#গল্প #দুই_অধ্যায় #সোনালী_মুখার্জী

#গল্প

#দুই_অধ্যায়
#সোনালী_মুখার্জী

শপিংমলের ভেতরটায় বড্ড ভিড়, তাই সরে এসে একটু ফাঁকায় দাঁড়ালো তনিমা। ওদিক টাতে নিজের পছন্দের শার্ট বাছতে ব্যস্ত অনিক । আজ দুজনে অনেকদিন পরে একসাথে এসেছে এই মলে, বয়স ও বাড়ছে আর শরীরে র ও আর তেমন জোর কোথায়? দেখতে দেখতে সাতচল্লিশ বছর পার হয়ে গেল, অনিক ও পঞ্চাশ পেরিয়েছে।
এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে হঠাৎ চোখটা আটকে গেল একজনের দিকে, আরে বীথি না ওটা? মুখ দেখে তো তাই মনে হচ্ছে,
কিন্তু ….এতদিন বাদে… এই বেশে? বীথি হবে?? বুঝতে তো পারছি না ছাই …দরকার নেই ,যাকগে নিজের মনের দোটানার মধ্যেই মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল তনিমা।
আরে ?এই? চমকে ঘুরে তাকায় তনিমা… সামনে ই বীথি দাঁড়িয়ে। হ্যাঁ ..মানে.. হ্যাঁ ,বীথি তুই ?কেমন আছিস?

বীথি…. আমি কিন্তু তোকে দেখেই চিনতে পেরেছি ।বল কি করছিস এখন?

তনিমা .. কি আর এই তো সংসার সংসার খেলা ,একটাই মেয়ে বিয়ে হয়ে গেছে এখন আমরা দুই বুড়োবুড়ি ওই যাহোক করে চলে যাচ্ছে। এবার তোর কথা বল।

ভালো করে তাকায় তনিমা বীথির দিকে। এই কি সেই মেয়েটা? সেই ভীতু জড়সড় হয়ে গায়ে চাপা দিয়ে কলেজে আসা বিথী? সবাই যাকে দেখে হাসাহাসি করত?ঠাকুমা বলে রাগাতো? এখন একটা গাঢ় সবুজ ডিজাইনিং ব্লাউজের সাথে হালকা পিংক সবুজের কাজ করা শাড়ি, পিঠের ট্যাটু টাও খুব সুন্দর, সাথে কানের গলার মেলানো সেট ,হাতে একটাই বালা, চোখে টানা কাজল ,সুন্দর করে লাগানো লিপস্টিক কি সুন্দর ঝকঝকে লাগছে ওকে। বয়সটা যেন এক ধাক্কায় দশ বছর পিছিয়ে গেছে। তার জায়গায় নিজে একটা হালকা বুটি দেওয়া শাড়ি , নিজেই লজ্জা পায় নিজের কাছে। বলে হ্যারে বীথি পড়তে পড়তে হঠাৎ করে কলেজটাই ছেড়ে দিলি আর তো কলেজেও এলি না,পরীক্ষাও দিলি না তারপর থেকে আর তো কোন খবরই পেলাম না তোর।

বিথী…. আরে এসব কথা কি এখানে দাঁড়িয়ে হবে নাকি? চল . . ওই কফি সপ টায় বসি।

তনিমা … দাঁড়া আমার বরটাকে ডাকি, ও এসেছে।

বিথী …তাই? আগে বলবি তো? তনিমা ফোন করে, খানিক বাদেই চলে আসে অনিক।বিথী অনিক কে দেখেই চমকে ওঠে। এ কাকে দেখছে সে ? এ তো অনিক? অনিক ও ততটাই চমকে যায়, ওরা কখনো ভাবেনি জীবন আর ভাগ্য এভাবে তাদের এই রকম জায়গায় এনে দাঁড় করিয়ে দেবে আবার।

তনিমা এসব অত লক্ষ্যই করে না। ও পরিচয় করিয়ে দেয় বিথী …আমার হাজবেন্ড অনিক..আর অনিক এ আমার কলেজের বন্ধু বিথী । চলো সবাই ওই কফিশপ টা তে গিয়ে বসি বলে তনিমা এগিয়ে যায়।সকলে একসাথে এসে বসে কফি শপে । কফির অর্ডার দেয় তনিমা।তারপর বীথির দিকে ফিরে বলে বল বিথী তোর জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় টা আমায় বল। কিভাবে এত পাল্টে গেলি তুই?
বিথী বলতে শুরু করে… জানিস তো আমি ছোটবেলা থেকেই খুব চুপচাপ ,বেশি কথা বলা হইচই হুল্লোড় এসব একদম আমার পছন্দ ছিল না… স্কুলে আমার তেমন কোন বন্ধুই হয়নি কখনো আমার এমন স্বভাবের জন্যই। তার ওপর দিন রাত ঠাকুরমা কাকারা আমায় সবসময় চোখে চোখে রাখতো, আমার বাবা মারা যাবার পর মা আর আমার সব দায়িত্ব ওদেরই ছিল। স্কুল শেষ করে কলেজে যখন ভর্তি হলাম আমার ওরকম স্বভাবের জন্য তেমন বন্ধু হল না ওই তোদের মত কয়েকজন ছাড়া । আর আরো কারণ আমার ওই জড়ো ভরত মার্কা পোশাক-আশাক ।আমি তো কখনো তখন শাড়ি ছাড়া অন্য কিছু পড়িনি, আর ঠাকুরমা সবসময় বলতেন মেয়েদের গায়ে আঁচল চাপা দিয়ে চলাফেরা করা উচিত ।তাই ওদের ইচ্ছা অনুযায়ী আমি চলতাম। নিজেকে কখনো পাল্টাবো এটা স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না।

আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি তখন আমার ছোট কাকার বিয়ে হয়। বিয়ের রাতেই একটি ছেলেকে আমার ভীষণ ভালো লাগে। সে ছিল আমার কাকিমার পিসির ছেলে, কি সুন্দর দেখতে, তখন কলেজে ফার্স্ট ইয়ার ভর্তি হয়েছে সবে। ঝকঝকে স্মার্ট ছেলেটিকে দেখে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছিল সেদিন। তারপর সে মাঝে মাঝেই তার দিদির বাড়ি আসত, দেখতে দেখতে আমার সাথে একটু পরিচয় হলো। তবে তেমনভাবে কখনো কথাই বলতে পারিনি। মনের ভিতরে ভালবাসার একটা স্রোত যেন ওর দিকে দুর্নিবার হয়ে ছুটতো। কিছুতেই মন কে সরাতে পারতাম না। ও এসব কিন্তু কখনো ই জানতে পারেনি। আমার মনের ফল্গু ধারা মনের ভিতরে একাই বয়ে চলত। দেখতে দেখতে আমি কলেজে ভর্তি হয়ে গেলাম। কিন্তু ওর প্রতি টান ভালোবাসা আমার পিছু ছাড়লো না। ততদিনে ও পড়াশোনা শেষ করে চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছে।

এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন ও এল আমাদের বাড়িতে ।ভালো কোম্পানিতে মোটা মাইনের চাকরি পেয়ে গেছে।
ঠাকুমার সাথে বসে অনেক গল্প করল, সবাই খুব আনন্দে আছে আমি ঘুরে ফিরে ওর সামনে দিয়ে যাচ্ছি ,কিন্তু ওর আমাকে নিয়ে তেমন উৎসাহ নেই। শুধু একটাই প্রশ্ন প্রতিবারের মতো কেমন আছো ?আমিও ঘাড় নেড়ে বলি ভালো।
সেদিন ও চলে যাবার পর বাড়িতে ঠাকুমা ছোট কাকিমা কে ডেকে বলেন.. আচ্ছা বৌমা তোমার এই ভাইয়ের সাথে আমাদের বীথির বিয়েটা দিলে কেমন হয় ?
কাকিমা তেমন কিছুই বলেনি। শুধু বলেছিল… ঠিক আছে মা, আমি পিসির সাথে কথা বলব .। আমি এই কথা বাড়িতে আলোচনা হতে শুনেছিলাম।
মনের ভিতরে কি যে খুশি আর আনন্দ হয়েছিল সেদিন, আমার স্বপ্নের পুরুষ আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা যেন আমি পেয়ে গেছি ।সেদিন তনিমা আমি নিজেকে যেন কিছুতেই আটকাতে পারছিলাম না ,বাঁধভাঙ্গা ভালোবাসার স্রোতে ভেসে গিয়েছিল আমার মন। জানিনা তারপর কি কথা হয়েছিল বড়দের,
হঠাৎ দেখি একদিন কলেজের গেটের বাইরে ও দাঁড়িয়ে আছে। বুকের ভিতরে যেন হাতুড়ী পিটছে।মনে হচ্ছে বিয়ের কথা শুনে ও বোধহয় নিজেকে স্থির রাখতে পারেনি চলে এসেছে। সামনে দাঁড়িয়ে শুধু বলেছিল গঙ্গা র ধারে চলো, কথা আছে। কিযে ভালো লেগেছিল তনি… আমার প্রথম ভালোবাসা… জীবনে প্রথমবার তার পাশাপাশি হাঁটবো. রাস্তায় একটাও কথা বলেনি ও আমার সাথে গঙ্গার ধারে একটা ফাঁকা জায়গায় বসে বলেছিল শুধু কয়েকটা কথা, সেই কথাগুলোই আমার জীবনে দ্বিতীয় অধ্যায় তৈরি করতে সাহায্য করেছিল। জানেন অনিক বাবু তাকে আমি অনেক ধন্যবাদ দিই, আমার জীবনটাকে নতুন করে সাজিয়ে গুছিয়ে দেবার জন্য ।
তমিমা বলে , কি বলেছিল তোকে ছেলেটা ?বিথী একটু চুপ করে থেকে বলতে শুরু করে …বলেছিল তুমি জানো তোমার বাড়ি থেকে তোমার সাথে আমার বিয়ের প্রস্তাব এসেছে ?আমি কোনমতে মাথা নাড়লাম ..জানি। ও বলেছিল.. শোনো বিথী আমি কখনো তোমার মতন এমন একটা মেয়েকে বিয়ে করবো ভাবি নি ।কখনো ভাবি নি এমন আনস্মার্ট ঠাকুরমা মার্কা মেয়েকে বিয়ে করতে হবে।আর তোমায় বিয়ে করে লোক সমাজে কি করে মুখ দেখাবো বলতে পারো? হ্যাঁ মেয়ে হিসেবে তুমি খুবই ভালো… কিন্তু এতটা ও ভালো আমার পছন্দ নয় .আমি তোমার মত মেয়েকে বিয়ে করে আমার জীবনটা নষ্ট করতে পারবো না .তুমি বাড়িতে গিয়ে বলবে তুমি আমায় বিয়ে করতে চাও না। ঠিক আছে? আচ্ছা এসো, আমি চললাম .।
শুধু এটুকু বলে ও চলে গিয়েছিল ।
না আর পিছন ফিরে তাকায় নি।
আমি সেদিন যে কি অবস্থায় বাড়ি ফিরে ছিলাম জানি না।শুধু বুকের ভিতর কিছু একটা ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাবার শব্দ শুনেছিলাম ।একেই বোধয় বলে হৃদয় ভাঙার শব্দ।
সেদিনের পর থেকে বাকি তিনমাস আমি আর আমাতে ছিলাম না।
খাওয়া-দাওয়া ঘুম কিছু ছিল না ,শুধু মরে যেতে ইচ্ছা করতো ।এর মধ্যেই মাত্র দুদিনের জ্বরে আমার মা ও আমাকে ছেড়ে চলে গেল। আমি একমাত্র মেয়ে হিসেবে মায়ের মুখাগ্নি করলাম। হঠাৎ সেদিন যেন আমার চেতনা জাগ্রত হলো, সত্যিইতো .. কি করছি আমি? কেন করছি? যে আমাকে কখনো এতটুকুও ভালোবাসেনি ,তার জন্য আমি জীবন দিতে যাব ই বা কেন? মনে হল মা যেন আগুনের কুন্ডলী ভেতর থেকে আমায় বলছে… তুই পাল্টে যা ,বিথী …নিজেকে তৈরি কর …
সেদিন মনে মনে মায়ের আগুন ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করলাম আমি নিজেকে নিজেই পাল্টে ফেলব । রচনা করবো নিজেই নিজের জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় ।
এরপর ধীরে ধীরে নিজেকে পাল্টাতে থাকি আমি। আবার নতুন করে পড়াশোনা শুরু করি, পড়াশোনার সাথে সাথে সব দিক থেকে নিজেকে গ্রুমিং করি ।অবশ্য অতটা সহজ ছিল না সবকিছু, তবে বছরখানেকের মধ্যে আমি অন্য এক বিথী হয়ে উঠলাম সকলের অগোচরে ।
তারপর আমার জীবনে এলো পলাশ ।পলাশ ফুলের মতোই নববসন্তের স্বপ্ন নিয়ে এলো আমার জীবনে ,ভাসিয়ে নিয়ে গেল বাঁধনছাড়া পাল ছেঁড়া নৌকার মত প্রেমের জোয়ারে।
আমি ও সব বাঁধন খুলে ফেলে ওর সাথেই ভেসে গেলাম, এখনো দুজনে ভাসছি। বলেই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে পড়ে বিথী।অনেক দেরী করে ফেললাম রে ,পলাশ অপেক্ষা করছে। সরি সরি আবার অন্যদিন কথা হবে। চলি রে …বাই…প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে গেল বিথী।
পিছন থেকে তনিমা ডাকলো বিথী … নাম্বারটা ….ঠিকানাটা….,. যা: দেখলে তো অনিক? কিছুই দিয়ে গেল না। কি করে ওর সাথে যোগাযোগ হবে বলতো?বলতে বলতে চেয়ারে বসে পরে অনিক এর দিকে তাকালো তনিমা।

অনিক বলে ও আর তোমার সাথে যোগাযোগ করবে না তনিমা ।

তনি… কেন?

অনিক… কারণ ও এতক্ষণ যে ছেলেটার কথা বলে গেল সেই ছেলেটা যে আমি তনিমা। এই অনিক চৌধুরী।।

সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *