*ছোটগল্প : ফার্স্ট এপ্রিল ২০২০* *নীহার কান্তি মন্ডল*
*ছোটগল্প : ফার্স্ট এপ্রিল ২০২০*
*নীহার কান্তি মন্ডল*
রামকিঙ্করের ‘মন’ বলছিল সুভাষিণী তার ফোনটা আজ রিসিভ করবে।
না না, ‘মন’ দেয়া নেয়ার কোনো গল্প নেই। সে সব পালা তো চুকে গেছে কবেই। সেই সব দিনের মধুর স্মৃতিও চাপা পড়ে গেছে দৈনন্দিন জীবনের হাজার হাজার সদ্য স্মৃতির পাহাড় প্রমাণ চাপে।
সুভাষিণীদেবীর মেমারি কার্ডে যা কিছু ভালো স্মৃতি ছিল অটো-ডিলিশানে বিলুপ্ত আজ।
শুধু খারাপ স্মৃতিগুলোই তার মনের মধ্যে ভাইরাসের মতো পরজীবি হয়ে বংশ বিস্তার করে তাকে কুরে কুরে খেয়ে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
সাপ্তাহিক ছুটিতে ছুটতে ছুটতে গভীর রাতে বাড়ি ফিরেছিলেন রামকিঙ্কর। একটা প্রাইভেট সংস্থার ফুলটাইম কেরানি তিনি। বছর দুয়েক বাকি আছে রিটায়ারমেন্টের।
পরদিন সকালে তার হাঁচি ও সর্দির সাথে প্রচন্ড গলাব্যথা। এমনকি জল গিলতেও ব্যথা করছিল। অগত্যা ডাক্তারের কাছে ছুটতেই হোলো।
ডাক্তারবাবু দূর থেকে টর্চের আলো গলায় ফেলে বললেন — “ভাইরাল ইনফেকশান । কটা দিন ওষুধ খেতে হবে , সাথে দিনে তিন চার বার গার্গেল করতে হবে।”
সুভাষিণীদেবী সুশিক্ষিতা আধুনিকা নারী। অত্যাধুনিক গণমাধ্যমের দৌলতে “করোনা” নিয়ে তার জমানো তথ্য ও জ্ঞান নতুন ডিপ্লোমা পাওয়ার অপেক্ষায়। রামকিঙ্করকে ফুট পাঁচেক দূরত্বে থেকে এমন দৃষ্টিপাত করছেন যেন রামকিঙ্করই একটা মস্ত বড়ো করোনা ভাইরাস। সাথে চলছে মুহূর্মুহূ করোনা-বিধ্বংসী বাক্যবাণ বর্ষণ।
ভাগ্যিস পরদিন অফিস খোলা। তাই কালবিলম্ব না করেই ডাক্তারের দেয়া ওষুধ আর সুভাষিণীর দেয়া ভার্বাল অ্যান্টিডোট সঙ্গী করে সাত সকালে অভুক্ত পেটেই বেরিয়ে পড়েছিলেন ভিন্ রাজ্যের কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে।
সুভাষিণী মাঝে মধ্যে ফোন করে রামকিঙ্করের শারীরিক অবস্থার খবর নিচ্ছিলেন, আর হাঁচি, কাশি, গা ব্যথা বা বমি ইত্যাদি উপসর্গ বিশ্লেষণ ক’রে করোনাক্রান্তের লক্ষণের সঙ্গে ম্যাচ করাচ্ছিলেন তার নিজস্ব জ্ঞানভান্ডারের ল্যাবরেটরিতে।
ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকার একযোগে লকডাউনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। রামকিঙ্কর সুভাষিণীকে ফোনে জানালেন — “এক সপ্তাহের লক ডাউন ঘোষিত হয়েছে, হয়তো আরও বাড়বে। তাই মাঝ রাত্তিরের ডাউন রাঁচি-শিয়ালদহ এক্সপ্রেসে বাড়িতে ফিরছি। শরীরটাও খুব একটা ভালো যাচ্ছে না আমার —”
কথা শেষ করার আগেই সুমধুর কন্ঠে বললেন সুভাষিণীদেবী — “একদম না। ওখানে থেকেই চিকিৎসা করাও।
আর যদি আসতেই হয় — আগে বেলেঘাটা আই ডি হসপিটালে গিয়ে করোনামুক্ত সার্টিফিকেট নিয়ে আসবে, তবেই বাড়ির দরজা খোলা হবে।”
সেদিনের পর থেকে রামকিঙ্করের সাথে আরও যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছেন সুভাষিণী। একদিন রামকিঙ্কর জানিয়েছিলেন— ‘নতুন কোনো উপসর্গ নেই।’
শুনে সুভাষিণী কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন।
হয়তো ভাবছিলেন — বুড়োটা বাড়িতে থাকলে ঘর মোছা, বাসন ধোয়া বা রান্না করানো –কিছু একটা তো করানো যেত। করোনার আগমন বার্তার সাথে সাথেই কাজের মহিলাকে সবেতন ছুটি দিয়ে দিয়েছেন তিনি।
তারপর থেকেই রামকিঙ্করের সব ফোন রিসিভ করেন না। করলেও দু’একটা কথা বলেই লাইন কেটে দেন। আর গত দু’দিনে তো বার বার ফোন করলেও রেসপন্স করেন নি সুভাষিণীদেবী।
যে কথা বলছিলাম — রামকিঙ্কর ভাবছিলেন — আজ পয়লা এপ্রিল। অনেকের কাছে ‘এপ্রিল ফুল’ হলেও সুভাষিণী ফুল এপ্রিল মাসের খরচ খরচা পাঠানোর খবরটা জানার জন্য হলেও ফোনটা আজ ধরবেই।