রাশিয়া: এক স্বপ্ন উড়ান (দ্বিতীয় পর্ব) © সায়ন্তন ধর

রাশিয়া: এক স্বপ্ন উড়ান (দ্বিতীয় পর্ব)
© সায়ন্তন ধর

এতোসব তথ্য জানলাম,কিন্তু নিউ নর্ম্যাল পরিস্থিতিতে সশরীরে রাশিয়া ভ্রমন মূলতুবী রইলো। নির্ধারিত সময়ে আমি আমার গবেষনাপত্র পাঠিয়ে দিলাম। আয়োজকরা ভিডিও কনফারেন্স ও পোস্টার ডিসপ্লের মাধ্যমে কর্ম সম্পাদন করতে চাইলেন। সেভাবেই আধুনিক যুগের বিজ্ঞানের উপর নির্ভর করে সমস্ত কাজ সমাধা হল। কিন্তু মন চাইল সোভিয়েত রাশিয়া ঘুরে দেখতে। হ্যাঁ, সোভিয়েত রাশিয়া মানে ১৯৯১ সালের আগে। টাইম মেশিনে করে ৩৩ বছর পিছিয়ে গেলাম। ১৯৮৭ সাল, তখন রাশিয়া ছাড়াও আরও ১৪ টি দেশ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে। ইউক্রেন, বেলারুশ, উজবেকিস্তান, কাজাকস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, জর্জিয়া, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, মোলডাভিয়া, কিরগিস্তান। দেশটির দক্ষিণ থেকে পূর্ব, উত্তর হয়ে পশ্চিমে ভ্রমণে ইতি টানার ইচ্ছে নিয়ে পাড়ি জমালাম অর্থাৎ শুরু হল মানসভ্রমণ। আমাদের দেশ থেকে রাশিয়ায় প্রবেশ করতে গেলে নেতাজীর দেখানো পথে যাওয়াই স্থির করলাম। আফগানিস্তানের কাবুল পর্যন্ত মন উড়ানে চড়ে সেখান থেকে আমুদরিয়া নদী পার হয়ে সিরদরিয়া, সমরকন্দ থেকে তাশখন্দ – নামগুলো শুনলেই যেন গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। সিরদরিয়ার পাড় ধরে চলতে চলতে মোহনায় এলাম। উষর কিজিল্কুম মরুভূমির বুকে অন্তরবাহিনী আমুদরিয়া সিরদরিয়া প্রবাহমানা। উজবেক ও কাজাক ভাষায় কিজিল্কুমের অর্থ লাল বালি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩০০ মিটার উচ্চতায় এই অঞ্চলটি প্রায় সমতল। মাঝে মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু ওয়েসিস। রাশিয়ান কচ্ছপ, ট্রান্স কাস্পিয়ান মনিটর লিজার্ড, সাইগা অ্যান্টিলোপের বিচরণ ক্ষেত্র। বালি যখন হাওয়ায় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বাতাসে সরে সরে যায় তখন মাঝে মধ্যে প্রাগৈতিহাসিক বিভিন্ন ফসিলের দেখা মেলে। চলতে চলতে পৌঁছে গেলাম আরল সাগরে। এ যে এক নস্টালজিয়া। তুর্কী, মঙ্গোলিয়ান ভাষায় যার অর্থ হল দ্বীপের সাগর। যে হ্রদ পূর্বে ১১০০ টি দ্বীপ সম্বলিত বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম ছিল, ১৯৬০ সাল থেকে সেটি শুকিয়ে যেতে থাকে এবং আমুদরিয়া সিরদরিয়ার দ্বারা আনীত পলি সঞ্চয়ের ফলে এবং ১৯৯৭ সালে সিরদরিয়া নদীর জলকে সেচের জন্য ঘুরিয়ে দেওয়ায় এই হ্রদে জল সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। অতিরিক্ত কার্পাস চাষ জল শুকিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারন। জানা যায় যে কার্পাস গাছ প্রচুর জল শোষণ করে। এই আরল সাগরের ৪ টি অংশ। উত্তর আরল সাগর, মধ্যবর্তী হ্রদ ও দক্ষিণ আরল সাগরের পূর্ব ও পশ্চিম বেসিন। ২০১৪ সালের নাসার তোলা একটি উপগ্রহ চিত্রে দেখা যায় যে পূর্ব বেসিন সম্পূর্ণ রূপে শুকিয়ে গেছে এবং পশ্চিম বেসিনের খুব অল্প পরিমাণই জলমগ্ন রয়েছে। কাজাকস্তান অবশ্য উত্তর আরল সাগরকে বাঁচাতে ‘ডাইক কাকারাল’ নামে একটি ড্যাম তৈরি করে ২০০৫ সালে। ফলস্বরূপ জলস্তর কিছুটা বৃদ্ধি পায়। এক সময়ে আরলে জাহাজ বন্দর ছিল, যা আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত। এখানকার মানুষের প্রধান উপজীবিকা ছিল মৎস্যচাষ যা ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। সুন্দর প্রাকৃতিক একটি হ্রদকে শুকিয়ে যেতে দেখে আমার মত পরিবেশ প্রেমীর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। ভাবলাম হাজার অশ্রুবিন্দু দিয়ে আবারও একদিন যেন কানায় কানায় পূর্ণ হয় আরল সাগর। আরল সাগরের শুকিয়ে যাওয়ার ট্র্যাজেডিকে এই গ্রহের সবচেয়ে খারাপ প্রাকৃতিক বিপর্যয় বলা যেতে পারে। দক্ষিণ আরল সাগরের পূর্ব বেসিনটি বর্তমানে শুকিয়ে আরাল্কুম মরুভূমির সৃষ্টি করেছে। এরপর আমার গন্তব্য আলমাটি যা পূর্বে আলমা-আটা নামে পরিচিত ছিল এবং পূর্বতন কাজাকস্তানের রাজধানী। উত্তর আরল সাগরের তীরবর্তী আরলসুল’ফাত শহর থেকে ১২৬৫ কিমি সড়ক পথে আলমাটি প্রায় ২০ ঘণ্টার যাত্রাপথ। দীর্ঘ যাত্রাপথের পুরোটাই প্রায় সিরদরিয়া নদীর তীর ঘেঁষে। একদিকে নদী অপর দিকে মরুপ্রায় ভূমি। নদী শেষ হতেই শুরু হল তিয়েনশান পর্বত। সবুজের দেখা মিলল অনেকক্ষণ পর। আলমাটি পৌঁছলাম। এরপর গন্তব্য কাজাখস্তানের বর্তমান রাজধানী নূর-সুলতান। এই যাত্রাপথের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ বলখাস হ্রদ। প্রায় ৩২৫ কিমি রাস্তা বলখাসের গা ঘেঁষে পাড়ি দেব। স্থানীয় তাতার ভাষায় বলখাস শব্দের অর্থ হল ‘জলাভূমিতে ঘাসের গুচ্ছ’। হ্রদের তীরে উইলো, পপলার, অ্যাসপেন, টাইফা, বেত দেখা যায়। জলে মাইরিওফাইলাম, পটামোজেটন, ইউট্রিকুলারিয়া, সেরাটোফাইলাম, ন্যাজাস প্রভৃতি উদ্ভিদের সমারোহ লক্ষ্য করলাম। তুঁত বর্ণের জলে সবুজ উদ্ভিদের গোছা বলখাস নামকরণকে সার্থক করে তুলেছে। নাম না জানা প্রচুর মাছ থাকায় প্রায় ১২০ প্রজাতির পাখির স্থায়ী-অস্থায়ী আবাসস্থল এটি। দেখা মিলল কর্মোর্যা ন্ট, মারবেল্ড টিল, ফিস্যান্ট, গোল্ডেন ঈগল, গ্রেট ইগ্রেট, ডাল্মাশিয়ান পেলিক্যান, ইউরেশিয়ান স্পুনবিল, হুপার সোয়ান প্রভৃতি। মৎস্যজীবী মানুষের দেখা মিলল। হ্রদ তীরবর্তী খনি অঞ্চল থাকলেও এখনও পর্যন্ত এখানকার বাস্তুতন্ত্র ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেনি। এর একটা বড় কারন বোধ হয় অসংখ্য নদীর মোহনা। সেই নদীগুলির নাম আয়াগুজ, লেপসি, আকসি, কারাতাল, ইলি কি সুন্দর সব নাম। প্রতিটি নদীই তিয়েনশান পর্বতের বরফগলা জলে পুষ্ট ও উৎসে বৃষ্টিপাত তুলনামূলক বেশি হওয়ায় প্রচুর পরিমাণ জল হ্রদে সরবরাহ করে থাকে। হ্রদের তীরবর্তী শহর বলখাস অতিক্রম করার পর থেকেই সড়ক ও হ্রদের তীরের ব্যাবধান বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে দৃষ্টির আড়ালে চলে যায় বলখাস। এরপর আরও প্রায় ৬০০ কিমি রাস্তা পাড়ি দিলাম কোথাও বালিয়াড়ির মাঝখান দিয়ে চলছে গাড়ি। গাড়ির চাকায় যে ধুলো উড়ছে তাতে পিছনে তাকালে মনে হচ্ছে যেন ধূলিঝড় ধেয়ে আসছে। দূরে দূরে ৫-৬ টি করে খেজুর গাছ জোট বেঁধেছে মরূদ্যানে। মরুপ্রায় ভূমিতে জ্যোৎস্নালোকিত রাতের শোভা অসাধারণ। হালকা নীল আলো যেন ছড়িয়ে পড়েছে চারধারে। মেঘহীন আকাশে ঝকঝকে চাঁদ ও অজস্র নক্ষত্রের আলো যেন অতন্দ্র প্রহরী, একটি ধূলিকণাও চুরি হতে দেবেনা যেন। দূর থেকে ঝকমকে একটি শহর ক্রমে এগিয়ে আসতে লাগলো। পৃথিবীর দ্বিতীয় শীতলতম রাজধানী শহর নূর-সুলতান। শহরের নামের সঙ্গে তার স্থাপত্যও ভীষণ সুন্দর। শীতে এখানকার প্রায় প্রতিটি নদীই বরফাবৃত হয়ে যায়। পূর্বে এই শহরের নাম ছিল আস্তানা। ইশিম নদীর তীরবর্তী এই শহর খুবই পরিকল্পিত শহর। প্রাচীন ঐতিহ্যমণ্ডিত সৌধের সাথে ঝাঁ চকচকে গগনচুম্বী অট্টালিকার সারি মহিমান্বিত করেছে এই শহরকে। শহরে যাতায়াতের অনেক রকম ব্যবস্থা থাকলেও ‘আস্তানাবাইকের’ ব্যবস্থাটি সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও পরিবেশবান্ধব। স্থানীয় মুদ্রার হিসেবে ভাড়া বাবদ টাকা জমা দিলে শহরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা ৪০ টি আস্তানাবাইক স্টেশন থেকে এই সাইকেল গুলি ঘণ্টা হিসেবে ব্যবহার করা যায়। যাইহোক এবার বিদায় জানাতে হয় নূর-সুলতানকে। এবার গন্তব্য ইরকুটস্ক। প্রায় ৩০০০ কিমি দীর্ঘ রাস্তায় শ্যামল সমভূমি, আলতাই ও সায়ন পর্বত অতিক্রম করতে হয়। আলতাই পর্বত থেকে ইরতিশ ও ওব নদীর উৎপত্তি। সায়ন পর্বত দক্ষিণ সাইবেরিয়ার একটি উল্লেখযোগ্য পর্বতশ্রেণী। এখান থেকেই ইনিসি নদীর সৃষ্টি হয়েছে। সায়ন পর্বত অঞ্চলটিতে ইভেঙ্কস উপজাতির বসবাস। এরা বল্গা হরিণ প্রতিপালন করে। বল্গা হরিণকে পোষ মানানোর এই ঐতিহ্য এখান থেকেই শুরু হয়েছিল। যাত্রাপথে দূর থেকে বেশকিছু বল্গা হরিণও চোখে পড়লো। এর পরেই ইরকুটস্কে পৌঁছলাম। ইরকুটস্ক একটি রেলস্টেশন যা ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ের অংশ। বহুদিন থেকে শুনে আসা পৃথিবীর অন্যতম দীর্ঘ রেলপথে সওয়ার হওয়ার ইচ্ছা পূরণ করার জন্য চেপে বসলাম লাল ও ছাইরঙা ট্রেনে। ট্রেনে ওঠার পর মনে পড়ে গেল নিকোলাই অস্ত্রভস্কির লেখা ইস্পাত গ্রন্থের নায়ক পাভেল করচাগিনের কথা। এই পাভেল করচাগিনের মত অসংখ্য মানুষ প্রবল শীত উপেক্ষা করে এই রেলপথ নির্মাণ কাজের সাথে যুক্ত। এঁদের আত্মত্যাগে দূর হয়েছে নিকট। ট্রেনের গদিমোড়া আসনে বসে ঝকঝকে কাঁচ দিয়ে বরফ দেখতে পারছে ভ্রমনবিলাসী মন। ছোটবেলায় আলেস্কি টলস্টয়ের সোনার চাবি উপন্যাসটি পড়েছিলাম। আজ ঠিক করেছি বৈকাল হ্রদ না আসা পর্যন্ত বুরাতিনোর কর্মকাণ্ড আরও একবার পড়ে নেব। ট্রেনের প্রতিটি যাত্রীকে ট্রেনের টিকিট দেখিয়ে তবেই উঠতে দেওয়া হচ্ছে। ট্রেনের ভিতরের সাজসজ্জা খুবিই আকর্ষণীয় ও রুচিশীল।

(ক্রমশঃ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *