পূর্ব প্রকাশিতের পর তৃতীয় পর্ব ***** গিরিশ চন্দ্রের বাল্য জীবন ও কর্ম জীবন ***** পাপিয়া সাহা
পূর্ব প্রকাশিতের পর
তৃতীয় পর্ব ***** গিরিশ চন্দ্রের বাল্য জীবন ও কর্ম জীবন ***** পাপিয়া সাহা
প্রতিভা মানুষের অন্তরের সম্পদ। প্রতিভা মানুষকে দেবত্বে উন্নীত করে। ভাগবৎ গীতাতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন- ” এ জগতে যা যা ঐশ্বর্যযুক্ত, শ্রী সম্পন্ন ও বলশালী সে সকলই আমার শক্তির অংশ সম্ভূত।” প্রতিভাবান ব্যাক্তি কোনও না কোনও ভাবে দেশ ও জাতির সাংস্কৃতিক জীবনকে প্রভাবিত করে সমাজ জীবনে গভীর রেখাপাত করে। গিরিশ চন্দ্র ঘোষ ছিলেন একজন বিরাট মাপের মানুষ। তার জ্ঞান, বুদ্ধি, মণীষা, চিন্তা ভাবনা,সূক্ষ্ম বিচার বোধ,চারিত্রিক বৈচিত্র্য, কর্ম দক্ষতা, পরিশ্রম করার ক্ষমতা, বহুমুখী প্রতিভা , কল্পনা ও সৃজনী শক্তি, দৃঢ ও নম্র মানসিকতা সকল দিকগুলিই তাকে এক বিরাটত্ব দান করেছিল। তাই তাঁর কর্ম জীবনেরও নানা পরস্পর বিরোধী দিকগুলি সূক্ষ্ম ভাবে বিশ্লেষণ করে তার উদ্দেশ্য সফলতা, ব্যর্থতা সমালোচনা করা আমার মত ক্ষুদ্র লেখিকার ক্ষেত্রে সাগরের গভীর তলদেশ মাপার মতই অসম্ভব।
গিরিশের পিতা নীলকমল ঘোষ একজন সুদক্ষ অ্যাকাউন্টেন্ট ছিলেন। তিনিই প্রথম কলকাতার সওদাগরি অফিস গুলিতে ডবল এন্ট্রি অ্যাকাউন্ট সিস্টেম চালু করেন। গিরিশ চন্দ্রের পিতার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে গিরিশের শ্বশুর নবীন চন্দ্র সরকার নীলকমলের কাছে অ্যাকাউন্টস শেখেন এবং পরবর্তি কালে নীলকমলের মৃত্যুর পর পরিবারের ভরণ পোষণের জন্য গিরিশকে তার অফিসে অ্যাকাউন্টস বিভাগে চাকরির ব্যবস্থা করে দিলেন। গিরিশ ওই অফিসে প্রায় আঠার বছর ওই অফিসে দক্ষতার সাথে কাজ করে মিঃ অ্যাটকিনসন ও অন্যান্য সাহেবদের প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছিলেন। কিন্ত সামান্য কোম্পানীর কর্মচারী হয়ে আয় করা ও এক আটপৌরে সাধারণ জীবন যাপন করার মধ্যে গিরিশের ভাগ্য নির্ধারিত ছিলনা। কোম্পানীর দুই সাহেবদের মিঃ বানক্রপ্ট ও মিঃ অ্যাটকিনসন সাহেবের মধ্যে তীব্র মনোমালিন্য হওয়ায় কোম্পানী বন্ধ হয়ে যায়। তারপর পনের বছর ধরে গিরিশ চন্দ্র বিভিন্ন অফিসে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্ম করেন। কিন্ত তার অফুরান স্ফূরণ শক্তি ও সৃজনী প্রতিভা তাকে কর্মে নিরুৎসাহ করে ও তিনি থিয়েটারে নিয়োজিত হন। সারাদিন অফিসে কাজ করে সন্ধ্যায় থিয়েটারে অভিনয় করে ভোর তিন টা থেকে চারটায় বাড়ি ফেরা তার প্রাত্যহিক জীবন যাত্রার অঙ্গ হয়ে দাঁড়াল। ফলে পরিবারের প্রতি সঠিক মনোযোগ দিতে না পারার কারনে তার স্ত্রী প্রমোদিনী মৃত কন্যা সন্তান প্রসব করে অসুস্থ হয়ে পরেন। অনেক অভিজ্ঞ চিকিৎসকের চিকিৎসা ও সেবা যত্ন সত্ত্বেও স্ত্রীকে বাঁচাতে অক্ষম হলেন।তার বয়েস তখন মাত্র তিরিশ।স্ত্রীর মৃত্যুতে তিনি অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পরেন। তীব্র মর্মবেনায় ও মানসিক অশান্তি থেকে আত্ম বিস্মৃতির আকাঙ্খায় গিরিশ চন্দ্র কবিতা লিখতে শুরু করলেন। পরবর্তি কালে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে গিরিশ বলেছিলেন ” বাল্যে মাতৃবিয়োগ কৈশোরে পিতৃ বিয়োগ যৌবনে স্ত্রী বিয়োগ যে কি নিদারুণ তা আমি ভুক্তভোগী হয়ে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি।” এই শোক প্রশমিত করার জন্যই গিরিশ চন্দ্র ধীরে ধীরে সুরাপানে মত্ত হয়ে পরলেন।
একবার ভাগলপুরের নিকটবর্তি কোনও এক পর্বতে গিরিশ বন্ধু বান্ধবের সাথে বেড়াতে যান এবং যৌবন সুলভ চপলতায় একা একটি গহ্বরে নামিয়া পড়েন । ঐ গভীর গহ্বরে প্রবেশ লাভ সহজ হইলেও ওপরে ওঠা সহজসাধ্য ছিল না।ইহা নামিবার পর তিনি বুঝিতে পারিলেন। নানান ভাবে এবং বন্ধুগনের আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তিনি উপরে উঠতে সমর্থ হলেন না। এইবার তিনি ভয় বিহ্বল হইয়া পরিলেন।বন্ধুরা ভীত হয়ে তাকে বললেন, গিরিশ নাস্তিক বলেই ঈশ্বর তাকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারলেন না।একবার তাকে স্মরণ করে তার নাম নিলে এই বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।বন্ধুগনের কাতর অনুরোধে গিরিশ ঈশ্বর কে ডাকলেন এবং সকল বিস্ময়ের ঊর্ধ্বে উঠে তিনি উপরে উঠতে সমর্থ হলেন। সেই দিন গিরিশ বন্ধুগনকে বললেন- ” আজ ভয়ে ঈশ্বরের নাম উচ্চারণ করলাম। অতঃপর প্রেমে যদি কখনও তাকে ডাকতে পারি তো ডাকিব নচেৎ নহে- জীবন রক্ষার্থেও নহে “। সারাজীবন তিনি ছিলেন ঠিক এই রকম সত্য সরল সহজ অকপট তার চরিত্রে ও মননে।
আঠারশো পচাত্তর থেকে আঠার শো ছিয়াত্তরের মধ্যে গিরিশের প্রথমা স্ত্রী ও পরিবারের অনেক প্রিয় জনের মৃত্যুতে তিনি শোকে বিহ্বল হয়ে পরেন এবং অসম্ভব মাদকাসক্ত হয়ে পরেন।শেষে আত্মীয় স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের পরামর্শ ও ঐকান্তিক অনুরোধে তিনি পুনরায় বিবাহ করেন। এতেণণ তার মানসিক অবসাদ খানিকটা অবদমিত হয় ।