# আমি কেন লিখি #-২ কলমে — অরণ্যানী

# আমি কেন লিখি #-২

কলমে — অরণ্যানী
আগেই উল্লেখ করেছি অনভ্যস্ত হাতে লেখা শুরুর কথা। অনভ্যস্ত হাতকে অভ্যস্ত করতে প্রতিদিন সকালে ফেসবুকে মেসেনজারে বন্ধুদের কিছু লিখে পাঠাতাম সুপ্রভাত জানিয়ে। সেই লেখায় থাকত আমার প্রতিদিনের তাৎক্ষণিক অনুভূতি। কিছু মানুষ তাতেও আমাকে পাগল ভাবলেন। কিছু পুরুষ বন্ধু প্রেম করার ইচ্ছা প্রকাশ করছি মনে করে ভুল করলেন। অনেকে এভাবে পাঠাতে বারণও করলেন। আবার অনেকে যথেষ্ট খুশি হয়ে প্রশংসাও করলেন। সবকিছু বাদ দিয়ে প্রশংসাটুকুই নিলাম মানসিক তৃপ্তির জন্য। আমার উদ্দেশ্য ছিল এভাবে সহজ ভাষায় নিজের অনুভূতি সকলের কাছে ব্যক্ত করলে তারাও হয়তো দু চার লাইন নিজেরা লিখতে উদ্যোগী হবেন। কারণ দু একজন ছাড়া কোনও লেখক বন্ধু পাইনি তখনও। আবার সেই দু একজনের তুলনায় আমার অনভ্যস্ত হাতের লেখার মান হয়তো যথেষ্ট কমই ছিল। তাই তারা তেমন পাত্তা দিতেন না এই পাঠককে। এখন একটু আফসোস হয়, সেইসব লেখা একটাও সংরক্ষিত করিনি বলে। করলে একটু মিলিয়ে দেখতাম, কেমন ছিল সেগুলো।
লেখক না হলেও পাঠক ছিলাম কৈশোর থেকে। কৈশোরের একাকীত্ব বোধ আমাকে পাঠক হয়ে উঠতে সাহায্য করে। মুখচোরা লাজুক প্রকৃতির মেয়েটির (মানে আমার) বন্ধু সংখ্যা ছিল বড্ডই কম। মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় থেকে আমি ধীরে ধীরে পাঠক হয়ে উঠি। তার আগে ছিলাম শ্রোতা। দিদি পড়ে শোনাত বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত লেখকদের গল্প উপন্যাস। প্রথম পাঠের শুরু রবীন্দ্রনাথ। বুঝতে অসুবিধা হয়নি। তবে সব লেখা যে বুঝতে পেরেছি ওই বয়সে, তাও নয়। যেগুলো বুঝতে পেরেছি, সেগুলোই পড়েছি। তারপরই বঙ্কিমচন্দ্র। যার ভাষা ভীষণ কঠিন। আমি তখন রোমান্সে ভাসছি। তাই ভাষা কোনও বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি আমার পাঠে। ধীরে ধীরে তারাশঙ্কর, বিভূতি ভূষণ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। একই সঙ্গে শীর্ষেন্দু সুনীল। সেছাড়া পাশের গ্রামের লাইব্রেরির সদস্য পদ গ্রহণ করে বনফুল, সুবোধ ঘোষ, আশুতোষ, কেউই বাকি রইলেন না। তবে বাকি রইলেন কিছু ছকে বাঁধা মন জোগানো জনপ্রিয় লেখক। নাম করলাম না, তবে তাদের কাহিনী টানতে পারেনি আমাকে। আর কবিতা পাঠের প্রসঙ্গ এখানে উল্লেখ করলাম না ইচ্ছা করেই। কারণ এই বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা এমনই, যা পরে লিখলে হয়তো অনেকের কাছেই বেশ উপভোগ্য ও মজার লাগবে।
এই তো গেল পাঠক জীবনের কথা। লেখক জীবনের শুরুর কথা বলতে গেলে পাঠক জীবনের কথা উঠে আসবেই। ভালো পাঠক না হলে কি লেখক হওয়া যায়? হ্যাঁ তাও ব্যতিক্রমী ব্যক্তির ক্ষেত্রে সম্ভব। বেশিরভাগ লেখকের ক্ষেত্রেই নয়। এই সকল প্রচুর সাহিত্যিকের লেখা প্রচুর গল্প উপন্যাস পড়ার পর মনে রাখতে পেরেছি ক’টা? অনেক কাহিনী একাধিক বারও পড়েছি। বিশেষ কিছু মনে রয়ে গেছে। কখনও শুধু সারবস্তু টুকুই। কখনও বিশেষ অংশ টুকুই। তবে অবচেতনে বোধহয় অনেক কিছু ঢুকে গেছে।

এরপর চলে আসি একেবারে ২০১৮ সালের প্রথম দিকে। ফেসবুকে তখনও এক বছর পূর্ণ হয়নি। এল আমাদের বিবাহ বার্ষিকী। সকলেই দেখতাম বিবাহ বার্ষিকীতে খুব সুন্দর ফটো পোস্ট করেন স্বামী স্ত্রী একসঙ্গে। আমার স্বামীর কাছে এটা ছেলেমানুষী ঠেকে। আমি প্রস্তাবও দিইনি ফটো পোস্ট করার। তবে মনে মনে দুঃখিত হয়ে ফেসবুকে একার ছবি পোস্ট করি। যদিও সে দুঃখ ছিল ক্ষণিকের। অনেক বন্ধু সহানুভূতি জানালেন। দুঃখ কেটে যেতেই মনে হল, আমাদের স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটা যে এক ভিন্ন প্রকৃতির, আর তা যে বিয়ের পরই হঠাৎ করে তৈরি হয়ে যায়নি বা কারুরই যায় না, সে বিষয়ে কিছু লেখা প্রয়োজন। সে সময় অনেক মহিলাকে ফেসবুকে দুঃখ প্রকাশ করে পোস্ট করতে দেখতাম, যে কেউ ভালোবাসে না তাকে, অথবা তিনি ভালো নেই। তাই মনে হল, অনেক মানুষই বোধহয় বাস্তবের মাটিতে পা দিয়ে হাঁটেন না। ফেসবুকের কতগুলো পোস্ট দেখে তারা বাস্তব থেকে সরে যাচ্ছেন। তাই আমাদের স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের বিশ্লেষণ দিয়ে সমাজের বাস্তব রূপটা সোস্যাল মিডিয়ায় তুলে ধরতে থাকলাম নিয়মিত পর্বে পর্বে। ফেসবুকের অনেক অবাস্তব গল্প ছেড়ে মানুষ যাতে একটু বাস্তবমুখী হয়, এটাই ছিল উদ্দেশ্য। বন্ধু সংখ্যার অনুপাতে পাঠক পেলাম ভালোই। পরে এটিকে সঠিকভাবে সাজিয়ে কিছুটা আত্মজীবনী মূলক লেখায় রূপ দিতে লাগলাম। এক মহল থেকে আপত্তি আসতেই লেখাটির নাম করণ করলাম, “কোন এক গৃহবধূর আত্মকথা”, যা আজ পুস্তকারে প্রকাশ পেয়েছে। এই লেখাটি চলা কালীন আমি অন্য নানান সামাজিক বিষয়ে ধীরে ধীরে লিখতে শুরু করলাম ফেসবুকে অদিতি ভট্টাচার্য্য প্রোফাইল থেকেই। পাঠক তৈরি হল। মনে তখন এটুকুই আশা, যে মানুষ সুস্থ, বাস্তব জীবনের কাহিনীও পড়তে ভালোবাসে। শুধু লেখকের অভাব। লেখকের অভাব কথাটা এইজন্য বললাম, যে উন্নত মানের লেখকও ফেসবুকে আছেন, ততদিনে তাও আমার কাছে আবিষ্কৃত হয়ে গেছে। কিন্তু তাদের লেখা সাধারণ পাঠকের মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। তাই লেখার ভাষা সহজ হতে হবে, সকলের মনকে স্পর্শ করতে পারতে হবে, আকর্ষণীয়ও রাখতে হবে, বাস্তব সম্মতও হতে হবে। যদি সেই প্রচেষ্টা নেওয়া যায়, তবে পাঠের অভ্যাস যাদের তেমন নেই, বা ব্যস্ততার কারণে, জীবনের নানান পরিস্থিতির কারণে পাঠক হয়ে ওঠা যাদের হয়নি, ধীরে ধীরে তাদের মধ্যেও সুস্থ রুচি সম্পন্ন কিছু পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠবে। বাস্তব সমাজ নিয়ে তারা কিছু ভাববে।
সেই দিক থেকে এটুকু আশার আলো আমি দেখতে পেতে শুরু করি ফেসবুকে। তাই এটুকু সফলতা পেয়েছি, তা বলতে পারি,লেখক হিসাবে বিখ্যাত না হলেও।
(সমাপ্ত)

1 thought on “# আমি কেন লিখি #-২ কলমে — অরণ্যানী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *