শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের বোহেমিয়ান ভক্ত নাট্যাচার্য গিরিশ চন্দ্র ঘোষ ***** পাপিয়া সাহা
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের বোহেমিয়ান ভক্ত নাট্যাচার্য গিরিশ চন্দ্র ঘোষ
পাপিয়া সাহা
শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবপ্রবাহে অবগাহিত তার ভক্ত সম্প্রদায়কে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়।একদিকে তার করুনাপ্রার্থী গৃহী ভক্ত সম্প্রদায় অপরদিকে তার ভাবাদর্শে লালিত তরুন উচ্চ শিক্ষিত, ত্যাগী সন্ন্যাসী সম্প্রদায়। এই দুই উৎসাহী,অনুরাগী ভক্ত সম্প্রদায় ঠাকুরের ভাবপ্রবাহকে নতুন মাত্রায় নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরার সাধনায় ব্যাপৃত থেকেছেন সচেতন ও অবচেতন ভাবে। শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহী ভক্তদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তার ‘বোহেমিয়ান’ ভক্ত গিরিশ চন্দ্র ঘোষ। বীরভক্ত গিরিশের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণের মিলন ও তার পরিবর্তনের কাহিনী মানুষের মনে অত্যন্ত কৌতুহল উদ্রেক করে। বেপরোয়া, উশৃঙ্খল, লাম্পট্য, মদ ও নেশার প্রতি আসক্তি আবার অপরদিকে সূক্ষ্ম বিচারবুদ্ধি, বিশাল জ্ঞান সম্ভার, বাংলা ও ইংরাজি সাহিত্যে সমান দক্ষতা তাকে পরস্পর বিরোধী প্রকৃতিতে আকর্ষণীয় করে তুলেছিল। একাধারে তিনি ছিলেন নির্ভীক, তেজস্বী, দুঃসাহসী অপর দিকে ছিলেন নরম,উদার,দরিদ্র ও পতিতদের প্রতি অনুকম্পায় পরিপূর্ণ। তিনি ছিলেন সরল ও স্পষ্টবাদী। তার ভেতরে কোনও ভন্ডামি ছিল না।তার চরিত্রের প্রতিটি দিকই ছিল বিপরীত ক্রিয়াশীল ও একে অপরের পরিপূরক। তিনি যা করতেন তা অকপটে করতেন। একবার তিনি জগজ্জননী জগন্মাতাকে তার খ্যাতনামা অভিনেতার খ্যাতি সম্পূর্ণ অর্পণ করেছিলেন নির্দ্বিধায়। আরেকবার তিনি তার পরম গুরু শ্রীরামকৃষ্ণকে বকলমা দিয়ে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করেছিলেন। এ হেন বহুমুখী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী গিরিশ চন্দ্র ঘোষকে নিয়ে কিছু লেখা অত্যন্ত দুরূহ। জনৈক লেখক একবার গিরিশ চন্দ্রের জীবনি লেখার অনুমতি চাইলে তিনি বলেন :-“paint me as I am”.আমি যেমন তেমন ভাবে আমাকে চিত্রিত কর।
গিরিশ চন্দ্র সম্পর্কে বহু কাহিনী জনশ্রুতি আকারে লোকমুখে প্রচারিত, যার কোনটাই সঠিক বা আংশিক সত্য নয়।তার প্রকৃত জীবন, চরিত্র গঠন ও মানসিক ভঙ্গী উপলব্ধি করতে হলে তার ব্যক্তিগত জীবন, কর্মজীবন, নাট্যজীবন ও আধ্যাত্মিক জীবন আত্মিক ভাব ও গবেষণামূলক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে মূল্যায়ন করতে হবে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি কলকাতা ছিল ভারতে বৃটিশ সাম্রাজ্যের পীঠস্থান। কলকাতা বন্দর ছিল পশ্চিমি চিন্তা ভাবনা ও সংস্কৃতির প্রবেশ পথ। ভাল মন্দ পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে এই কলকাতা থেকেই। তাই আমরা দেখতে পাই প্রত্যন্ত কামারপুকুরের থেকে কলকাতা আসতে গদাধরকে গ্রামজীবনের অফুরন্ত সময় ভাণ্ডার ও প্রাকৃতিক সম্পদ ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পরতে হয়েছিল সমকালীন ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দুতে। তাতেই এক মহা আধ্যাত্মিক ভাব জগতের সূচনা হয়েছিল দক্ষিণেশ্বর ভবতারিনী মায়ের মন্দিরে। গিরিশ চন্দ্রের উপর এই দুই পরিপূরক মননশীলতা সৃষ্টি হয়েছিল বোধ করি পশ্চিম থেকে আগত বৈজ্ঞানিক নাস্তিকতা অপর দিকে খ্রীষ্টান মিশনারীদের বিশুদ্ধবাদিতা। গিরিশ চন্দ্র রামকৃষ্ণকে প্রথম দর্শন করেন শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনের শেষ পর্বে সম্ভবতঃ 1880 খ্রীষ্টাব্দে।
ক্রমশঃ