ছোটগল্প বিহু সোমা রায়
ছোটগল্প
বিহু
সোমা রায়
নদীর ধারে বসে থাকতে থাকতে মাথায় একটা চমৎকার ভাবনা এল। বাড়ি থেকে চটপট বেরিয়ে নদীর ধারে এসে বসল। বর্ষানদীর ভরপুর কলকলানির সঙ্গে চারপাশের শ্যামলিমা আশ্চর্য মেদুর। ঢাকের আওয়াজ আর পুজোর আমেজ মিলে তীর্থ আবার পুরনো দিনগুলোকে যেন কাছে পেতে চাইছে। শহরের পুজোর সঙ্গে গ্রামের পুজোর কোথায় একটা পার্থক্য আছে। হ্যাঁ, একটা নিষ্ঠা ও পবিত্রতা। লোক দেখানো ব্যাপারটা এখানে নেই। কেমন নিবেদিত প্রাণ!! যদিও সব গ্রামই প্রায় মফস্বলের চেহারা নিয়েছে। দোকানপাট অফিস ব্যাঙ্ক ইন্টারনেটের দুনিয়ায় সবাই স্ব স্ব মহিমায় ভাস্বর। তবুও নিজের জন্মস্থানকে এখনও তীর্থর গ্রাম বলে ভাবতেই ভালো লাগে।
মোবাইল তুলে নিল হাতে। খুব ইচ্ছে করছে গলাটা শুনতে।
“বল”
“ব্যস্ত!”
“এটা জিগ্যেস করার জন্য ফোন করলি!”
“তোকে খুব মনে পড়ছে। ”
“এখনও!”
“এখনো ”
“বল ”
“আসবি?”
“কোথায়?”
“আন্দাজ কর!”
“নদীর ধারে!”
“হ্যাটস অফ ”
“আসছি। ”
“থ্যাঙ্কস ”
“কীসের থ্যাঙ্কস?”
“নারে, তুই এলে ভালো লাগবে। ”
“এতদিন পরও!”
“একদম। ”
“আসছি। ”
মোবাইল রেখে মন ভেসে চায় অতীতে। কলহাস্য, সাইকেলের ঘন্টি, রবীন্দ্রজয়ন্তীর মহড়া, নদীর ধারে আড্ডা, চারপাশের শ্যামলিমা আর একটি অতি সাধারণ মেয়ের অসাধারণ চোখ দুটি।
সিগারেটের ধোঁয়ায় ভাসমান মনকে বাঁধতে চায় তীর্থ। পারে না। নক্ষত্রগতিতে মন ভেসে চলে অতীতে।
“বল ভালবাসিস আমায়। ”
“বলব না। কী করবি!”
“বলবি না!” হাত মুচড়ে ধরে তীর্থ।
ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসে মেয়েটি। তারপর এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে বলে, “কেন!আমি তোদের বাড়ির পরিচারিকার মেয়ে বলে! কিন্তু এটাও জেনে রাখিস, আমি ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল। ”
“খুব অহংকার, তাই না!”
“অহংকার কিনা জানিনা। তবে আমি কিছু একটা হতে চাই। শুধু প্রেম আর সংসার করার জন্য আমার জন্ম হয়নি। আমি কিছু হয়ে দেখাতে চাই। ”
“হ না! কে বারণ করেছে! কিন্তু আমাকে ভালবাসিস কিনা আগে বল। ”
“তুই বাড়িতে বলতে পারবি!”
মাথা নীচু করে থাকে তীর্থ।
খিলখিলিয়ে হাসে মেয়েটি, “স্বীকার করতেই ভয় পাস আবার প্রেম! শোন, আমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে ওসব ভাবব। ”
“এত অহংকার!”
“অহংকার নয়, আত্মবিশ্বাস। ”
নদীর হাওয়ার ঝাপটায় অতীত থেকে ফেরে তীর্থ। হাওয়ায় সোঁদা সোঁদা গন্ধ।
“কতক্ষণ!”
চমকে ওঠে তীর্থ। অবাক হয়ে তাকায় সেই অতি সাধারণ মেয়ের অসাধারণ চোখ দুটির দিকে। আজ সে জ্ঞানে গরিমায় স্বাধীনতায় অনন্য। কলেজের লেকচারার, এক কন্যার জননী।
“বিহু!”
“এক কথায় তোর ডাকে কেন এলাম জানিস!!”
” জানি তো! ইচ্ছে হয়েছে তাই!”
“না রে। আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি। বিদেশে একটা কলেজে চান্স পেয়েছি। ”
তীর্থ অবাক হয়ে বলল, “আর তোর বর, সংসার!”
“সমস্যা তো ওখানেই। আসলে কী জানিস তো, পরিচারিকার মেয়ে, এই তকমাটা আজও আমার গা থেকে মুছল না। ”
“বুঝলাম না। আমি পরে বাড়িতে সব জানিয়েছিলাম কিন্তু ওরা মেনে নেয়নি। আমিও পারি নি কিন্তু অঞ্জন তো পেরেছিল! তাহলে আজ কেন এমন বলছিস!”
নদীর দিকে তাকিয়ে আপন মনে বলল বিহু, “যতদিন বাবা বেঁচেছিল ততদিন বারবার বলা সত্তেও ওরা এই গ্রাম ছেড়ে যেতে চায়নি। আমি জোর করেও রাজি করাতে পারিনি। আমি এসেছি, থেকেছি, ওদের সব ভার নিয়েছি। অঞ্জন দু একবার এসেছে। ”
“তাহলে!”
হাসল বিহু। সেই হাসি। বলল, “তোরা এক জায়গায় সবাই সমান। সেই পরিচারিকার মেয়ে! বাবা মারা যাওয়ার পর যেই আমি মাকে আমার কাছে নিয়ে আসতে চাইলাম অমনি অঞ্জনের মুখোশ খুলে পড়ল। কিছুতেই মানতে পারল না। ”
তীর্থ আবছা গলায় বলল, “আর মেয়ে!!”
মুচকি হাসল বিহু, “ভাগ্যিস মেয়েকে আমার মতো করে মানুষ করেছিলাম! কোনদিনও আরামে বিলাসে জীবন কাটাতে দিইনি! দিদুনকে খুব ভালবাসে। এখানেই জিতে গেছি রে!”
তীর্থর চোখে একরাশ জিজ্ঞাসা দেখে বিহু আবারও হাসল, “ডিভোর্সটা হয়ে গেছে রে। পুজো কাটিয়ে চলে যাবো বিদেশে। অবশ্যই মা ও মেয়েকে নিয়ে। ”
উদাস গলায় তীর্থ বলল, “আমাকে তোর মনে থাকবে বিহু!”
“থাকবে। কারণ আমি কাওয়ার্ডদের কখনো ভুলি না। ”
“তাদের জন্যই কী চলে যাচ্ছিস?”
একটু চুপ করে বিহু উত্তর দিল, “দেখি, বিদেশের মানুষের কাছেও হয়তো এখনও কিছু প্রমাণ করার আছে!কে বলতে পারে, ওখানে এর বিপরীতটাও হতে পারে!”
উঠে পড়ল বিহু। চটি পরে বলল, “তোর মা, মানে মাসিমার কাছে আমি একটা ব্যাপারে ঋনী।”
তীর্থ অবাক হয়ে তাকাল।
বিহু কেটে কেটে বলল, “আমার নামটা তার দেওয়া। নামটাকে আমি খুব ভালবাসি। আসি রে। ”
চলে গেল বিহু। পশ্চিমাকাশে এক আশ্চর্য রঙের আভা। যে আভা মেখে এইমাত্র চলে যাচ্ছে বিহু। ওর দেখা একজন অসাধারণ মানুষ যাকে আজ পর্যন্ত কেউ জানতে চাইল না। নদীর দিকে তাকিয়ে দেখল সে অবিরাম সেই একই গতিতে বয়ে চলেছে।