“আনন্দময় পুরুষ শ্রী রামকৃষ্ণ” — পাপিয়া সাহা

“আনন্দময় পুরুষ শ্রী রামকৃষ্ণ”
পাপিয়া সাহা
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের শেষ দিক।বাংলার রাজনীতির আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। ইংরেজ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ভারতে বানিজ্য করতে এসে সম্পূর্ণ ভারতেই রাজনৈতিক অধিকার কায়েম করে বসল। রেহাই পেলনা বাংলাও। 1757 সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হল।এর প্রভাব শুধুমাত্র বাংলার রাজনীতিতে নয়,বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আধ্যাত্মিক এমন কি মনোজগৎ কেও প্রভাবিত করল। ইংরেজ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সাথে আগত মিশনারীদের ধর্মান্তকরণ নীতি বাংলার ধর্মীয় জগতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করল।তার ওপর যুক্ত হল বাংলার হিন্দুদের ওপর মুসলিম ধর্মান্তকরণ। ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে ইংরেজী শিক্ষার প্রবর্তনে নতুন চিন্তাধারার উন্মেষ ঘটল সারা ভারতে তথা বাংলায়। নব্য বাংলার নতুন প্রজন্ম পাশ্চাত্য ভাবধারার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গী লাভ করল। হিন্দু ধর্মের আচার সর্বস্ব, বাহ্যিক অন্তঃসারশূন্য ধর্মীয় রীতিনীতির ওপর আস্থা হারিয়ে তরুন শিক্ষিত সম্প্রদায় একেশ্বর বাদ খ্রীষ্ট ধর্ম অথবা মুসলিম ধর্মে দলে দলে ধর্মান্তরিত হতে লাগল। লাঞ্ছিত হল হিন্দু ধর্ম, অপমানিত হল সনাতনী হিন্দু ধর্মের সারবত্তা। চিন্তাশীল ভাব জগতের প্রবীণ পণ্ডিত ও মনীষিগন প্রমাদ গুনলেন। মহাসঙ্কটে পরল আমাদের শাশ্বত সনাতনী হিন্দু ধর্ম।
ঠিক এই সঙ্কটাপূর্ণ মুহুর্তে এক শুভ সন্ধি ক্ষণে হূগলী জেলার কামারপুকুরের প্রত্যন্ত গ্রামে আবির্ভূত হলেন দেব শিশুরূপী এক মানব শিশু। পরবর্তীকালে যিনি শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেব নামে সারাজগতে সুপ্রসিদ্ধ হয়েছিলেন। জ্যোতির্ময় দৈবী লক্ষণ যুক্ত, নির্মল স্বভাব, মনোমুগ্ধকর বালখিল্য আচরণে সদা আনন্দময় এই শিশুটিই সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন সর্বসর্ম সমণ্ব্য়ী শাশ্বত সনাতনী পবিত্র হিন্দুধর্মের বীজখানি। যে বীজ মহীরূহ আকার ধারণ করে সারা পৃথিবীর বুকে মানবতার বানী ছড়িয়ে দিয়েছিল। তৃষিত, তাপিত মানুষের সকল দ্বিধা, দ্বন্দ্ব ও সংশয়ের অবসান ঘটিয়ে সত্যের আলোকে উদ্ভাসিত করেছিল। যার মুখ নিঃসৃত অমৃত বানীতেই ঘোষিত হয়েছিল সনাতনী শাশ্বত হিন্দুধর্মের সারবত্তা।
ধর্মপ্রিয়া, তেজস্বিনী, বীরাঙ্গনা রমণী রানী রাসমনি প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণেশ্বর ভবতারিনী মায়ের মন্দির হল তার সাধনার ভূমি।শ্রী রামকৃষ্ণ ঠাকুরের অগ্রজের অবসরের পর রানী রাসমনি ও তার জামাতা শ্রী মধুর মোহন বিশ্বাসের আন্তরিক ইচ্ছা ও আগ্রহে ভবতারিনী মায়ের মন্দিরের পূজার নিযুক্ত হলেন রামকৃষ্ণ। কিন্ত তার প্রথা বহির্ভূত, নির্দিষ্ট রীতিনীতি আচার বিচার বহির্ভূত পূজা পদ্ধতি মেনে নিতে পারলেন না তৎকালীন কট্টর, মৌলবাদী ব্রাহ্মণ সমাজ।তারা ঠাকুরের বিরুদ্ধে সমবেত অভিযোগ তুলে ঠাকুরকে পাগল,ক্ষেপা অনাচারী প্রতিপন্ন করে মায়ের পূজারীর পদ থেকে সরিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র আঁটলেন। কিন্ত ঠাকুরের কোনও ভ্রূক্ষেপ ই নেই তাতে। তিনি নির্মল, সদা আনন্দময়। আত্মভাবেই বিভোর। হিংসা,দ্বেষ, ক্রোধ, নিন্দার্চনা বর্জিত তার আত্মিক সাধনা। যে সাধনার মূল মন্ত্র অকৃত্রিম প্রেম ও ভালবাসা।মানুষের দুঃখ যন্ত্রণায় তার দু চোখে বলে অবিরল প্রেমের অশ্রুধারা। সরল অকপটে তিনি বললেন ভক্তি বিশ্বাস আর উপলব্ধি থাকলে মৃন্ময়ী মা চিন্ময়ী রূপ ধারণ করেন।তার সাধনার উৎস ছিল ঈশ্বর অনুভূতিতে মানব পূজা। তার উপলব্ধিতে মাটির প্রতিমায় পূজো হতে পারে আর রক্ত মাংসের প্রতিমায় তা হয় না।দক্ষিণেশবর ভবতারিনী মায়ের মন্দিরের সাধন পিঠে একের পর এক ধর্মীয় সাধনার বিভিন্ন দিক উন্মোচিত করলেন।ধর্ম কে আড়ষ্ট ও জটিলতার মোড়ে থেকে বের করে এনে তাকে সহজ সরল ভাবে পালনের পথ ব্যাখ্যা করে দেখালেন তার অমৃত বানীর মধ্যে দিয়ে।ভগবানের অস্তিত্ব বিশ্বাস করে মানব সেবার মাধ্যমে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানোর রাস্তা দেখিয়ে দিলেন। অর্থাৎ জ্ঞান, ভক্তি ও কর্ম যোগের সমণ্বয়ে ধর্ম সাধনাই হল ঈশ্বর লাভের প্রকৃত উপায়। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ধর্ম সাধনার আর একটি দিক ছিল ভাব সমন্বয়। তার প্রচারিত ধর্মের মূল উদ্দেশ্য ছিল সর্বধর্ম সমন্বয়।সকল ধর্মের মূল কথা এক।তাই-“যত মত তত পথ “সহজ সরল ভাবে বুঝিয়ে দিলেন এই মত। মিলন, সমন্বয় ও শ্রদ্ধার মধ্যেই রয়েছে ধর্ম পালনের প্রকৃত শান্তি ও উদ্দেশ্য। এই অমৃত বানীর দ্বারা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সমন্বয় সাধন করতে চেয়েছিলেন। প্রাচ্যের আধ্যাত্মিকতা ও পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের সংমিশ্রনে বিশ্ব মানব চেতনার জাগরণ ঘটাতে চেয়েছিলেন। নরেন্দ্র নাথ দত্ত ঠাকুরের বানীর সারমর্ম উপলব্ধি করে সমগ্র পৃথিবীতে তা প্রয়োগ করে বিশ্ব মানব হয়ে উঠতে পেরেছিলেন এবং হয়ে উঠেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ।

বড়ই অদ্ভুত গুরু শ্রী রামকৃষ্ণ। ধর্ম প্রচার করেও তিনি স্বর্গ বা দেব দেবীর কথা বললেন না।তিনি দেখালেন কি ভাবে এই জগৎ কে স্বর্গ করে তুলতে হয়। ঈশ্বর দৃষ্টিতে মানুষ কে দেখাই ছিল তার মূল বানী। তাই নিজের জীবন সাধনার মধ্যে দিয়ে দেখালেন প্রেম ও আনন্দময় জীবনের সার্থকতা।শেখালেন প্রকৃত আধ্যাত্মিক জীবন সদা আনন্দময়।

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতিষ্ঠা ছিল সত্যে, স্থিতি অনন্ত করুণায়। তিনি বিত্তবান ছিলেন না।সাহিত্যিক বিজ্ঞানী বা দার্শনিকও ছিলেন না।সামাজিক প্রতিষ্ঠার বিচারে তার কোনও পরিচয় ছিলনা। তিনি ছিলেন আনন্দময় পুরুষ। আনন্দ ই তার স্বরূপ। তার আনন্দের হাটে বিনামূল্যে মেলে অমূল্য প্রেম ও করুনা।যার স্বাদ পেতে অগণিত, তাপিত, শ্রান্ত, ক্লান্ত মানুষ কৃতাঞ্জলিপুটে জড় হয় তার আনন্দের হাটে।
এক অস্থির সময়ের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছি আমরা।সমগ্র পৃথিবী আজ মহা সঙ্কটের মুখে দাঁড়িয়ে। হিংসা, ষড়যন্ত্র, লালসা অহংকার রিপুগুলি ভয়ঙ্কর নাগিনীর ফনার মত নিঃশ্বাস ছড়িয়ে বিষাক্ত করে তুলেছে পৃথিবীর চারিপাশ। বিকৃত, অবক্ষয়িত ভারতীয় পৌরুষ। চারিপাশে ভয়,সন্দেহ আর অবিশ্বাসের বেড়াজাল। কোথাও শান্তি নেই। তাই শান্তির আশ্বাস পেতে সমর্পিত হই নতজানু হই এই আনন্দময় যুগপুরুষ আমাদের পরম প্রিয় আত্মিক যুগপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ ঠাকুরের চরণে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *