দ্বিতীয় পর্ব ***** গিরিশ চন্দ্রের বাল্য জীবন ও কর্ম জীবন ***** পাপিয়া সাহা
দ্বিতীয় পর্ব
গিরিশ চন্দ্রের বাল্য জীবন ও
কর্ম জীবন।
পাপিয়া সাহা
পৃথিবীতে যা কিছু ঘটে তা সবই ঈশ্বরের নির্দেশিত। গিরিশ চন্দ্রের জন্যও তার একটি নির্দিষ্ট অভিপ্রায় ছিল। গিরিশ চন্দ্র দারুণ সৃজনশীল, প্রচণ্ড কর্মক্ষমতা অনমনীয় ব্যক্তিত্ব, আবেগপ্রবনতা ও অদম্য ইচ্ছা শক্তি নিয়ে জন্মেছিলেন। সমাজ ও মানুষের ভুল ধারণা সত্ত্বেও তাঁর প্রতিভা ও সততা তাকে শ্রীরামকৃষ্ণের পদপ্রান্তে নিয়ে তার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করেছিল ও একটি আধ্যাত্মিক ইতিহাসের মহৎ সূচনা করেছিল। এ হেন মানুষের বাল্য জীবনও ভীষণ বৈচিত্র্যময়।
গিরিশ চন্দ্র ঘোষ 1844 খ্রীষ্টাব্দের 28 শে ফেব্রুয়ারি উত্তর কলকাতার বাগবাজারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা শ্রী নীলকমল ঘোষ একজন প্রসিদ্ধ accountant ছিলেন। তার মাতা রাইমনি দেবী ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক এবং কোমলপ্রাণা। পিতামাতার একাদশ সন্তানের মধ্যে গিরিশ চন্দ্র ছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মত মাতার অষ্টম গর্ভের সন্তান। হিন্দু পুরানের ঐতিহ্য অনুযায়ী অষ্টম গর্ভের সন্তান শুভ লক্ষ্মণ যুক্ত হয়।গিরিশের সম্পর্কেও তার জ্যেষ্ঠতাত ভবিষ্যত বানী করেছিলেন, এ ছেলে নিশ্চয়ই আমাদের বংশ উজ্জ্বল করবে।গিরিশের জন্মের পর তার মা প্রসব জনিত সূতিকা রোগে আক্রান্ত হন এবং নবজাত শিশুকে স্তন্য দানে অসমর্থ হন।তাই উমা নামে এক দাসী স্তন্য পান করিয়ে তাকে মানুষ করেন। ছেলেবেলা থেকেই গিরিশ ছিলেন প্রচণ্ড জেদী ও উগ্র মেজাজের। এর কারন জিজ্ঞেস করলে তিনি হেসে বলতেন “ছেলেবেলায় বাগদিনির মাই খেয়ে মানুষ হয়েছি , তাই অমন স্বভাব হয়েছে। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন সাহসী,স্বাধীনতা,শক্তিশালী ও মানসিক ভাবে দৃঢ।
স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্কুল ও পরে হেয়ার স্কুলে পাঠ নেন।তারপর সেখান থেকে হিন্দু স্কুল এবং সবশেষে পাইকপাড়া স্কুলে ভর্তি হন। পরবর্তি কালে স্মৃতিচারণ কালে গিরিশ একটি ঘটনার কথা বলেছিলেন। “একদিন স্কুলে যাবার পথে চিৎপুর রোডে দেখলেন একটি আট বছরের সাহেবের ছেলে একটি শেয়াল কে তাড়া করে ছুটছে। চিৎপুরে তখন অনেক সাহেব সপরিবারে বাস করতেন। আমি ব্যস্ত হয়ে ছেলেটিকে বললাম, ওহে ওইরকম কোরোনা। এখনই যে শেয়াল তোমাকে কামড়ে দেবে। এই বলে ছেলেটিকে সতর্ক করলাম। ছেলেটি থমকে দাঁড়াল। আমি কাছে গিয়ে ছেলেটিকে ইংরেজিতে বললাম, “তুমি কি শেয়াল কে ভয় কর না? ” ছেলেটি সদর্পে বলল, ‘Oh,no no. The jackle will be frightened at my sight.” আমি সেই ছেলেটির সাহস ও নির্ভীকতা দেখিয়া আশ্চর্য হইলাম।” আমরা মায়ের কোল হইতে জুজু ও ভূতের ভয় দেখাইয়া বড় করিতে চেষ্টা করি।পাছে কোনও বিপদ ঘটে,এই আশঙ্কায় প্রত্যেক কাজে বাধা দিয়া ছেলেগুলিকে অত্যন্ত নিরীহ ও গোবেচারা করে তুলি। চরিত্র গঠন ও শিক্ষাদান সম্পর্কে ইংরেজদের ও আমাদের কতটা পার্থক্য এইটা তুলনা করিয়া তিনি ভীষন ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।
গিরিশ চন্দ্রের সহজ,সরল, সুখী পারিবারিক জীবনের সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, ভালবাসা বেশি দিন স্থায়ী হল না। অকালেই তার পিতার মৃত্যু মাতার প্রয়াণ পরপর ভাইবোনদের পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া তাকে অত্যন্ত বিমর্ষ ও বিধ্বস্ত করে তুলেছিল। এমন কি বিবাহিত জীবনের স্বল্প স্থায়িত্ব ও তাকে এলোমেলো ও উদভ্রান্ত করে তুলেছিল। তার অন্তর ছিল গভীর মমতা ও ভালবাসায় পরিপূর্ণ। তাই তাঁর ভালবাসার প্রিয়জনেরা একের পর এক পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়াতে তার শোকাচ্ছন্ন হৃদয়কে শান্তি ও সহানুভূতি জানানোর কেউ রইল না। বিচ্ছেদ বেদনা তাকে কাতর করে তুলেছিল, যা তাকে তার চরিত্র গঠন কে ভীষণ মাত্রায় প্রভাবিত করে পরবর্তিতে উশৃঙ্খল ও বেপরোয়া করেছিল।
ভারতীয় সংস্কৃতির এক যুগ সন্ধিক্ষণে গিরিশ চন্দ্র আবির্ভূত হয়েছিলেন। সে সময় পাশ্চাত্য শিক্ষা সংস্কৃতি ও ধর্মকে ভারতীয় তথা বাংলায় জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। ফলে ভারতীয় সংস্কৃতি ও ধর্মের সঙ্গে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। গিরিশের সমসাময়িক যুব সমাজ এক ধরনের অবিশ্বাস, নাস্তিকতা ও সাংস্কৃতিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে দিয়ে বেড়ে উঠছিল। পাশ্চাত্য শিক্ষার মূল প্রকৃতি উপলব্ধি করবার জন্য তিনি ক্লাসিক ইংরাজি ভাষা রপ্ত করতে আগ্রহী হলেন। ইংরাজি সাহিত্য পাঠের সাথে সাথে তিনি রামায়ণ,মহাভারত,পুরান বেদ এবং বিভিন্ন বাংলা সাহিত্যও পাঠ করলেন। বাংলার প্রখ্যাত কবি ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্তের লেখা কবিতা পড়ে তিনি প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত হয়ে গিরিশ বাংলায় কবিতা ও গান রচনা আরম্ভ করলেন। তার ডাক্তার মামা নব কৃষ্ণ বসুর কাছে গিরিশ বিতর্কের কৌশল শিক্ষা আরম্ভ করলেন। বিষয়েও গভীরে প্রবেশ করার ক্ষমতা ও অসাধারণ কল্পনাশক্তি পরবর্তি কালে গিরিশ কে একজন মহান কবি ও নাট্যকার রূপে তৈরি করে তুলেছিল।