রাশিয়া: এক স্বপ্ন উড়ান (প্রথম পর্ব) © সায়ন্তন ধর

রাশিয়া: এক স্বপ্ন উড়ান (প্রথম পর্ব)
© সায়ন্তন ধর

লকডাউন পিরিয়ডে বিশ্ব জুড়ে মানুষের জীবনে যখন সহসা ছন্দপতন ঘটে গেলো,আপামর জনমানসে ও চিন্তনে, দৈনন্দিন অভ্যস্ত জীবনযাত্রায় একটা অকস্মাৎ সাময়িক ছেদ পড়লো, স্তব্ধতা কাটিয়ে উঠতে মরিয়া মানুষ সৃজনমূলক কাজে নিজেকে আপ্রাণ নিয়োজিত করতে চাইলো, ঠিক এমন সময়েই এলো আমার রাশিয়া ভ্রমণের সুযোগ, যা আমার স্বপ্নেরও অতীত। পরিবেশ সংক্রান্ত গবেষণামূলক প্রবন্ধ চেয়ে পাঠালো রাশিয়ার ইউ.জি. সি স্বীকৃত একটি জার্ণালের সম্পাদকমন্ডলী। সেই সঙ্গে সেমিনারে যোগ দেবার জন্য আমন্ত্রিত হলাম। রাশিয়া মঙ্গোলিয়া ও ভারতের বহু স্বনামধন্য গবেষক আমন্ত্রিত সেখানে। দু’দিনব্যাপী সেমিনারের পাশাপাশি উফা নগরীর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের প্রকৃতি ও বাস্তুতন্ত্র সম্পর্কে জানবার জন্য একটি বিলাসবহুল ভ্রমণের আয়োজন ছিলো। সীমিত সময়ের মধ্যে Procedure maintain করে ধাপে ধাপে প্রবন্ধ তৈরীর কাজসহ সেমিনারের জন্য তৈরী করতে লাগলাম নিজেকে। সেই সাথে জানতে চেষ্টা করলাম রাশিয়াকে। রাশিয়া সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেতে আমার এই লেখার অবতারণা।

রাশিয়া অর্থাৎ রাশিয়ান ফেডারেশন বিশ্বের বৃহত্তম দেশ যা ১৭১২৫২০০ বর্গ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট। এশিয়া ও ইউরোপ মহাদেশ জুড়ে এর বিস্তার। এর উত্তরে সুমেরু মহাসাগর,পূর্বে প্রশান্ত মহাসাগর,দক্ষিণে কৃষ্ণসাগর , কাস্পিয়ান সাগর ও পশ্চিমে বাল্টিক সাগর অবস্থিত। এর আন্তর্জাতিক সীমান্তে রয়েছে ফিনল্যান্ড, এস্তোনিয়া, নরওয়ে, বেলারুশ, লাটভিয়া, কাজাকস্তান, আবখাজিয়া, ইউক্রেন, আজারবাইজান, জর্জিয়া, সাউথ ওসেটিয়া, চায়না, মঙ্গোলিয়া, জাপান, ইউনাইটেড স্টেটস্ অব আমেরিকা, উত্তর কোরিয়া – এই ষোলটি দেশ। বিশ্বে নবম জনসংখ্যাবিশিষ্ট দেশ এটি। মোট জনসংখ্যা ১৪,৬৭,৪৮,৫৯০;জনঘনত্ব ৮.৪ জন প্রতি বর্গ কিলোমিটারে। পূর্ব পশ্চিমে রাশিয়ার বিস্তার প্রায় ৯০০০ কিলোমিটার বলেই এখানে ১১টি টাইম জোন। রাশিয়ার প্রধানতঃ রাজধানী মস্কো ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল (যা ইউরোপ মহাদেশের অংশ)বেশী জনঘনত্বপূর্ণ। এদেশের পূর্বভাগ অর্থাৎ সাইবেরিয়া অঞ্চলটি বিরল জনঘনত্বপূর্ণ। ইউরাল পর্বত ইউরাল নদী এবং কাস্পিয়ান সাগর দেশটিকে ইউরোপ ও এশিয়া অঞ্চলে সুস্পষ্টভাবে ভাগ করেছে। আমাদের দেশ ভারতে যেমন আর্যাবর্ত,দাক্ষিনাত্য পূর্বাঞ্চল,পশ্চিমাঞ্চল,মধ্যাঞ্চল,উত্তর-পূর্বাঞ্চল এরকম ভাগের উল্লেখ করা হয় আলোচনার ক্ষেত্রে,যদিও এগুলো রাজনৈতিক কোন ভাগ নয়,তেমনই রাশিয়ার ক্ষেত্রেও এরকম ভাগগুলিকে ফেডারেল ডিস্ট্রিক্ট বলা হয়। এরকম ৮টি ফেডারেল ডিস্ট্রিক্ট রয়েছে। যেমন : সেন্ট্রাল, নর্থ ওয়েস্টার্ণ, সাদার্ণ, নর্থ ককেশিয়ান, ভল্গা, ইউরাল, সাইবেরিয়ান ও ফার ইস্টার্ণ। দেশটিকে ছয় প্রকার ফেডারেল সাবজেক্টে ভাগ করা হয়। যথা : ২২ টি রিপাবলিক, ৯টি ক্রেইস, ৪৬টি ওব্লাস্টস, ৩টি ফেডারেল সিটি, ১টি অটোনোমাস ওব্লাস্ট ও ৪টি অটোনোমাস অক্রুগস্। মোট ফেডারেল সাবজেক্ট আছে ৮৫টি। রিপাবলিকগুলির জনবসতির পূর্বপুরুষেরা রুশ বংশোদ্ভূত নয়। এদের ভাষা,কোন কোন ক্ষেত্রে ধর্ম এবং সংস্কৃতি ভিন্ন ভিন্ন। এদেরকে রাশিয়ার সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং এদের বসতিযুক্ত অঞ্চলগুলিকে প্রথমদিকে অটোনোমাস সোভিয়েট সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক এবং পরে শুধু রিপাবলিক স্ট্যাটাস দেওয়া হয়। বাসকোরটোস্তান এরকমই একটা রিপাবলিক।এর রাজধানী উফা-ই হলো আমার গন্তব্যস্থল। ১৯১৭- এর নভেম্বর বিপ্লবের পর সোভিয়েত রাশিয়ার প্রতিষ্ঠার সময়ে সমাজতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন দেশগুলিকে নিয়ে গড়ে ওঠে সোভিয়েত ইউনিয়ন। সেই সময়কার বহু রিপাবলিক অবশ্য ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সঙ্গে সঙ্গে রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন দেশ রূপে আত্মপ্রকাশ করে। যেমন ইউক্রেন,কাজাকস্তান প্রভৃতি। ক্রাইস এবং ওবলাস্ট প্রায় একই রকম ফেডারেল সাবজেক্ট এবং রাশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ অঞ্চল এগুলি। রাজধানী মস্কো,সেন্টপিটার্সবার্গ এবং সেভাস্টোপোল -এই তিনটি ফেডারেল সিটি।জেউইশ হলো একটাই অটোনোমাস ওবলাস্ট। ৩টি অটোনোমাস অক্রুগস্ ওবলাস্টের অধীনস্থ হলেও চুকোটকা অটোনোমাস অক্রুগটি কোনো ওবলাস্টের অধীনস্থ নয়। এবারে আসছি বাসকোরটোস্তান রিপাবলিক প্রসঙ্গে। বাসকির উপজাতির নাম থেকে এই নামটি এসেছে। এরা সবাই বাসকির ভাষায় কথা বলে যা তুর্কিক ভাষার একটি শাখা। বর্তমানে এর জনসংখ্যা ৪০৬৩২৯৩ ।এখানে বিভিন্নরকম অভিবাসনের ফলে রাশিয়ানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। বাসকির ও রাশিয়ানদের মধ্যে মৈত্রীর ৪০০তম দিবস উপলক্ষ্যে বেলায়া নদীর পাশে একটি পাহাড়ে একটি স্মৃতিসৌধ বা মনুমেন্ট স্থাপিত হয়েছে। তার সাথে কিছু এথনিক গ্রুপ যেমন ভল্গাতাতার, চুহাস, মারি, ইউক্রেনীয়- এদের বসতি দেখা যায়। ধর্মের দিক থেকে মুসলিমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং রাশিয়ান অর্থোডক্স ক্রিশ্চান লক্ষ্য করা যায়। দক্ষিন ইউরাল পর্বত এবং তৎসংলগ্ন সমভূমি এর ভৌগলিক পরিবেশ রচনা করেছে। এটি রাশিয়ার ইউরোপীয় অংশে অবস্থিত। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ দর্শনীয় স্থানগুলি হলো শিহানটোরাটাউ পাহাড়, ইয়ামানটাউ পাহাড়, আটিশ জলপ্রপাত, ইয়াকটিকুল হ্রদ ইত্যাদি। বাসকোরটোস্তানের আয়তন ১৪৩৬০০ বর্গ কিলোমিটার যা আমাদের পশ্চিমবঙ্গের চেয়েও অনেক বড়ো। মাউন্ট ইয়ামানটাউ এখানকার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ (১৬৩৮ মি.)। ১৩০০০ এরও বেশী নদী ও ২৭০০ টি হ্রদ সম্বলিত অঞ্চল এই রিপাবলিক। এখানকার বৃহত্তম নদী হলো বেলায়া বা আঘিডেল (১৪৩০ কিলোমিটার)।উফা নদী বা কারাইডেল (৯১৮কিমি)ও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদী। বেলায়া ও উফা নদীর সংযোগস্থলে রাজধানী উফা। বৃহত্তম হ্রদটির নাম আসিলিকুল (২৩.৫ বর্গ কিমি)।এই অঞ্চলটি রাশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশী খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ। প্রায় ৩০০০ ধরণের খনিজ এখানে পাওয়া যায়। ক্রুড অয়েল রিজার্ভারও রয়েছে। এতো প্রকার খনিজ সম্পদ পাওয়া যায় বলে এই অঞ্চলটি শিল্প সমৃদ্ধ। রিপাবলিকের মধ্যে ৬২০০০ বর্গ কিলোমিটার অরণ্যাবৃত যা মোট আয়তনের এক তৃতীয়াংশ।এখানকার একটি অন্যতম জাতীয় উদ্যান হলো বাশকিরিয়া জাতীয় উদ্যান। এছাড়াও রয়েছে সুলগানতাস নেচার রিজার্ভ এবং আলতিন-সোলোক এন্টোমোলজিক্যাল রিজার্ভ। এখানে তৈগা ও চওড়া পাতার অরণ্যের মিশ্র বনভূমি দেখা যায়। ৮০০ র বেশী সপুষ্পক উদ্ভিদের প্রজাতী রয়েছে যার মধ্যে ১১৭টি দুর্লভ প্রজাতির।এখানে বিশেষ প্রজাতির পেঁয়াজ লপসাইডেড অনিয়ন (Allium obliquum) পাওয়া যায়। বার্চ, লার্চ, কণিফার্স, ওক, এলম্, ম্যাপেল, অ্যাসপেন, টিলিয়া, লিন্ডেন প্রভৃতি কাষ্ঠপ্রদায়ী উদ্ভিদ আছে এই অরণ্যে।এই অরণ্যে বাদামী ভালুক, এলক বা ওয়াপিতি নামক বৃহদাকার হরিণ, নেকড়ে, লিঙ্কস নামক বিড়ালজাতীয় প্রানী,বিভার সহ ৬০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৫০ প্রজাতির পাখী,৩০ প্রজাতির মাছ ও ১১ প্রজাতির উভচর পাওয়া যায়। পাখীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ইস্টার্ণ ইম্পেরিয়াল ঈগল এবং হোয়াইট টেইল্ড ঈগল। বেলায়া নদীতে সাইবেরিয়ান স্যামন মাছ পাওয়া যায়। পারমিয়ান পিরিয়ডের অ্যাসেলিয়া যুগ নামটি এসেছে এখানকার অ্যাসেল নদীর নামানুসারে। এখানকার শীতকালীন গড় তাপমাত্রা -১৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং গ্রীষ্মকালীন গড় তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস।
উফা রাশিয়ার একাদশতম জনবহুল নগর (জনসংখ্যা ১১২০৫৪৭)।জনঘনত্ব ১৫০০ জন প্রতি বর্গ কিলোমিটারে। এই নগরীর পত্তন হয় ১৫৭৪ সালে। স্থানীয় খনিজ ও শিল্পের ওপর ভিত্তি করে এখানকার অর্থনৈতিক পরিকাঠামো গড়ে উঠেছে। এই শহরটি M5 (কাজান -মস্কো) এবং M7 ( কাজান -রাশিয়ার অন্যান্য অংশ) জাতীয় সড়ক দ্বারা সংযোগ রক্ষা করেছে। আমাদের যেমন ওলা, উবের তেমন এখানে মাশরুটকা হলো রুটেড ক্যাব। ট্রাম পরিষেবা রয়েছে। মেট্রো প্রস্তাবিত। এই শহরটি ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথের সাথেও যুক্ত। উফাতে উফা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টও রয়েছে। উফা ফেডেরাল ইনভেস্টিগেশন সেন্টার, উফা ইন্সটিটিউট অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস, বাসকির স্টেট ইউনিভার্সিটি, উফা স্টেট অ্যাভিয়েশন টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি, উফা স্টেট পেট্রোলিয়াম টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি, ইউরাল স্টেট ল ইউনিভার্সিটি -এর মতো বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। উফা নদীর নামটি এসেছে ইরাণীয় শব্দ ‘অপ্’ থেকে যার অর্থ হলো জল। এটি সংস্কৃত শব্দও। এখানকার জনপ্রিয় খেলা হলো আইস হকি,ফুটবল,ভলিবল,হ্যান্ডবল ও বাস্কেটবল। বাতাসে শ্বাসরোধকারী রাসায়ণিক গন্ধ এবং ভীষণই অপরিচ্ছন্নতা এখানকার বাস্তুতান্ত্রিক সমস্যা। বাসকোরটোস্তানের জাতীয় প্রতীক সালাওয়াত য়ুলায়েভ মনুমেন্ট উফাতেই অবস্থিত। লালতুলপান মসজিদ ও উফা ক্যাথিড্রাল ধর্মীয় সহাবস্থানের প্রতীক।বাসকির কুইজাইন এখানকার পারম্পরিক খাবার। শুকনো লঙ্কা ও গোলমরিচ এখানকার খাদ্যে ব্যবহৃত প্রধান মশলা এবং প্রতিটি খাদ্যেই মাংস প্রধান উপাদান। ঘোড়ার মাংস এদের প্রিয়। দৈ জাতীয় খাদ্য কোরোট দিয়ে ঘোড়ার মাংস ম্যারিনেট করা হয়। শুকনো ফল অন্যতম খাদ্য। কাজি হলো হর্স সসেজ। কাক্লাঙ্গানইট, প্যাস্টাইল, কৌমিস, সেয়ালেহ্যারিমে (ঘি-এর মধ্যে চেরী) এসব এখানকার নানাপ্রকার খাদ্য।কৌমিস বাশকিরদের জাতীয় উত্তেজক পানীয়,যাতে সামান্য অ্যালকোহল থাকে। বুজা গম বা ওটমিলের দিয়ে তৈরী পানীয়। ঐরে একপ্রকার স্যূপ। বার্জিয়ান মৌমাছি থেকে পাওয়া বাশকির মধু খুবই জনপ্রিয়। এরা দুধ সহযোগে চা পান করে।

(ক্রমশঃ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *