মাকড়সা 🕷️ কনিকা শর্মা

মাকড়সা
কনিকা শর্মা

একটি মাকড়সা ঘর বাঁধার আশা বুকে বেঁধে কাজ করেই চলেছে। অথচ নিমিষে ছিঁড়ে যেতে পারে তার সুতোর জাল। বার বার অসফল হয়েও আবার ঘর বেঁধেই চলে সে। একধ্যানে তাকিয়ে থাকে সুদীপা।
আজ জীবনের গোধূলিবেলা সুদীপা নিজেকে প্রশ্ন করে – কি পেলি সংসারে খেটে মরে(?) তোর ত্যাগের বিনিময়ে কৃতজ্ঞতা টুকুও জুটলোনা। নিজের বলে যাকে সর্বস্ব দিয়ে বড়ো করলি তার থেকে আজ শুধুই যাতনা পেলি। যার জন্য নিজের গর্ভে অন্য কোনো ভ্রূণ আসতে দেয়নি সেই আজ তাকে অবহেলা করে দূরে ঠেলে দিয়েছে। আসনে সাজিয়ে রাখা গোপাল ঠাকুরের সামনে বসে সুদীপা চোখের জল ফেলে কাতর ভাবে প্রার্থনা করে – আর কতো পরীক্ষা নেবে ঠাকুর!

সুদীপা নিৰ্মলের দ্বিতীয় পত্নী।

নিৰ্মলের প্রথম পত্নী বীনার সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় ডাক্তারের ভুলে মৃত্যু হয়। নির্মল বজ্রপাত পড়া মানুষের মতো দিশেহারা হয়ে যায়। অফিস করে বাচ্চা সামলে উঠতে বড্ড অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। একরত্তি শিশুটিকে তার ঠাকুমা মানুষ করতে গিয়ে হাঁপিয়ে গিয়েছিল। তাই একদিন রাতে নির্মল অফিস থেকে ফেরার পর দেখে তার মা নাতির কান্না কোনোপধ্যেই থামাতে পারছে না। নিৰ্মলের মা তাকে দ্বিতীয় বিয়ের জন্য বলে। নিৰ্মলের মনে তখনো কাকলির ছবিটা সতেজ হয়েই ছিল।
কিন্তু মা যখন বললো – তুই ছাড়াদিন বাইরে থাকিস। আমি বুড়ো মানুষ। কখন কি হয় ঠিক নেই আমার কিছু হলে বাচ্চাটিকে কে দেখবে নির্মল।
বাধ্য হয়ে বিয়েতে মত দেয় নির্মল। তার মাসি সুদীপার খবর এনেছিল। ছোটবেলা মা বাপকে হারিয়ে পিসির কাছে মানুষ হয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর আর পড়াশোনা করেনি। বাড়ির কাজকর্মে নিপুণ সুদীপা দেখতে একটু বেঁটে বলে ছেলের বাড়ির লোক দেখতে এসে ফিরে গিয়ে কোনো জবাব দেয়নি বলে তার পিসি দুঃখ করে প্রতিবেশী নিৰ্মলের পিসিকে বলেছিলেন। সেই থেকেই কথাবার্তা এগোয় নিৰ্মলের সাথে।
…………………..
আয়নায় কালো চুলের মাঝে কয়েকটি সাদা চুল দেখে সুদীপার চোখ ভরে আসে। এখনতো কোনো উপায় নেই সাতাশ বছর আগে ফিরে যাবার। নিজের তলপেটের দিকে একধ্যানে দেখতে থাকে ….আর যে কোনো উপায় নেই তার বদনাম ঘোঁচাবার।
ফুলশয্যার খাটে বসা সুদীপা যে নির্মলকে কথা দিয়েছিল সে কোনদিনও সন্তান ধারণ করবে না। ছোট্ট আকাশকে সুদীপার কোলে তুলে দিয়েছিল নির্মল। নিজের বুকের অমৃত খাওয়াতে না পারলেও বুকের উমে মানুষ করেছিল তাকে। তার মুখে প্রথমবার ‘মা’ডাক শুনে পিসিকে ফোন করে বলেছিল নিজের খুশির কথা। সমস্ত ভালোবাসা উজাড় করে ‘নিজের’ সন্তানকে বড়ো করেছিল সে।

না সুদীপা কোনোদিন নির্মলকে জোর করেনি নিজের গর্ভস্থ সন্তানের জন্য। নিৰ্মলের মনের কোনে একটু স্থান পাওয়ার আশায়, ভালোবাসার কাঙাল সুদীপা ত্যাগ করেছিল তার ইচ্ছা।
নির্মলের ভালোবাসা পেয়েছিল সে। চাকরির অবসরের পর সমস্ত সম্পত্তির নমিনি রূপে তার নাম থাকায় সই নিয়েছিল সাথে দুজনের জইন ফটোও তুলেছিল। তবে টাকা পয়সার প্রতি কোনোকালেই মায়া ছিলনা সুদীপার। মনে মনে ভেবে রেখেছিল সব সম্পত্তি ছেলের নামে লিখে দেবে। কিন্তু নির্মল মানা করেছিল।
বলেছিল – এই সম্পত্তি তোমার আমার মৃত্যুর পর ছেলেইতো পাবে। তাহলে এত তাড়াতাড়ি কেন।
…………………..
নিৰ্মলের মৃত্যুর পর কেমন জানি সব বদলে গেল। দুবছর আগে যখন আকাশের বিয়ে হলো তখন বৌমাকে নিজের মেয়ের মতোই গ্রহণ করেছিল সুদীপা। ছেলে আকাশের মতোই ভালোবেসে বুকে টেনে নিয়েছিল বৌমা পাপড়িকে। কিন্তু নিৰ্মলের মৃত্যুর পর পাপড়ির মা ঘন ঘন আসা যাওয়া শুরু করলো। মেয়ের কানে কুমন্ত্রণা দিয়ে শাশুড়ির সাথে ঝগড়া বাধালো। সম্পত্তি নিজের নামে লিখিয়ে নেওয়ার জন্য নির্মলকে চাপ দেয় সবাই মিলে। নানা অজুহাতে তাকে বাক্যবানে চুরমার করে দিল। তবুও যখন পারেনি শেষে শেষ অস্ত্র নিক্ষেপ করলো। তার অজান্তেই তার হাতের লেখা নকল করে সম্পত্তি নিজের নামে লিখে নেয়।
বৌমা তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে বলে যে শাশুড়ি বাজা বলেই তার মুখ দেখলে পাপড়ির সন্তান হবেনা। এমন অপয়া মানুষ ঘরে থাকলে ওদের অমঙ্গল হবে…
আরও কতো কিছু বলেছিল…
………..…….
স্বামীর পেনশনের ফাইলটা নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল সুদীপা। কাজের খোঁজ করে একটি কাজ জোগাড় করেছে।

আজ সে একটি মেয়েদের হোমের আটেন্ডেন্ট রূপে জইন করেছে। নিজের ছোট্ট রুমের জানালার ধারে বসে সুদীপার মনে প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তির প্রশ্নগুলো আসা যাওয়া করেছে।
বয়স পঞ্চাশ হয়ে গেছে তার। এতগুলো মেয়ের মা হতে পারবে কি সে?? হাজার বঞ্চনার পরেও একটু আশার আলো দেখার জন্য মরিয়া হয়ে আবার যুদ্ধে সামিল হয় সুদীপা।

হয়তো এরই নাম জীবন। প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির মাঝে সুখের মরীচিকা।
★★★★★★★★

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *