ধারাবাহিক গল্প। কন‍্যাশ্রী। ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।

ধারাবাহিক গল্প।
কন‍্যাশ্রী।
ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।

-“ইছামতী,মাগো,মা আমার,কত্তো পিরতিমে ভাসান যায় মা তোর জলে,কত্তো জীয়ন্ত পিরতিমেও চোরা নাওয়ে ভাইসা যায় মা,কে রাখে তার খুঁজ?”-প্রতি বছর দুই বাংলার দুর্গা প্রতিমার বিসর্জন উপলক্ষে মিলন-উৎসবে পরিণত হয় ইছামতীর দুই কুল।মধুমতী সেই ভীড়ের মধ‍্যে দাঁড়িয়ে দুফোঁটা চোখের জল মিশিয়ে দিতে চায় ইছামতীর জলে।তার চোখের ডাগর দৃষ্টি ‘উড়াল দিয়া’ছুঁতে চায় ঐ–ই ওপারের জন্মমাটিকে।
কতো বছর হয়ে গেল,যেন কতো যুগ!ঢাকের বাদ‍্যি ছাপিয়ে তার কান ফেটে যেতে থাকে খানসেনাদের তুমুল তাণ্ডব বাদ‍্যিতে।প্রতিমা ভাসান উপলক্ষে জ্বলছে রংমশাল,তুবড়ি,রংবেরংএর আতশবাজি আর ফানুশে সেজে উঠছে রাতের অন্ধকার আকাশ।মধুমতীর চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার বাপের ভিটায় জ্বলে ওঠা লকলকে লেলিহান আগুনের আকাশছোঁয়া স্পর্ধার দৃশ‍্য।বাপ যে ছিল মুক্তিযোদ্ধা।বাংলাদেশে (তখন পূর্ব পাকিস্তান) সে সময়ে চলছে ভাষা আন্দোলন।হিন্দিই ভালো করে বলতে পারেনা বাংলাদেশের মানুষ,তাদের জাতীয় ভাষা হবে কিনা ঊর্দু?বাঙালি তখন হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদ ভুলে এক হয়ে গেছে।তারা শুধুই বাঙালি।রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্তের উত্তরসুরী। এতো ঔদ্ধ‍ত‍্য সহ‍্য করেনি পাকিস্তান সরকার ও তাদের ধামাধরা রাজাকার বাহিনী।মধুমতীর বাপকে তাই শহীদ হতে হয়।মা, ভাই,বোন সকলেই তখন লাঠির আঘাত আর তরো য়ালের খোঁচায় রক্তমাখা মাংসপিণ্ড হয়ে ছড়িয়ে পড়ে থাকে উঠোনে,দালানে।শুধু এগারো বছরের মধুমতীর ফ্রক যেন জ‍্যান্ত পাঁঠার ছাল ছাড়ানোর মতো কাড়াকাড়ি করে ছেঁড়ে কতকগুলি নরপশু।স্বাস্থ‍্যবান খানসেনা,আর রাজাকাররা ঝাঁপিয়ে পড়ে ছোট্ট নগ্ন শরীরটার ওপর। এগারো বছরের মধুমতীর তখনই প্রথম রজোদর্শন ঘটে যায়।-‘রেপ’- শব্দটার সঙ্গে আজকাল আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার পরিচয় হয়ে গেছে।কিন্তু যার সঙ্গে এটা ঘটে সেই শুধু জানে এর ভয়াবহতা।মধুমতী জানে।মেয়েমানুষের জান নাকি কৈ মাছের জান!হ‍্যাঁ তাই-ই।মধুমতী তার প্রমাণ।সেদিন তার অচেতন দেহটা তুলে নিয়ে গিয়েছিল তাদেরই গ্রামের ছেলে গৌর পাল।বাঁশবনে ঘেরা গ্রাম‍্য জঙ্গলের মধ‍্যে লুকিয়ে বসেছিল মধ‍্যরাত পর্যন্ত।জ্ঞান হতে মধুমতী দেখেছিল একখানা গামছা দিয়ে তার শরীরটা ঢেকে আগলে বসে আছে নিতাই কুমোরের পোলা গৌর পাল।দুঃসহ যন্ত্রণায় ককিয়ে ওঠে মধুমতী,–“কই লইয়া আইছ মোরে?বাবা-মায়ে কই?ভাইবুইনরা?আমি বাসায় যামু। ও মাগো,তুমার কাসে যামু মা।আমারে মায়ের কাসে লইয়া চলো গৌরদা।”–শক্ত হাতে তার মুখ চেপে ধরে গৌর।-“চুপ যা,শয়তান রাজাকারগুলি আশেপাশেই ঘুরে ফিরে।পলাইতে অইবো।তগো ঘরবাসা আর নাই,আমাগোও নাই।সব ছাই অইয়া গেসে গিয়া।তরও কেও নাই আম্মোরও না।”–মধুমতীর রক্তমাখা শরীরটা জড়িয়ে নিয়ে সীমান্তের খোঁজে এগিয়ে চলে গৌর।কত গাঙ্-নালা পেড়িয়ে যায় তারা অসংখ‍্য ছিন্নমূল মানুষের ভীড়ে মিশে গিয়ে।সাতদিন পরে আত্মীয়-স্বজন,সম্পন্ন ঐশ্বর্য সব ফেলে, বহু শবদেহ মাড়িয়ে,পুটখালির ইছামতী পেরিয়ে,আংড়াইল সীমান্ত অতিক্রম করে ঢুকে পড়ে “ইণ্ডিয়া”য়।পেছনে পড়ে থাকে চোদ্দ পুরূষের ভিটে খুলনার নড়াইল,মধুমতীর মামার বাড়ী যশোরের আলতাপোল ও কেশবপুর গ্রাম।খানসেনা আর রাজাকারদের হাত থেকে বাঁচতে অনেকে আবার বনগাঁর পেট্রাপোল সীমান্ত লাগোয়া জয়ন্তপুরের কাঁটাতারের বেড়া টপকে ইণ্ডিয়ায় ঢুকে পড়ে।টাকি,বসিরহাটের কলোনিগুলি ভরে ওঠে।
( ক্রমশঃ)

1 thought on “ধারাবাহিক গল্প। কন‍্যাশ্রী। ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।

  1. শুরু টা অতি পরিচিত… কিন্তু পড়ে দেখার কৌতুহল কমবে না। ভালো লাগলো। আগ্রহে অপেক্ষা করছি…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *