বেলি_ডান্সার -✒️- কাকলি
বেলি_ডান্সার
———————-
কাকলি
বিবেক বিছানায় শুয়ে আছে , সারা শরীরে ব্যথা ওর মা গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে । বাবা , দাদা ভীষণ মেরেছে । বলেছে এ বাড়িতে থাকতে হলে নাচ ছাড়তে হবে । কিন্তু নাচ ওর প্রাণভোমরা , হৃদয় মন জুড়ে আছে ওটা ছাড়া বাঁচা ভাবতেই পারে না । পুষ্পা সেদিন ছেলেকে ছাড়াতে গেছিল কিন্তু পারেনি , ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়েছে । পুষ্পার চোখের জল বিবেকের গালে পড়তেই চমকে ওঠে । শক্ত করে মায়ের হাতটা চেপে ধরে । পুষ্পাও নাচতে ভীষণ ভালোবাসত কিন্তু বিয়ের পর সব বন্ধ করে দিয়েছে । তাই ছোটো ছেলে যখন নাচকে পেশা হিসাবে নিয়েছিল মনে মনে খুব খুশি হয়ে আর্শীবাদ করেছিল ।
বিবেক সকলের থেকে একটু অন্যরকম । ও একজন ‘বেলি ডান্সার’ । এই নাচে মেয়েদের একচ্ছত্রপতি অধিকার , সেখানে একজন পুরুষ হয়ে নিয়ম ভাঙা সহজে সবাই মেনে নিতে পারে না । তার উপর ওরা থাকে শহরতলীর এক বস্তি অঞ্চলে । প্রথম প্রথম ওর নাচ দেখতে সকলে খুব ভালোবাসত মজা পেত কিন্তু যেই প্রচারের আলো বস্তির গলিপথ থেকে রাজপথে ছড়িয়ে পড়ল তখনি আর সহ্য করতে পারল না । আক্রমণ করত নানাভাবে , বাবা দাদাকে উত্যক্ত করতে লাগল কটু কথার মাধ্যমে । আসলে সমাজের ধরা বাঁধা নিয়মের বাইরে গেলেই লড়াইটা তোমার একান্তই নিজস্ব হয়ে পড়ে ।
পুষ্পা বহু যত্নে রাখা একজোড়া কানের দুল আর একটা আংটি বন্ধক দিয়ে কিছু টাকা জোগাড় করেছে । বিবেকের হাতে দিয়ে বললেন ,’ এখান থেকে চলে যা , ভালো করে নাচ শিখে প্রতিষ্ঠিত হয়ে তবেই আসবি । তখন আমি তোর সাথে যাব , তার আগে নয় । বিবেক কোন প্রশ্ন না করে টাকাটা নিয়ে নিল । তারপর ওর সামান্য কিছু জিনিস , জামাকাপড় নিয়ে মাকে প্রণাম করে অজানা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিল ।
চার বছর অতিক্রান্ত । পুষ্পা রোজ মন্দিরে যায় , কিছুক্ষণ বসে চলে আসে । কোনদিন পূজাও দেয় না প্রসাদও গ্রহণ করে না । ঝড় জল বৃষ্টিতেও এই নিয়মের কোন ব্যতিক্রম হয় না । আজ সকাল থেকেই পুষ্পার বিবেকের জন্য মনটা বড় উতলা হয়ে পড়েছে । কাজে মন বসাতে পারছে না । মায়ের মনের এই ব্যাকুলতা অস্থিরতা ঈশ্বর ছাড়া আর কে বুঝতে পারে ! ভাঙা মন নিয়েই কাজকর্ম করছে তবে প্রতিবেশীদের মধ্যে একটা চাঁপা গুঞ্জন লক্ষ্য করছে । আসলে বিবেকের সাথে ওই রকম ব্যবহার হওয়ার পর পুস্পা সকলের সংসর্গ ত্যাগ করেছে । কারোর সঙ্গেই তেমন করে কথা বলে না । একা থাকতেই ভালোবাসে । কেউ সাহস পায় না পুস্পাকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে ।
বিকালে গুঞ্জন আরো বাড়তে লাগল । সন্ধ্যের আগেই বড়ছেলে দীনেশ বাড়ি এল । অন্যদিন অনেক রাতে ফেরে । খেতে খেতে মাকে বলল , ‘ জানো মা , আজ ইন্ডিয়ান আইডল রিয়ালিটি শোতে আমাদের বিবেকের মত একজন বেলি ডান্সার নাচবে । বলিউডের অনেক নামীদামী লোকজন উপস্থিত থাকবে । বিবেকের সাথে আমরা খুব খারাপ ব্যবহার করেছি , কি করব বলো ! সবাই এত বাজে বাজে কথা বলত – রাগের মাথায় খুব অন্যায় করেছি । আমার ভাই আমার সবার আগে বোঝা উচিত ছিল ।’ পুস্পা নাম জিজ্ঞাসা করল দীনেশ পারল না বলতে । তারপর সাতটা নাগাদ মা ছেলে টিভির সামনে বসে পড়ল ।
এক সময় সেই ডান্সার মঞ্চে এল । মাথায় পাগড়ি , মুখের অর্ধেকটা রঙিন কাগজের মুখোশে ঢাকা , ঊর্ধ্বাঙ্গে ছোটো জামা , নিন্মাঙ্গে ঢোলা রঙিন পায়জামা । সনাক্তকরণের কোন উপায় নেই । কিন্তু মায়ের চোখকে ফাঁকি দেবার সাহস স্বয়ং ভগবানেরও নেই , তাই পুস্পার চোখ হীরে চিনতে ভুল করল না । বিবেকের নাভির কাছে একটা তিল ছিল সেটা পুস্পা জানত , আর যেহেতু বিবেক বেলি ডান্সার তাই তাকে নাভির বেশ নিচেই পায়জামাটা পড়তে হয়েছে । ‘এ নাচ আমার মায়ের জন্য তাই মাকে উৎসর্গ করছি ‘ বলে ডান্সার নাচ শুরু করল ।
এত সুন্দর সাবলীল অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সঞ্চালন যে সকলে ভীষণভাবে মুগ্ধ হয়ে গেল । নাচ শেষ হলে দর্শকমন্ডলী তুমুল হাততালি দিয়ে অভিবাদন করল ,বিচারকমন্ডলী উঠে দাঁড়িয়ে সম্মানিত করল । এতদিন যে নাচ কেবলমাত্র নারীদের দখলে ছিল বিবেক প্রমাণ করল শিক্ষা লিঙ্গভেদে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে নাই , ইহা সর্বজনীন এবং মুক্ত হলেই পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটবে । এরপর সকলে তার সঙ্গে পরিচিত হতে চাইল । নাম বলতে ও মুখোশ খুলতে বাধ্য হল । দীনেশ শোনামাত্র চিৎকার করে মাকে জড়িয়ে ধরল । পুস্পার অশ্রুধারা এখন গর্বের আনন্দের । শুনতে পেল বিবেক বলছে ,’ মায়ের আশীর্বাদ আর নিজের ইচ্ছার উপর বিশ্বাস থাকলে পৃথিবীর কোন কাজই অসম্ভব নয়’ । দীনেশ মাকে ধরে বাইরে নিয়ে এল – আশেপাশের সব প্রতিবেশীরা হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে । তাদের নীরবতাই অনেক না বলা কথার প্রকাশ ।
©_খোলা_পাতা
২৯.০৪.২০২২