হারিয়ে যাওয়া এক রূপকথার দেশ ও এক পরী মায়ের কথা © সায়ন্তন ধর
হারিয়ে যাওয়া এক রূপকথার দেশ ও এক পরী মায়ের কথা
© সায়ন্তন ধর
একটি রূপকথার দেশ ছিল। অন্তত নাম শুনে আমার তেমনটাই মনে হত। এই দেশের মাটিতে বিচ্ছিন্ন ভাবে মাথা তুলেছে পাহাড়ের দল। এর উর্বর ভূমিকে পাথুরে, সংকীর্ণ অ্যাড্রিয়াটিক উপকূল থেকে আগলে রেখেছে এই পাহাড়গুলি। তিনটি পার্বত্যভূমিতে অধিকার করেছে ষাট শতাংশ ভূমি। ইটালিয়ান ও অষ্ট্রিয়ান আল্পসের সম্প্রসারিত অংশ জুলিয়ান আল্পস নামে সমাদৃত। নাটকীয়তায় ভরা দিনারিক আল্পস বিস্তৃত হয়েছে অ্যাড্রিয়াটিক সাগর বরাবর। অবশেষে দানিয়ুব নদীর লৌহ দরজা পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছে কার্পেথিয়ান-বলকান পর্বত। দিনারিক আল্পসের চুনাপাথরীয় ভাষ্কর্য বা অন্ধকার গুহার ছাদ ও মেঝেতে স্ট্যালাগটাইট-স্ট্যালাগমাইটের কারুকাজ। কোথাও নদীদের অন্তঃসলিলা হয়ে যাওয়া আবার কোথাও আকাশের আয়না হ্রদের অবস্থান যা কিনা সাগরতলের চেয়েও গভীর। কোথাও বা ক্ষয়ের ফলে সৃষ্টি হয়েছে স্ফটিক পাথর। সেই স্ফটিকে গড়া রাজপ্রাসাদে কি কোন রাজকন্যা বন্দী আজও? পাহাড় থেকে ঝাপিয়ে পড়ে নদীরা যে পললব্যজনী সৃষ্টি করেছে, তা দিয়ে কি সমুদ্রের নোনা বাতাস সিক্ত রাখে এ ভূমিভাগ ? নাকি কোথাও কোথাও উত্তপ্ত ধরনীকেন্দ্রের গলিত লাভা বেরিয়ে এসে অশান্ত কোরে তোলে এ রূপকথার দেশকে ? আর থরথরিয়ে কেঁপে ওঠে সমুদ্রে আধ ভাসমান উপদ্বীপটি ? আভ্যন্তরীণ উৎকর্ষ ও চারটি প্যাসেজের মাধ্যমে অ্যাড্রিয়াটিকে মুক্তি এই তো ছিল বৈচিত্র্যে ভরা এক রূপকথার দেশ। আমার নিজের দেশের সাথে মিল যে ছিল অনেক। বিদেশী আক্রমণ হয়েছে। পদানত হলেও শেষ পর্যন্ত হেসেছে জয়ের হাসি। একত্রিত হয়ে গড়েছে ফেডারেশন। জোট নিরপেক্ষ নীতিতে এগিয়ে চলেছিল ভালোই। কিন্তু তারপরের ঘটনায় মিল চাই না আর। আমি জ্ঞান হওয়ার পরপরই হারিয়ে ফেলেছি সেই রূপকথার দেশটিকে। সেই দেশটির নাম শুধু ইতিহাসের পাতায়। সেই রূপকথার দেশ থেকে এক পরী এসেছিলেন আমার পরাধীন দেশে, আমার রাজ্যের শহরে, মৃত্যপথযাত্রীদের সঞ্জীবনীসুধার স্পর্শে বাঁচিয়ে তুলতে। তারপর এদেশেই থেকে গেছেন আজীবন। আজ তাঁর জন্মদিন। তাঁর যখন জন্ম হয় তখন সেই রূপকথার দেশ অটোমান সাম্রাজ্যের অধীন। স্কোপজে শহর তখন কসোভো ভিলায়েতের অংশ। আমরা পড়েছি যুগোস্লাভিয়ার স্কোপজে শহর। কিন্তু এখন তা উত্তর ম্যাসিডনিয়ার রাজধানী। এখানে একটু নাম বিভ্রাট হতে পারে। একটু বিস্তারিত বলা প্রয়োজন। ম্যাসিডোনিয়া নামে আমাদের মনে পড়ে দিগ্বিজয়ী বীর আলেকজান্ডার দি গ্রেট এর কথা। হ্যাঁ, এ সেই ম্যাসিডোনিয়া যা এথেন্স ও স্পার্টার পর গ্রীসের অন্যতম শক্তিতে পরিণত হয়। তবে সে ম্যাসিডোনিয়ার দক্ষিণ অংশ এখন গ্রীসের অঙ্গরাজ্য হলেও এর উত্তর অংশ ছিল যুগোস্লাভিয়ার। আর বর্তমানে একটি স্বাধীন দেশ। ছোটবেলায় ম্যাপ নিয়ে বসলে ইউরোপের এই অংশটি বুঝতে আমার খুব অসুবিধা হত। আসলে তখনও দেশভাগের কাজ চলছে। রূপকথার দেশটিতে তখন শুধুই উদ্বাস্তুদের ঢেউ। পরবর্তীতে জন্ম নিল সাতটি স্বাধীন দেশ। হারিয়ে গেল রূপকথার দেশ। স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, মন্টেনিগ্রো, সার্বিয়া, কসোভো ও উত্তর ম্যাসিডনিয়া। মার্শাল টিটোর গড়ে তোলা সম্প্রীতির বাহুডোর কেটে বেরিয়ে এলো সবাই। ভৌগোলিক মানচিত্র থেকেই মুছে গেলো সুন্দর সে নাম যুগোস্লাভিয়া। কেউ মনে রাখুক বা না রাখুক, আমি যুগান্তরেও মনে রেখেছি তাকে। আবার আসি সেই পরীর কথায়। আমি যখন তাঁর কথা পড়ছি রচনা বইতে, তখন তিনি মহাসিন্ধুপারে। আমার আফসোস আমার জন্মের পরেও তিনি বেঁচে ছিলেন। কিন্তু চাক্ষুষ দেখা হলো না তাঁর সাথে। আমার জন্মদাত্রী মা, দেশ মাতৃকার পর তিনিই ছিলেন মাদার যাঁকে না দেখতে পাওয়ায় আমি নিজেকে বঞ্চিত মনে করি। আজ সেই না দেখা মাদার টেরেজার (Anjezë Gonxhe Bojaxhiu) জন্মদিনে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করলাম তাঁকে আর সেই পরী মায়ের রূপকথার দেশটিকে।
© সায়ন্তন ধর
২৬/০৮/২০২১