# ছোটগল্প # / কলমে — অরণ্যানী অরণ্যানী # ময়ূরী #
# ছোটগল্প # / কলমে — অরণ্যানী অরণ্যানী
# ময়ূরী #
১৫ বছরের কিশোরী মেয়েটির বন্ধু খুবই কম। যে কয়েকজন বন্ধু আছে, তারা সকলেই একটি করে প্রেমিক জোগাড় করে ফেলেছে এরই মধ্যে। দেখা হলেই তাই একই প্রশ্ন বন্ধুদের, “এই ময়ূরী, তোর প্রেমিক কই?” উত্তর দিতে পারে না ময়ূরাক্ষী। ভোরে ঘুম ভাঙে পাখিদের কলরবে। আবছা অন্ধকার থাকতেই কন্ঠে তার গানের ভেলা ভাসিয়ে দেয় প্রকৃতিতে। ধীরে ধীরে আকাশ রাঙিয়ে সূর্যের আত্ম প্রকাশ নতুন দিনের সূচনা ঘটায়। সোনালি রোদ জানলা দিয়ে এসে পড়ে বিছানার উপর। জানলার বাইরে গাছের পাতায় রোদের ঝলক চোখে ধাঁধিয়ে দেয়।
বাবা, মা, যে যার কাজে চলে গেলে স্কুলে যাওয়া ময়ূরীর হয়ে ওঠে না। বাড়ির পাশে, নদীর ধারে আপন মনে ঘুরে বেড়ায়। আকাশের ছায়া পড়ে নদীর জল নীল হয়ে ওঠে। রোদের তাপ বাড়লে রূপোলী ছোট ছোট ঢেউ গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে ময়ূরী। নদীর পারে কত গাছ ছায়া ঢেকে দিয়েছে চারপাশ। নাম না জানা রঙিন বনফুলের লতারা কত গাছকে জড়িয়ে অনেক উপরে উঠে গেছে।
নদীর এ পাড়ে ঘাট নেই। তাই লোকজনের ভিড় কম। ময়ূরী একলা দু’হাতে ঝোপ সরিয়ে ধীরে ধীরে নদীর কাছে চলে আসে। হাওয়া বন্ধ হলে স্থির নদীর জলে নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে ভাবে, কে আমি? এখানে এলেম কোথা থেকে? হাতের নাড়ায় নিজের প্রতিচ্ছবি মুছে দিয়ে চুপটি করে বসে দেখে নদীর কূলে মাছেদের খেলা! দুপুরের ভাত খাওয়ার পর অবশিষ্ট কিছু নদীর জলে ফেলে দিয়ে দেখতে থাকে মাছেদের খাওয়া। হঠাৎ একটি বক, কিংবা মাছরাঙা পাখি টুক করে জল থেকে ছোট মাছ মুখে নিয়ে পাশের গাছটায় গিয়ে বসে।
শালিক, চড়ুইরা আশেপাশে খাবার খুঁটে খায়। উজ্জ্বল একঝাঁক পায়রা উড়ে গিয়ে বসে নদীর ওপারে মুখার্জি দের বাড়ির কার্নিশে। নীল সাদা উজ্জ্বল আকাশে সূর্যের পেছন থেকে কখন কালো মেঘেরা উঁকি মারে। বেলা তখন দুপুর। আবছা আঁধার নামে। আকাশে একা একটা চিল ঘুরপাক খায় অনেকক্ষণ ধরে। নদীর শীতল বাতাস শরীরকে স্পর্শ করে যায়। কেমন যেন অজানা এক ভীতির অনুভূতি কাজ করে মনে।
আজকাল মাঝে মাঝে এমন হয়। নির্জনতার মধ্যে, আবছা অন্ধকারে, কী যেন এক অজানা ভীতি জাগে হঠাৎ করেই। পরিচিত এক বান্ধবী এসে জিজ্ঞেস করে, “ময়ূরী, স্কুলে গেলি না?” নির্জনতা ভঙ্গ হতেই চমকে ওঠে ময়ূরী। বান্ধবীকে দেখে নিশ্চিন্ত হয়। দু চার কথার পর বান্ধবী তার প্রেমিক সহ একটু দূরে একটি গাছের আড়ালে সরে যায়। ঘরে ফিরে আসে ময়ূরী।
প্রেম? না। প্রেম করা হয়তো আর তার কোনদিনই হবে না। দু’চোখ জলে ভরে ওঠে। একলা নিজের শয্যার বালিশ ভিজতে থাকে কিশোরীর চোখের জলে। বাইরে তখন বৃষ্টি নেমেছে অঝোরে। বৃষ্টির ছাঁট খোলা জানলা দিয়ে ঘরকে ভেজাচ্ছে। সোঁদা মাটির গন্ধ ভেসে আসছে। স্মৃতিপটে ভেসে আসছে কিছু ছবি।
– হাত ছাড়ো। ভালো লাগছে না।
– কেন, তুমি আমাকে ভালোবাসো না ময়ূরী?
– বাসি, কিন্তু তুমি ওভাবে হাত চেপে ধরছ কেন? আমার ভালো লাগে না।
– তবে তুমি আমাকে ভালোবাসো না। তুমি ভালোবাসার কিছুই বোঝ না।
কি বলবে ময়ূরী। বিনা উত্তরে হাতের বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে দৌড়ে পালিয়ে এসেছিল সেদিন।
ময়ূরী যখন বান্ধবীদের তার অভিজ্ঞতার কথা বলেছিল, ওরা ওকে ছেলেমানুষ বলল। বান্ধবীরা চুমু খেয়েছে প্রেমিককে, শরীরের গোপন অঙ্গও স্পর্শ করতে দিয়েছে! এটাই তো ভালোবাসা। নাহলে প্রেম হবে কিভাবে? মনে মনে সমর্থন করতে না পারলেও কিছু বলতে পারেনি ময়ূরী।
আরও একদিন। সেটা ছিল দুর্গা পুজোর অষ্টমী। বান্ধবীরা কয়েকজন মিলে ঠাকুর দেখার ছলে গোপন অভিসারে চলেছে। ময়ূরাক্ষীর প্রেমিকও দেখা করতে চায়। দুর্গাপুজোয় সাজগোজ করে প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে যেতে কার না ভালো লাগে। সেছাড়া এতগুলো বান্ধবী তো আছে সঙ্গে।একটা টোটো ভাড়া করে ময়ূরী সহ তিন জোড়া প্রেমিক প্রেমিকার দল উঠল। দু চার কথার পরই সকলে কালো প্লাস্টিক টেনে দিল টোটোর দু’দিকে। ড্রাইভার এসবে অভ্যস্ত। তার ভাড়া পেলেই হল। তারপরই বাকি দু’জোড়া প্রেমিক প্রেমিকা পরস্পরকে আলিঙ্গন করে চুম্বনে আবদ্ধ হল। এবার ময়ূরাক্ষীর প্রেমিকও কিছুটা সাহস করে তাকে আলিঙ্গন করল। দম বন্ধ হওয়ার মতো অনুভূতি হল ময়ূরীর। তীব্র প্রতিবাদে ড্রাইভারকে টোটো দাঁড় করাতে বাধ্য করল ময়ূরী।বাকি সকলে হতভম্ব। কী হল ময়ূরীর? ময়ূরী টোটো থেকে নেমে দৌড়ে চলে গেল। ভীত ড্রাইভার আর বাকিদের নিয়ে যেতে রাজি হল না। অসন্তুষ্ট বান্ধবী ও তাদের প্রেমিকরা ময়ূরীকে অস্বাভাবিক একটি মেয়ে বলে আখ্যা দিল।
কখন বৃষ্টি থেমে গিয়ে মেঘলা ভাঙা রোদ উঠেছে। পশ্চিমের জানলা দিয়ে সেই সোনালি রোদ এসে পড়েছে ঘরের মেঝেয়। ময়ূরী উঠে বাইরে এল। গাছের পাতা থেকে তখনও জমে থাকা বৃষ্টির দু এক ফোঁটা ঝরে পড়ছে। ময়ূরী মুগ্ধ দৃষ্টিতে চারপাশে তাকিয়ে ভাবতে লাগল, আমার প্রেমিক কে? কন্ঠে তার গান ভেসে উঠল, “মেঘলা ভাঙা রোদ উঠেছে লাগছে ভারি মিষ্টি।” (প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান)
(সমাপ্ত)