গিরিশ কাহিনী  — পাপিয়া সাহা

পূর্ব প্রকাশিতের পর।
চতুর্থ পর্ব।

গিরিশ কাহিনী 

পাপিয়া সাহা

1876 সালে প্রিন্স অফ ওয়েলস(7th Edward) কোলকাতা পরিদর্শনে আসেন। কোলকাতা হাইকোর্টের সুপ্রসিদ্ধ উকিল জগদানন্দ মুখোপাধ্যায় তাকে নিজগৃহে আমন্ত্রণ জানান।তার গৃহিণী অন্যান্য মহিলাদের সাথে শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি,বরণ প্রভৃতি দেশীয় আচারে তাকে বরণ করেন।এই ঘটনা কোলকাতায় খুব আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এই নিয়ে নাট্যকার উপেন্দ্র নাথ দাস একটি ব্যাঙ্গধর্মী নাটক রচনা করেন। তার নাম দেওয়া হয় “গজদানন্দ”। এই নাটকটির জন্য গিরিশ চন্দ্র কয়েকটি গান রচনা করেন। 1876 সালে 19 শে ফেব্রুয়ারি গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে নাটক টি অভিনীত হয়। এতে বৃটিশের এক অনুগত প্রজাকে অনুকরণ করে বিদ্রূপ করা হয়।ফলে বৃটিশ সরকার নাটকের অভিনয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এবং 1876 সালে25th মার্চ Dramatic Performances Control Bill নামে একটি আইনি খসড়া প্রবর্তন করা হয়। এতে বলা হলো কোনও নাটক যদি সরকার পক্ষ বিরোধী কুৎসাপূর্ণ বা মানহানিকর অর্থাৎ জনস্বার্থ বিরোধী অশান্তির কারণ হয় , তাহলে সরকার সেই অভিনয়ের প্রদর্শন নিষিদ্ধ করতে পারে। ফলে বাংলা রঙ্গমঞ্চকে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পরে গিরিশের ওপর। এর ফলে তার তিনটি নাটকের ওপর বৃটিশ সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
1877 সালের জুলাই মাসে গিরিশ চন্দ্র ভুবন মোহন নিয়োগীর কাছ থেকে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার তিন বছরের জন্য লিজ নিয়ে নাম রাখলেন ন্যাশনাল থিয়েটার। এখানে গিরিশ ” মেঘনাদ বধ” নাটকে রামচন্দ্র ও মেঘনাদের দুটো চরিত্রেই অভিনয় করেন এবং খ্যাতনামা অভিনেত্রী বিনোদিনী প্রমীলার ভূমিকায় অভিনয় করেন। নাটক টি সাফল্যের চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। এরপর “পলাশীর যুদ্ধ ” নাটকে গিরিশের লর্ড ক্লাইভ অভিনয় দেখে বিখ্যাত কবি নবীন চন্দ্র সেন আপ্লুত হন এবং গিরিশের সাথে চির বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হন। একের পর এক ‘আগমনী” “অকাল বোধন” ” বিষবৃক্ষ ” দুর্গেশনন্দিনী” নাটকে অভিনয় করেন। শুধুমাত্র অভিনয় নয় উপন্যাস থেকে নাট্যরূপ দেওয়া চরিত্রের সংলাপ তৈরি করা সংগীত লেখা সব একই সাথে অনায়াস দক্ষতার সাথে চালাতেন। এবং প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন।1879 সালে ন্যাশনাল থিয়েটারের মালিক ভুবন মোহন আকন্ঠ দেনায় ডুবে যান ।তখন তার কাছ থেকে প্রতাপ চাঁদ জহুরি নিলামে থিয়েটারটি কিনে নিয়ে গিরিশ চন্দ্র কে পুরো সময় থিয়েটারের কাজে নিয়োজিত করেন। প্রতাপ চাঁদের আন্তরিকতা, উৎসাহ, ও ব্যবসায়িক বুদ্ধি দেখে গিরিশ সম্মত হন এবং থিয়েটারের ব্যবস্থাপক ও পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই কাজের জন্য তিনি মিঃ পার্কারের কাছে কোম্পানীর কাজে ইস্তফা দেবার পদত্যাগ পত্র দাখিল করলেন। কিন্ত তিনি গিরিশকে দুটো কাজই চালিয়ে যেতে অনুরোধ করেন। এমন কি বারটার পরও অফিসে আসার অনুমতি দেন। কিন্ত গিরিশ তার সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। শেষ পর্যন্ত সাহেব তার ইস্তফাপত্র গ্রহণ করেন ও বিদায়কালে গিরিশ চন্দ্র কে একটি হীরের আংটি স্মারক হিসেবে উপহার দেন। সওদাগরি অফিসের কর্ম জীবন গিরিশের এখানেই শেষ হল।
প্রতিভাবানদের জীবনের কর্মপথে চলতে গিয়ে একটি দিক স্তব্ধ হলেও সহস্র মুখ উন্মোচিত হয়। তারা নিজেদের প্রতিভার আলোতেই নিজেদের পথ বেছে নেন।
ছত্রিশ বছর বয়সে গিরিশ চন্দ্রের জীবনের একটি নতুন অধ্যায় শুরু হল। প্রতাপ চাঁদ জহুরি তাকে ন্যাশনাল থিয়েটারের ম্যানেজার নিয়োগ করলেন ঠিকই কিন্ত গিরিশ তার প্রতিভার দ্বারা ঐ থিয়েটারের ম্যানেজার ছাড়াও হয়ে উঠলেন নাট্যকার পরিচালক এবং মূল অভিনেতা। জহুরি জহর চিনেছিলেন ঠিকই। গিরিশের প্রতিভা বুঝতে পেরে তিনি তাকে থিয়েটারের পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করলেন। তার ফলে গিরিশ চন্দ্র তার পুরোনো অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের সঙ্গে কিছু নতুন শিল্পী নিয়ে একটি শক্তিশালী স্থায়ী দল গঠন করলেন। মঞ্চস্থ করবার জন্য গিরিশ ভাল ভাল ঐতিহাসিক নাটক নির্বাচন করলেন। মঞ্চের প্রেক্ষাপট পশ্চাৎপদ পোষাক পরিচ্ছেদ ও সংগীত বেছে নিয়ে প্রথম “হামীর’ ঐতিহাসিক নাটকটি নির্বাচন করলেন। 1881 সালের 1st জানুয়ারি নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। ধীরে ধীরে দীনবন্ধু মিত্র, মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নাট্যরচনার মধ্যে দিয়ে ন্যাশনাল থিয়েটার কলকাতায় অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠল।”মায়াতরু” ” আলাদিন” ” মোহিনী প্রতিমা” ইত্যাদি বিভিন্ন ঐতিহাসিক নাটকের মধ্যে তিনি পাশ্চাত্য ভাবধারার সংমিশ্রন ঘটান। কিন্ত ধর্মপ্রাণ বাঙ্গালী সম্প্রদায় ঐতিহাসিক নাটকে সন্তুষ্ট নয় বুঝতে পেরে গিরিশ চন্দ্র হিন্দু মহাকাব্য ও পুরান অবলম্বনে নাটক লিখতে আরম্ভ করেন। রামায়ণ অবলম্বনে অনিয়মিত অমিত্রাক্ষর ছন্দে লিখলেন “রাবন বধ”।এই নাটকে তিনি রামের ভূমিকয় এবং বিখ্যাত অভিনেত্রী বিনোদিনী সীতারাম ভূমিকায় অভিনয় করেন। এটি দর্শকদের ধর্মীয় আবেগ কে স্পর্শ করেছিল ভীষণ ভাবে।ছত্রিশ বছর বয়সে নাটকের জন্য তার লেখক জীবন শুরু হয়।তার প্রবাহ চলতে থাকে প্রায় তিরিশ বছর ধরে। ব্যাঙ্গধর্মী নাটক, গীতিনাট্য সবরকম লেখাতেই তিনি ছিলেন অনায়াস সিদ্ধহস্ত। তার নাটকের সংখ্যা ছিল প্রায় ঊণআশি। তার নাটক গুলি মোটামুটি ভাবে ধর্মীয়,সামাজিক, ঐতিহাসিক, পৌরাণিক এবং দেশপ্রেম মূলক বিষয়বস্তুর উপর নির্ভরশীল ছিল। সবসময়ই নতুন কিছু করার মানসিকতা বাংলা রঙ্গমঞ্চে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল ও এক নতুন আধুনিক মাত্রা দান করেছিল। সেজন্য তাকে বাংলা রঙ্গমঞ্চের জনক বলা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *