# ধারাবাহিক গল্প। # কন‍্যাশ্রী-দ্বিতীয় পর্ব। #কলমে-ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।

# ধারাবাহিক গল্প।
# কন‍্যাশ্রী-দ্বিতীয় পর্ব।
#কলমে-ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।

-“ঠাকুর ভাসান দ‍্যাখতাসো?ঐ দিকে সংসার ভাইসা যায়।কই কি,ঘরের কামে মন লাগেনা?”-মধুমতী তাকায় গৌরের দিকে,সন্ত্রস্ত চোখে।তারপর ঘরের পানে পা বাড়ায়।ঘরই বটে!দরমার দেয়াল,দরমার দরজা,ঘুণধরা বাঁশের খুঁটি।আর নানা জায়গা থেকে সংগ্রহ করা টুকরো টুকরো ডালডার টিন জুড়ে জুড়ে মাথার ওপর চালা।এগারো বছরের মেয়েটাকে যে বাইশ বছরের ছেলেটা সেদিন নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও বাঁচিয়েছিল,কোন সামাজিক বা ন‍্যায়িক বিয়ে না করেও যে এখন তার স্বামী,তার সন্তানদের বাপ,সেই গৌর পালকেও মধুমতী ধর্ষক ছাড়া কিছু ভাবতে পারেনা।

গৌর পাল করিতকর্মা লোক।পেটের দায় বড়ো দায়।ইছামতীর কুলে ঘর বাঁধার পর যখন যেমন কাজ পেয়েছে–কুলিগিরি,জোগালি মিস্ত্রি,চাষের জমিতে জন খাটা,লোকের বাড়িতে চাকরের কাজ–সব করেছে।ছিন্নমূল আরো অনেক মানুষকে নিয়ে গড়ে তুলেছে বসতি।তাদের ঘরের মেয়ে-বৌরা পরের ঘরে ঝি খাটে।দেশে থাকতে যা তারা ভাবতেও পারতোনা।এ দেশে আসার কিছুদিন পরে তারা জানতে পেরেছে স্বাধীন বাংলাদেশের কথা।কেউ ফিরে যেতে পেরেছে,অনেকেই পারেনি।

সংসার করলেই সংসার বাড়ে।গৌর পালের- “নয়খান কইন‍্যা।দুইডা মরসে আঁতুরে,রইল বাকি সাইতখান। অনু,বনু রুনু,ঝুনু টুনু,থাকো আর ক্ষান্ত।”গৌর পাল এখন ভ‍্যানরিক্সা–বাংলা দেশে কয়–‘বিমান’-চালিয়ে -“প‍্যাটের জুগান”-দেয়।সাত মেয়ের বাপের -“কুনো চিন্তা নাই।”-।আররে,কে বলে,তনয়া পরের ধন? মেয়েরা তার কন‍্যাশ্রী।তাদের চৌদ্দ বছর বয়স হলেই তারা হারিয়ে যায় এবং লিকুইড মানি হয়ে ফিরে এসে বাপের হাঁড়িতে ঢুকে ব‍্যাবাক হজম হয়ে যায়।

প্রথম প্রথম ডুকরে উঠতো মধুমতী–“কী সব্বনাইশা খ‍্যালায় মাতসো তুমি?নিজির কইলজা মাইয়াদের কুন্ রাজাকারের হাতে তুইল‍্যা দিতাসো একখান একখান কইরা!কসাই হইয়া গেসো?আগে তো এমন আছিলা না!আমারে বাঁচাইয়াছিলা ক‍্য‍ান্?এইভাবে যন্তন্না দিয়া মারনের লেইগ‍্যা?এতো নিষ্ঠুর হইয়া গ‍্যাসো?”-গৌর বলে-“চুপ যা।ঘেঁটি ভাইঙ্গা দিমু চ‍্যাঁচাইলে,মুক বন্দ রাখ কইতাসি। শুন ভালো কইরা,তুই তো জানস বড়ো জামাই যাত্রাপালার নায়ক।নিজে যাইচা অনু মারে নিসে।অহন বনুডারে লইতে চায় মদন মুদির ভায়রাভাই।বনগাঁ বডারে থাহে।ছেলে বডার ছিকুরিটিতে কাম করে।এমন জামাই পাবা,মনে ধরে না তর?”-মধুমতী বলে-“তয় যে হুনতাসি মদন মুদি আড়কাঠি?ভুলাইয়া টাকা দিয়া মাইয়া লইয়া যায়।তাপ্পর চালান দেয়।পাচার করে।ওরা হগ্গলডি রাজাকার।মিছা কতায় ভুলাও আমারে,টাকা লও নাই তুমি?”-ফুঁসে ওঠে মধুমতী-“মনে লয় ঐ হাত দুইখান মুচড়াইয়া ভাইঙ্গা দি।”-ফুলে ফুলে কাঁদে মধুমতী।গৌর পাল বোঝায়-“আরে না না,অগো নিয়মে বরপণ লয় না,কইন‍্যাপণ দেয়।তুই অমত করস না।আর এহানে রাজাকার আইবো কই থনে।নিজে দুককু পাইছো তো।হের লেইগ‍্যা মিছা সন্দ করো।এ বিয়ায় বনুর ভালোই হইবো।বিশ্বেস যা।”-অতএব লোক দেখানো বিয়ে হয়, আর জন্মের মতো বাপের ভিটা ছাড়ে বনু। একই ভাবে যায় রুনু,ঝুনু,টুনু। অসহায় মধুমতী বলে গৌরকে-“তুমিও রাজাকার।”-

গৌর পাল পোড় খাওয়া মানুষ। সেই সত্তরের দশকে এ পার বাংলায় আসার পর দেখেছে নকশাল ও বামপন্থী আন্দোলন।তখনই বুঝে নিয়েছে হাওয়া কোনদিকে এখন বইছে,কোনদিকে পরে বইবে।ভাগ‍্য নয়,ঈশ্বরের আশীর্বাদ নয়,মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে একমাত্র রাজনীতি।প্রথম দিকে তাই সে মিছিলে অংশ নিত।গৌর অস্বীকার করেনা,ঐমিছিল তার রুধিরবর্ণ যেন আরো ঊজ্জ্বল করে তুলত।–“মার্কসবাদ লেনিনবাদ,সর্বহারার মতবাদ।”-প্রথমদিকে বুঁদ হয়েছিল গৌর।তার পর তার নিজস্ব দর্শন মাথা চাড়া দিল-” আপনি বাঁচলে বাপের নাম।”-মিছিলে গৌর বিড়বিড় করতো-“মাছভাত,মাছভাত,সর্বহারার মতবাদ।”-কতদিন মাছভাতের মুখ দেখেনা তারা।আদর্শের ক‍্যাঁতায় আগুন। এখন আবার যদি অন‍্য কোন বাদের বাদীরা মাংসভাত খাওয়ায়,হাতে দুশো পাঁচশো টাকা গুঁজে দেয়,গৌর তাদের হয়েই গলা ফাটাবে।মিছিলের সবাই গৌর নয়,গৌরও সবার মতো নয়। অতএব যে মানবিকতায় মধুমতীকে একদিন বাঁচিয়েছিল সে,ভাসিয়ে তো দেয়নি ইছামতীর চোরা নাওয়ে,সেই মানবিকতাকেই গলা টিপে মেরে ফেলে গৌর।পাচারের কাজে যুক্ত হয়ে হাতেখড়ি হয় নিজের মেয়েদের দিয়েই।অপরাধ প্রবণতার একটা অমোঘ আকর্ষণে তলিয়ে যায় গৌর পাল।
( ক্রমশঃ)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *