারী একা তিনিই। 1869 থেকে 1912 সালের মধ্যে গিরিশ চন্দ্র কোলকাতার প্রায় সমস্ত থিয়েটারের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন। তার অধিকাংশ নাটক রামায়ণ, মহাভারত, পুরান, সন্তানের জীবনী, ঐতিহাসিক ঘটনাবলী ও সামাজিক বিষয় অবলম্বনে রচিত।নাটকের চরিত্র গুলির মাধ্যমে তিনি দর্শকদের উচ্চ আদর্শ ও ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। প্রকৃত হিন্দু সত্ত্বা ও ধর্মের প্রতীক শ্রীরাম,শ্রীকৃষ্ণ, ভীষ্ম , অর্জুন,ভীম, শ্রী চৈতন্য প্রভৃতি চরিত্রগুলির প্রকৃত আদর্শ উদ্ঘাটন করিয়া উপস্থাপনা করিতে পারিলে হিন্দুদের হৃদয়গ্রাহী হাওয়া সম্ভব। বীর চরিত্র যুদ্ধ প্রিয় বীর জাতির আদরের, সেইরূপ সহিষ্নু, আত্মত্যাগী, লোকধর্মের পালন কারী নায়ক হিন্দু হৃদয়ে স্থান করে নেবে সহজেই। হিন্দস্থানের মর্মাশ্রয় করে নাটক রচনা তার উচ্চমার্গের মানসিকতার পরিচয় বহন করে যা বিদেশীয় ভীষণ তরবারির ধারেও উচ্ছেদ করতে পারেনি।
নানারকম অখ্যাতি ও কুরুচিকর সমালোচনা সত্ত্বেও গিরিশ চন্দ্র ছিলেন একজন কর্মনিষ্ঠ, শৃঙ্খলাপরায়ন, ও সহৃদয় পরিপূর্ণ মানুষ। গিরিশের উশৃঙ্খলতার কথা খানিক টা অতিশয় দোষে দুষ্ট। “The Face of Silence ‘”এ ধন্যবাদ মূখার্জী তার চরিত্রের কয়েকটি দিক অতি সতর্কতার সাথে তুলে ধরেছেন।
গিরিশ চন্দ্র নাটক অন্ত প্রাণ ছিলেন। প্রথাগত ঐতিহ্য থেকে বেরিয়ে এসে নাটককে অভিনবত্বের আঙ্গিনায় এনে তাকে আধুনিক গতিশীলতা এনে দিতে তিনি নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। আগে পুরুষ অভিনেতারাই নারী চরিত্রে অভিনয় করতেন। কিন্ত গিরিশ চন্দ্র বারবনিতাদের নিযুক্ত করে তাদের প্রতিভা ও দক্ষতাকে পরিপূর্ণ কাজে লাগিয়ে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ করে দিতেন। গিরিশের নির্বাচিত অভিনেত্রীরাও পূর্ণ নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা ঢেলে অভিনয় করে চরিত্র গুলি ফুটিয়ে তুলতেন। গিরিশ চন্দ্র জানতেন যে তার নির্বাচিত মেয়েরা স্বল্প শিক্ষিতা। তাই তিনি খুব সহজ সরল ভাষায় নাটকের সংলাপ তৈরি করতেন যাতে তারা স্বাভাবিক ভাবে কথা বলে ও অভিনয় করে চরিত্রগুলি ফুটিয়ে তুলতে পারে। খ্যাতনামা অভিনেত্রী তিনকড়ি স্বীকার করেছিলেন যে “সম্পূর্ণ নিরক্ষর মেয়ে ছিলাম। শুধু তারই (গিরিশ চন্দ্রের) দয়ায় আজ আমি একজন সফল অভিনেত্রী।”।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *