তিনবিঘা স্মৃতিকথা © ✍ সায়ন্তন ধর
তিনবিঘা স্মৃতিকথা
© ✍ সায়ন্তন ধর
আমি অনেক জায়গায় আমার প্রথম ঘোরার স্থান হিসেবে তিনবিঘার কথা উত্থাপন করলেও তিনবিঘা সম্পর্কে কখনও সেভাবে বলা হয়নি। কারণ তিনবিঘা আমি এত ছোট বয়স থেকে ঘুরেছি যে সে সম্পর্কে সেভাবে কিছু লেখাও নেই। আবার অন্যভাবে বললে তিনবিঘা আমার জীবনের সাথে এতটাই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে গেছে যে তাকে আমার দর্শনীয় স্থান হিসেবে আলাদা করতে ইচ্ছা করেনি কখনও। আজ সেই তিনবিঘাকে আমি ছোট থেকে যেভাবে দেখেছি সেটাই বলার চেষ্টা করবো। সম্ভবত আমার প্রথম তিনবিঘা যাত্রা ১৯৯৮ সালে। সে সময়ের অ্যালবাম থেকে জানতে পারি আমরা ভ্যানে করে গিয়েছিলাম। এপ্রসঙ্গে ভ্যান সম্পর্কে একটু বলতে হয়। ভ্যান হল সাইকেল ভ্যান। রিক্সার মত তিন চাকা বিশিষ্ট বিশেষ যান। আমি জানি ভ্যানের সাথে অনেকেই পরিচিত। তবে মেখলিগঞ্জের ভ্যান যেন সব স্থানের ভ্যানের চেয়ে কিছু আলাদা। অত্যন্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। দুই পাশে তিন তিন ছয় জন বসতে পারে। বসার জায়গাটা উঁচু, পিড়িতে বসার মত অভিজ্ঞতা। পা ঝুলিয়ে বসার কোন ব্যবস্থা নেই। সামনের হাতলে একটি নারকেল তেলের টিনের কৌটোতে সলতে লাগানো, যা জ্বালালে অন্ধকারে বাতির কাজ করে। মেখলিগঞ্জ থেকে তিনবিঘা প্রায় ১১ কিমি পথ। ভ্যানে করে এতটা পথ পাড়ি দেওয়ারও একটা অন্যরকম আকর্ষণ আছে। শরতে কাশফুল সবাই দেখেছে। তবে আমি বসন্তেও কাশ ফুটতে দেখেছি। যদিও কাশ বলতে আমরা যে গাছকে বুঝি এ তা নয়। এ শুধু বসন্তকালেই ফোটে। উচ্চতা খুব বেশি হলে এক থেকে দেড় ফুট। আমার কাছে এই গাছের বিজ্ঞান সম্মত নাম আজও অজানা। যাইহোক, ছবি বলে সেখানে আমরা তেমন কোন এক কাশের বনে ছবি তুলেছি, সুপারি গাছে হেলান দিয়ে। আর ফেরার পথে আকাশে পড়ন্ত সূর্যের আভা ও মেঘের ঘনঘটা চোখে পড়েছে। এরপর আরও বেশ কয়েকবার সেখানে যাওয়া হয়েছে। বাড়িতে কোন আত্মীয় এলেই তাঁদের এ স্থান দেখানোর জন্য দলবেঁধে সেখানে যাওয়া হতো। তবে তা কখনোই আর ভ্যানে নয়। কখনও লাল, নীল অ্যাম্বাসেডর, কখনও বা সবুজ টাটাসুমো। তিনবিঘায় ঢুকতেই হাতের ডানদিকে একটা চায়ের দোকান। বাঁ দিকে একটু কৃত্রিম উঁচু জায়গা, ঠিক যেন টিলার মত। সেখানে অতন্দ্র প্রহরায় থাকে বিএসএফ। আমার ছোট থেকেই ভীষণ উৎসাহ বিএসএফ এর প্রতি। কিন্তু ওঁরা যে হিন্দিতে কথা বলে। আর আমি হিন্দিতে কথা বলতে পারিনা। তাই ভীষণ ভয় হতো। তবু সাহস করে কথা বলতাম ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে। ওঁরা কিন্তু খুব ভালোবাসতো আমাকে। ওখানকার অন্যতম আকর্ষণ ছিল শীতে সন্ধ্যা পাঁচটায় ও গ্রীষ্মে সন্ধ্যা ছ’টায় তিনবিঘা করিডোর এর দুই আন্তর্জাতিক ফটোকের পাশে চারটি ভারতীয় পতাকাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় নামিয়ে আনার অনুষ্ঠান। সেসময় করিডোর দিয়ে অন্যান্য যাতায়াত বন্ধ থাকতো। চার কোণে একসাথে চারটি পতাকা নামতো উচ্চকিত কম্যান্ডের সাথে সাথে। তারপর কি পরম শ্রদ্ধায় ও মমতায় তাদের ভাঁজ করে ঠিক যেন শিশুর মত করে নিয়ে আসা হত। একবার মনে আছে একজন বিএসএফ জওয়ানের সাথে কথা হচ্ছিল। কথায় কথায় বাড়ি জিজ্ঞেস করায় তিনি পূর্ব দিক নির্দেশ করেন। এদিকে পূর্ব দিকে তো বাংলাদেশ। অবশেষে জানা গেল তাঁর বাড়ি পাটনা। সেই সময় বাংলাদেশের দহগ্রাম থেকে পাটগ্রাম অভিমুখে একজন ফেরিওয়ালা যাচ্ছিল। সেই জওয়ান আমাকে বাংলাদেশী চকোলেট কিনে দিল। কোম্পানি মনে না থাকলেও মোড়কের রং ছিল আকাশি। সেটাই ছিলো আমার কাছে প্রথম বিদেশী চকোলেট। আর একবার করিডোরের রাস্তা দিয়ে দহগ্রাম ফটোকের কাছে গিয়েছি। তখন বাংলাদেশে বিজিবি নয় বিডিআর ছিল। সেই প্রথম দেখলাম ওপার বাংলাকে সরাসরি। আর একবার তিনবিঘার পর আরও কিছুটা এগিয়ে ছিলাম আমরা। বাবার অবশ্য সেই স্থান পূর্বপরিচিত। কুচলিবাড়ি গ্রাম ও ধাপড়াহাটের ওপরে তাঁর বেশ কিছু রিসার্চের ছবি আমি দেখেছি অ্যালবামে। সেবার কুচলিবাড়ি পর্যন্ত গিয়েছিলাম। কুচলিবাড়ি থানায় সেদিন বিশ্বকর্মা পূজা ছিল। সে উপলক্ষে খিচুড়ি খাওয়া হলো। থানার গোলাপ বাগান ছিল দেখার মতো। লাল, হলুদ, গোলাপি, কমলা হরেকরকম রঙের গোলাপের সমারোহ। আর একবার সদ্য একটা কাঠের সাপ কিনে দিয়েছিল বাবা। ওর নাম রেখেছিলাম গিরিধারী। তিনবিঘা যাওয়া হবে। বাবার তখন নতুন বাইক। পালসার থেকে ওর নাম হয়ে গেলো পুঁটে। আমি, বাবা, মা, গিরিধারী চললাম পুঁটেতে চড়ে। তিনবিঘার আর এক আকর্ষণ-এর কথা বলি। তিনবিঘার মানচিত্র। সাদা অর্ধবৃত্তাকার সিমেন্টের দেওয়ালে আঁকা ছিল তিনবিঘা করিডোর, তিস্তা নদী, কুচলিবাড়ি, দহগ্রাম ও পাটগ্রামের অবস্থান। আমরা ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে তাও চিহ্নিত করা ছিল তাতে। আর ওপরের দিকে ছিল কিছু তিরচিহ্ন। অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশের জটিল হিসাব যা তখন আমার মাথার উপর দিয়ে গেলেও মানচিত্রে অমোঘ আকর্ষণে সেখানে বারবার যেতাম। ছবিও তুলতাম। কেউ কখনও বাঁধা দেয়নি। কিন্তু শেষবার যখন গেলাম তখন দেখি সেই স্থান পুরো হোয়াইটওয়াশ করা। কোন ম্যাপ নেই। হয়তো পরবর্তীতে আবারও আঁকা হবে। তবে এবার সেই ফাঁকা অংশেও ছবি তোলা তো দূরের কথা ঠিক মত দাঁড়াতেও দিল না। যাইহোক আবার ফিরি সেদিনের কথায়। সেদিন আবহাওয়া ভীষণ সুন্দর ছিল। তিনবিঘার প্রেক্ষাপটে বেশ কিছু সুন্দর ছবি তোলা হয়েছিল। অবশ্যই বাংলাদেশ বিদেশ কিন্তু বিদেশ বলতে যে ঝাঁ চকচকে ব্যাপার বোঝায় ঝকমকে শহর বোঝায় তা কিন্তু দেখার কথা নয়। এখানকার বৈশিষ্ট্য গ্রাম্য সৌন্দর্য উপভোগ করা। কিন্তু সেদিন যেন কোন এক মন্ত্রবলে এদেশ, বাংলাদেশ সব বিদেশে রূপান্তরিত হয়েছিল। এমনকি মেখলিগঞ্জ-ধাপড়াহাট পিডব্লিউডি রোডের পিলার গুলোও এত সুন্দর রঙীন হয়েছিল যে তা অসাধারণ লাগছিলো। এরপর আরও একবার বাইকে করে তিনবিঘা গেছিলাম। সঙ্গে করে নিয়ে আসা হয়েছিল একটি জারুল চারা। এখনও মেখলিগঞ্জে লাল বোর্ডিং বাড়ির চাতাল ঘেঁষে সে ছায়া দিয়ে যায়। বসন্তে তার তামাটে পাতা আর গ্রীষ্মে বেগুনি ফুলে সাজে চরাচর। করিডোরের রাস্তাটা সম্পর্কেও কিছু বলি। দুপাশে ঝাউ গাছ ( ) তার গ্যাপে সবুজরঙা ল্যাম্পপোস্টের ওপর সুদৃশ্য সাদা বাতি। করিডোরের পাশে তিনটি সিমেন্টের ছাতা রয়েছে। সেখানেও সময় কাটানো যায়। তবে আমি ছোটবেলায় এতটা ঘুরেছি এ জায়গা যে কখনো যদি তিনবিঘা গিয়ে আর কিছু দেখা নাও হত তাও মন খারাপ হত না। হ্যাঁ এমনটাও একবার হয়েছিল। সেবার অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। আকাশে মেঘ দেখে দুটো ছাতা নেওয়া হয়েছিল। একজন আত্মীয় এসেছিল। বাবা আমাকে গাড়িতেই বসে থাকতে বলল। আমি বসে থাকলাম ক্যাসাবিয়াঙ্কার মতো। তারপর আবার ফিরে এলাম বাড়িতে। এরপর ২০০৭ সালে মেখলিগঞ্জ ছেড়ে জলপাইগুড়ি আসা। বেশ কিছু বছর সেই ছোটবেলার ভ্রমনক্ষেত্র আমার দৃষ্টির আড়ালে। আমার নতুন বন্ধুদের গল্প করতাম। একবার আমার এক বন্ধু সেখানে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলো। সেদিনও আকাশের মুখ ভার। ২০১২ সাল, তখন হিন্দমোটর বন্ধ। কলকাতার রাস্তায় যেমন এখনও হলুদ ট্যাক্সির দেখা মেলে তেমন মেখলিগঞ্জ ট্যাক্সিস্ট্যান্ডেও একমাত্র সাদা অ্যাম্বিটি দাঁড়িয়ে ছিল ঠিক যেন আমাদের অপেক্ষায়। আমার এক দাদা তখন বিএসএফ এ আছে। ছুটিতে মেখলিগঞ্জেই ছিল। সে ও তারও এক বন্ধুও চলল আমাদের সাথে। চারজনে যতই দক্ষিণে এগোই মেঘ ততই কালো হয়ে আসে। অবশেষে তিনবিঘা পৌঁছতেই মুষলধারায় বৃষ্টি শুরু হলো। ছাতা মেলে দৌঁড়ে করিডোর ধরে আশ্রয় নিলাম সেই সিমেন্টের ছাতায়। বৃষ্টিস্নাত তিনবিঘার নতুন রূপ দেখলাম। বিজিবি-বিএসএফের জরুরী মিটিং ছিল। ছিল একটু কড়াকড়ি। তবু সাথে বিএসএফ দাদা থাকলে সবকিছুই একটু সহজ হয়ে যায়। তখন এই কাঁটাতার নতুন হয়েছে। আগে নীচু কাঁটাতার ছিল। কিন্তু কাঁটাতার তো গল্পের হিরো নয়। গল্পের হিরো তো সেই কোরচে বকটা যে সব বাধাকে তুচ্ছ করে এপ্রান্ত থেকে উড়ে যায় ওপ্রান্ত। সেই নীল মাছরাঙা যে এপাড়ের বটের শাখায় বসে থেকে ছোঁ দিয়ে ওপারের নয়ানজুলির জলে মাছ ধরে। সেই কাঠঠোকরা যে বিএসএফের উর্দিতে নয় স্থান করে নেয় সেগুনগাছে। আর ঠক ঠক শব্দে ভাঙে এ কাঁটাতারের বাধা। সেই দু’দেশের কৃষক যারা নো ম্যান্স ল্যান্ডে ফলায় সোনার ফসল মিলেমিশে। সেই বাতাস যাকে আটকে দেওয়ার সাধ্য নেই কাঁটাতারের। সেই সূর্যের ফোটন যা একই সময়ে ব্যবহার করে ওপাশের পারুল এপাশের জারুল। হেমন্তের পাতাঝরা দিনে এপাশের ঝরাপাতা হাওয়ায় ওপারে গিয়ে জমা হয়। সেই বৃষ্টি যে একসাথে দু’ধারে ঝরে পড়ে বাধাহীনভাবে। কাঁটাতার তুমি হেরে গেছো। সবার কাছে তুমি হেরে গেছো। আজ আমার এ লেখা যেমন পড়বে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তেমনই পড়বে বাংলাদেশের মানুষও। ভাষাকে আটকায় কার সাধ্য!
© ✍ সায়ন্তন ধর
তারিখ: ৩০/১০/২০২১